বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তির লড়াইকে সহযোগিতা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাশে এসে দাঁড়ায়। তেমন একটি উদ্যোগ ছিল ওপার বাংলার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের। যুদ্ধ শুরুর প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ নামে একটি সংগঠন। এর সভাপতি হন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ সেন। কার্যনির্বাহী সভাপতি ছিলেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক পি কে বোস, কোষাধ্যক্ষ উপ-উপাচার্য (অর্থ) হীরেন্দ্রমোহন মজুমদার। সমিতির সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক ডি কে চক্রবর্তী এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন নাচোলের বিদ্রোহের অন্যতম সংগঠক কমিউনিস্ট নেত্রী ও অধ্যাপক ইলা মিত্র, অধ্যাপক এস এন ভট্টাচার্য, অধ্যাপক এস কে মিত্র ও অধ্যাপক এস দাশগুপ্ত।

পাকিস্তানি হামলার পরপরই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশ থেকে সাধারণ মানুষ স্রোতের মতো ভারতে আশ্রয় নিতে থাকে। এই শরণার্থীদের সহায়তা করার মধ্য দিয়েই কাজ শুরু করেছিল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ ধরে বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য ভারতে আরও কয়েকটি সহযোগী সংস্থা গঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি (পুনা), বাংলাদেশ এইড কমিটি (বোম্বে), ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর বাংলাদেশ, বোম্বে ইউনিভার্সিটি কমিটি ইত্যাদি। এ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির বেশ কয়েকটি শাখাও গড়ে উঠেছিল। সমিতির এসব শাখা অর্থ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিত সমিতির প্রধান কার্যালয়ে।

৫ এপ্রিল ১৯৭১ সহায়ক সমিতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তারা বিভিন্ন মহলে বাংলাদেশি শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা তুলে ধরে। জাতিসংঘ, বিশেষ করে ইউনেসকোকে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যপীড়িত শরণার্থীদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসতে আবেদন জানায়। এ ছাড়া সমিতি বাংলাদেশের ওপর বর্বর হামলা ও শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তির দাবিতে কলকাতায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে। সমিতির জ্ঞানেশ পত্রনবিশ এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সমিতির কাজ এগিয়ে নিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। সমিতি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন জানিয়ে উল্লেখযোগ্য সাড়া পায়। সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব অধ্যাপক, খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ও ভারতের জাতীয় অধ্যাপক সতেন্দ্রনাথ বসু। সমিতির ডাকে সাড়া দিয়ে আরও এগিয়ে আসে কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজ, সরোজিনী নাইডু কলেজ, বেথুন স্কুল, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ড. বিধানচন্দ্র রায় ইনস্টিটিউট অব বেসিক মেডিসিন ও বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ছাড়া ভারত চ্যারিটি ট্রাস্ট, প্রেস এজেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড, অ্যালাইড এজেন্সি, প্যাস্টার ল্যাবরেটরিজের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সিদ্ধেশ্বর হোসিয়ারি ফ্যাক্টরি, গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস কলেজ, উমেশচন্দ্র কলেজ, বাংলাদেশ এইড কমিটি (বোম্বে), অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জুটমিলের কর্মকর্তা-কর্মচারী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাবেক অ্যাডভোকেট অজিত কুমার দত্ত, ফাদার পি ফ্যালন, এইচ পি লোহিয়া, অমিতেশ ব্যানার্জী, অধ্যাপক নীরদ কুমার ভট্টাচার্য, অধ্যক্ষ মমতা অধিকারীসহ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

আরও বহু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি সমিতির কার্যক্রমে যোগ দেন। বাংলা গানের তিন কিংবদন্তি মান্না দে, সলিল চৌধুরী ও সবিতা চৌধুরী বাংলা, আমার বাংলা নামে একটি গানের অ্যালবাম প্রকাশ করে তার রয়্যালটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য দিয়ে দেন। এ ছাড়া সমিতির বিভিন্ন প্রকল্পে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিসের থিয়াগরাজন যথাসাধ্য সাহায্য দিয়ে যান। খ্যাতিমান ঐতিহাসিক এ এল ব্যাশামও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কাজ পর্যবেক্ষণ করে মুগ্ধ হয়ে এর কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন।

সহায়ক সমিতির কার্যক্রম পরিচালিত হতো দ্বারভাঙা ভবনে। দিন দিন শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছিল, বাংলাদেশের সাহায্যের দরকারও বাড়ছিল উত্তরোত্তর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনটির ওপর কাজের চাপ ও অর্থের প্রয়োজন বাড়ছিল।

যুদ্ধে বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও অর্থ সংগ্রহের জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সমিতি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশের জন্য সমর্থন আদায়ের জন্য সমিতি ইউরোপে তিনজন বিশেষ দূত পাঠিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ফাদার পি ফ্যালন। তিনি বাংলাদেশ-সংক্রান্ত সর্বশেষ খবর এবং তার সমর্থনে বিভিন্ন প্রমাণ সঙ্গে করে নিয়ে যান। আরেক দূত ছিলেন কলিকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অরুণ কুমার দাস। তিনি নিজ খরচে লন্ডন গিয়ে সমিতির পক্ষে লন্ডনসহ ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালান। ইলা মিত্র ছিলেন আরেকজন দূত। তিনি মস্কোসহ তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক শহর ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের কথা প্রচার করেন। বিদেশে যোগাযোগে সহায়ক সমিতির হয়ে গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন পূর্ণেন্দু নারায়ণ রায়। তিনি যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ ঘুরে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তাঁর সূত্র ধরে ড. অলের নেতৃত্বে নরওয়ের একটি প্রতিনিধিদল কলকাতায় আসে। এ ছাড়া ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড ফেডেরালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক কুড নিলসন এবং জেনেভা ভিত্তিক ডব্লিউএসসিএফ-এর জন বাজ্যাক লাকসিরক কলকাতা আসেন। ৩০ নভেম্বর নিউজিল্যান্ডের ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল কমিটির সম্পাদক ও সহসভাপতি যথাক্রমে আলভিন এফ আর্নল্ড ও ট্রেভন জে ওয়াল্টন সমিতির কার্যালয় পরিদর্শন করেন। আগস্ট মাসের মধ্যেই সমিতি প্রায় দুই শর মতো বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। এসব সংস্থা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্নভাবে কাজ করে।

শুধু ইউরোপ নয়, অক্টোবর মাসে বিশ্বের সব রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রচারের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সে সময় বিশ্বজুড়ে ডাক খরচ বেড়ে গেলেও সমিতি দমে যায়নি। শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো হয় কাবুলে। সেখানে পৌঁছে তিনি খান আবদুল গাফফার খানসহ অন্যান্য আফগান নেতার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থা, বিশেষত শরণার্থী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সমিতির পক্ষ থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়। অনেক শিক্ষককে দেওয়া হয় ভিজিটিং ফেলো হিসেবে নিয়োগের সুযোগ। মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ গঠনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি সক্রিয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে।

শুধু শিক্ষকদের কর্মসংস্থানই নয়, সমিতি মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থীশিবিরগুলোয় ৩১টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। শুধু ভারতের ভেতর থেকে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমিতির কাছে সাহায্য আসতে থাকে।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি মুক্তিবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে সমিতি খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আরও সরবরাহ করে বুট জুতা, মশারি, কম্বল, শীতবস্ত্র, ট্রানজিস্টার ইত্যাদি।

এসব সরাসরি সহযোগিতা ছাড়াও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি চিত্রপ্রদর্শনী ও প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন তৈরির চেষ্টা চালায়। সমিতি ১৯৭১ সালের মে মাসজুড়ে কলকাতায় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবহিনীর গণহত্যা ও অত্যাচারের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। হাজার হাজার দর্শনার্থী প্রদর্শনীতে এসেছিলেন। তারা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হামলা প্রচারের জন্য বেশ কিছু গ্রন্থ ও পুস্তিকা প্রকাশ করে। তাদের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ছয় দফা দাবি, মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: দ্য ট্রুথ, কনফ্লিক্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান: ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যান্ড পাসপেক্টস, বাংলাদেশ থ্রু দ্য লেন্স, বাংলাদেশ: থ্রৌস অব অ্যা লাইফ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, পাকিস্তান অ্যান্ড বেঙ্গলি কালচার ও ব্লিডিং বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সমিতি একটি তথ্যব্যাংকও গড়ে তোলে। তথ্যব্যাংকটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার জন্য গবেষকদের গুরুত্বপূর্ণ রসদ সরবরাহ করে।

শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি, যুদ্ধের পরও এই সমিতি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে পাশে এসে দাঁড়ায়। সমিতির পক্ষ থেকে ড. পি লাহিড়ী, মৃন্ময়ী বসু, অধ্যাপক এ চৌধুরী, জে চট্টোপাধ্যায়, মানস হালদার, অনিল বসু ও সমিতির সম্পাদক অধ্যাপক চক্রবর্তীসহ অনেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে মানুষকে নতুন করে শুরু জীবন যাপন করতে নানা সহযোগিতা দেয়।

সূত্র: ১. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সম্পাদক: রঙ্গলাল সেন, দুলাল ভৌমিক, তুহিন রায়, ইউপিএল, ২০০৯।

২. আমার একাত্তর, আনিসুজ্জামান, সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৩।

আজিজুল রাসেল

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত