বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনা-বিষয়ক বিভিন্ন প্রচেষ্টার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অবিরল প্রয়াস সব সময়ই অনুপ্রাণিত করে জাতিকে ও নতুন প্রজন্মকে। আর এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গঠন করে লিগ্যাল ভলেনটিয়ার টিম (এলভিটি), যার মূল কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজের সংশ্লিষ্ট আইনি বিষয় নিয়ে গবেষণা করা। এলভিটি এই গবেষণা আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির সঙ্গে যৌথভাবে করে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গবেষণা ছিল ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসমূহে যৌন নিপীড়নের বিচার-অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’। ২০১১ সালে প্রকাশিত এই রিপোর্ট বিশেষভাবে আলোকপাত করে মুক্তিযুদ্ধে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের সাক্ষ্য প্রদানের ওপর।

এই যৌথ গবেষণার জন্য প্রফেসর লরেল ফ্লেচারের নেতৃত্বে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল বাংলাদেশে আসে এবং দুই দিনব্যাপী গোলটেবিল বৈঠক ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ২০১১ সালের জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্টের বিধিমালা সংশোধন করে ‘সাক্ষী সুরক্ষার’ ওপর নতুন ধারা সংযোজন করা হয়। এই গবেষণার কাজ করতে গিয়ে এলভিটির নবীন স্বেচ্ছাকর্মীরা একাত্তরের নির্যাতনের শিকার নারীদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যাঁদের ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছিল, তাঁদের জন্য কিছু করার তাগিদ তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে।

এরপর উন্মোচিত হয় এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার, কম্বোডিয়ান ডিফেন্ডার্স প্রজেক্ট অক্টোবরের ১০-১২ তারিখে আয়োজন করে ‘রিজিওনাল উইমেন’স হেয়ারিং অন জেন্ডার বায়াজড ভায়োলেন্স ইন কনফ্লিকট’ কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, নেপাল এবং বাংলাদেশের সংঘাতকালীন নির্যাতনের শিকার নারীরা এই শুনানিতে অংশ নেন, যেখানে তাঁরা দীর্ঘ নীরবতার অবসান ঘটিয়ে, তাঁদের জীবনে নেমে আসা নৃশংসতার বয়ান দেন। নির্যাতনের শিকার নারীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানা এবং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেওয়াই ছিল শুনানির মূল উদ্দেশ্য। ২০১২-এর এই শুনানিতে বাংলাদেশের দুজন বীরাঙ্গনাসহ পাঁচ সদস্যের একটি দল অংশ নিয়েছিল।

বীরাঙ্গনা কুলসুম বেগমের বয়স ১৯৭১ সালে ছিল ১৪। পাকিস্তানি হানাদারদের ভয়ে বাড়ির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে বাবা লুকিয়ে রেখেছিলেন দুই মেয়েকে। কিন্তু স্থানীয় রাজাকার ঠিকই পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে হাজির হয় এক সকালে। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কুলসুম ও তাঁর বোনকে। এরপর প্রায় চার মাস পাকিস্তানি ক্যাম্পে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন এই দুই বোন। এক বোনের সামনে আরেক বোনকে ধর্ষণও বাদ যায়নি। অবশেষে দুই বোনসহ আরও পাঁচ কিশোরী যখন গর্ভবতী, তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী ব্রিজে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলার জন্য। গুলি খেয়ে পড়ে গেলেও বেঁচে যান কুলসুম, নিচের বিলের জল থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন এক মাঝি। পরে তিনি খুঁজে খুঁজে বের করেন নিজের গ্রাম। কিন্তু গর্ভবতী কুলসুমকে দেখে ফিরিয়ে দেন তাঁর মা। বলেন, সমাজের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না যদি কুলসুম ফিরে আসেন, তাঁদের কাছে কুলসুম মৃত! স্বাধীনতার পরপরই এক কুলি পরিবারের আশ্রয়ে জন্ম হয় কুলসুমের পুত্রসন্তানের, কিন্তু অনাহারে-অর্ধাহারে অসুস্থ শিশুটি মারা যায় চার দিনের মাথায়। কুলসুম এরপর ঢাকায় মানুষের বাড়িতে কাজ করতে থাকেন।

পরে কাজ নেন এক সেলাই কারখানায়। অনেক বছর পর বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীর প্রশ্নের সম্মুখীন হন তিনি। অবশেষে বলতে বাধ্য হন তাঁর শরীর কোন নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে! কুলসুমের স্বামী পরে তাঁকে তালাক দিতে চাইলেও পারেননি। কারণ, তত দিনে কুলসুম গর্ভবতী হন আবারও! কুলসুমের ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক কন্যাসন্তান, যে আজ কলেজে পড়ে। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়েটি জানে যে তার মা একজন বীরাঙ্গনা এবং গর্বভরে শ্রদ্ধা করে তার মাকে, এই জাতির স্বাধীনতার জন্য যিনি দিয়েছেন বিশাল মূল্য।

বীরাঙ্গনা হালিমা আক্তারের জীবনযুদ্ধের কাহিনি আরও বঞ্চনাময়। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে ১৩ বছরের হালিমাকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়াসে বাবা-মা তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দেন শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িও যখন আক্রমণ করল পাকিস্তানি সেনারা, হালিমা পালিয়ে যান শাশুড়ির হাত ধরে। ঘন জঙ্গলে হারিয়ে যান তিনি। অবশেষে একজন লোক এসে জানতে চায় তাঁর বৃত্তান্ত। হালিমা তাঁর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বলায় লোকটি তাঁকে পথ দেখানোর কথা বলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। হ্যাঁ, লোকটি রাজাকার ছিল, যার কাজ ছিল ক্যাম্পে মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক ক্ষুধা নিবারণে সাহায্য করা। কয়েক মাস উপর্যুপরি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর একদিন পালাতে সক্ষম হন হালিমা। স্বাধীনতার পর আশ্রয়হীন হালিমা আবারও প্রতারণার শিকার হন। ভাত-কাপড় দেওয়ার লোভ দেখিয়ে এক লোক তাঁকে নিয়ে আটকে ফেলে পতিতালয়ে, শুরু হয় আরেক নারকীয় জীবন! প্রায় চার বছর পর এক খদ্দেরের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক হয় হালিমার, পরবর্তীকালে যাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। দুটি ছোট ছোট ছেলে রেখে আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা যান হালিমার স্বামী এবং অবধারিতভাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হন হালিমা ও তাঁর দুই পুত্রসন্তান। সেই থেকে আজও জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করছেন হালিমা।

কম্বোডিয়ার শুনানির পর সম্মানিত প্যানেলিস্টরা বাংলাদেশ ও অন্যান্য সরকারের প্রতি তাঁদের মন্তব্য ও সুপারিশমালা উপস্থাপন করেছেন। প্যানেলিস্টরা বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ‘ধর্ষণ’কে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে সংযোজিত করার জন্য। প্যানেলিস্টরা একাত্তরে নির্যাতনের শিকার নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের প্রশংসা করেন, তবে এর পাশাপাশি বীরাঙ্গনাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ ছাড়া ১৯৭৩ সালের আইনে সাক্ষী সুরক্ষার কোনো ধারা উল্লিখিত নেই বলে প্যানেলিস্টরা বিচার-পরবর্তী সময়ে সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি সরকারকে ভেবে দেখতে বলেন। সরকার ছাড়াও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ কীভাবে বীরাঙ্গনাদের পাশে দাঁড়িয়ে, মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ঐতিহাসিক অবদানের কথা লিপিবদ্ধকরণসহ তাঁদের সামাজিক স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে সুপারিশমালা পেশ করেন।

বাংলাদেশ সম্পর্কে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় শুনানি প্যানেলের সুপারিশ ছিল নিম্নরূপ: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে যারা নির্যাতন পরিচালনা করেছে, তাদের বিচারের আওতাভুক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করায় প্যানেল বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানায়, ধর্ষণের শিকার নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ বা ‘যুদ্ধবীর’ হিসেবে প্রতীকী স্বীকৃতিদানকেও প্যানেল অভিনন্দিত করে। তবে এমনি ইতিবাচক স্বীকৃতি অবশ্যই বাস্তব ও মূর্ত অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতা দ্বারা সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন।এরপর প্যানেল বাংলাদেশ সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয় বিষয়ে কতক সুপারিশ পেশ করে। এর একটি দিক হচ্ছে সরকার ও সুশীল সমাজের মিলিত উদ্যোগে আনুষ্ঠানিক আদালতের বাইরে গণশুনানি অনুষ্ঠান, ট্রুথ কমিশন অথবা এমনই প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে নির্যাতিত নারীদের কথা শোনা এবং তা অন্যদের শোনানো, নির্যাতিতদের শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজন পূরণের যথাযথ চিকিত্সাব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি নানা করণীয় সুপারিশ করে কমিশন।

এসব সুপারিশ এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আমাদের আশাবাদী করে তোলে, বীরাঙ্গনাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক মহলের প্রস্তুতি রয়েছে, প্রয়োজন সেই দাঁড়ানোর ক্ষেত্র গড়ে তোলা। প্যানেল আমাদের আরও দেখিয়ে দেয়, বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কত ধরনের কাজ করার রয়েছে, যে কাজের মধ্য দিয়ে সমাজ অর্জন করতে পারে পরিশুদ্ধি ও শক্তি।

কুলসুম বেগম ও হালিমা আক্তারের মতো হাজার হাজার বীরাঙ্গনা বাংলাদেশের নানা স্থানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাঁদের অনেকের কথা নিবিড়ভাবে জানেন মনোয়ারা বেগম। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে নভেম্বর ১৭, ২০১২ জন্ম নেয় নতুন প্রজন্মের সদস্যদের উদ্যোগে ‘বীরাঙ্গনাদের পাশে আমরা’ ফাউন্ডেশন।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ফাউন্ডেশনের সভাপতির পদ গ্রহণে সম্মতি দিয়েছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের জন্য দক্ষ ও আগ্রহী ব্যক্তিদের নিয়ে চারটি কার্যকরী কমিটি গঠিত হচ্ছে। কমিটিগুলো হলো: চিকিত্সা-সহায়ক কমিটি, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণা কমিটি, আর্থিক স্বাবলম্বিতা সহায়ক কমিটি এবং স্বেচ্ছাসেবী কমিটি। ফাউন্ডেশন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং এর উপদেষ্টা ও পরিচালকেরা স্বেচ্ছামূলকভাবে তাঁদের সেবা দেবেন। ফাউন্ডেশন সমাজের নানা স্তরের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্তি ও সহায়তা লাভে সচেষ্ট থাকবে। মূলত নবীন সমাজের শক্তিতে পরিচালিত হবে এর কার্যক্রম।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত