বিজ্ঞাপন
default-image

২৫ মার্চ ১৯৭১, পাকিস্তানের অতর্কিত আক্রমণে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি দেন দেশের বরেণ্য শিক্ষক, সংস্কৃতিসেবী, ক্রীড়াবিদসহ সব ধরনের বুদ্ধিজীবীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা হয়ে মে মাসের প্রথম দিকে কলকাতা এসে পৌঁছান। ড. মল্লিক কলকাতায় অনেক বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীকে পেলেন। জ্যেষ্ঠ ও অগ্রণী বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি তাঁদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। গড়ে তোলেন ‘লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সি’ বা ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’।

ড. মল্লিক পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। সহসভাপতি নির্বাচিত হন ড. খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, শিল্পী কামরুল হাসান, লেখক ও সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত। লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম বিলায়েত্ হোসেনকে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এ ছাড়া হাসান ইমাম, সাদেক খান, মওদুদ আহমদ, ড. মতিলাল পাল, ব্রজেন দাস, ওয়াহিদুল হক, আলমগীর কবির, অনুপম সেন, ফয়েজ আহমেদ, এম এ খায়ের, কামাল লোহানী ও মুস্তাফা মনোয়ারকে কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়।

পরিষদের নিজস্ব কোনো কার্যালয় না থাকলেও ড. মল্লিকের প্রথম আবাস পার্ক সার্কাস ও পরবর্তী আবাস সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউয়ে সব সভা ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। তবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ড. মল্লিকের বাসার পাশাপাশি ব্যবহার করা হতো কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের ঠিকানা।

default-image

বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠন করার পর প্রকাশিত একটি প্রচারপত্রে সংগঠনটির প্রয়োজনীয়তা, চরিত্র, কর্মপরিকল্পনা, সদস্যদের পরিচিতি উল্লেখ করা হয়। প্রচারপত্রে বলা হয় যে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা শিক্ষক, বিজ্ঞানী, কবি, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক ও অভিনেতাদের নিয়ে এ পরিষদ গঠিত হয়েছে। পরিষদের লক্ষ্য: ক. বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধোদ্যোগে সমর্থন দেওয়া, খ. স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করা, গ. পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের অপরাধ লিপিবদ্ধ করা, ঘ. মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা এবং ঙ. পরিষদের সদস্যদের জীবনধারণের উপায় উদ্ভাবন করা।

প্রচারপত্রে বিদেশিদের জ্ঞাতার্থে বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি, হানাদারদের নারকীয় তত্পরতা ও গণহত্যার বর্ণনা দেওয়া হয়। সারা বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের কাছে আবেদন করে বলা হয়: ক. বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের জন্য নিজ নিজ দেশে আন্দোলন সংগঠিত করা, খ. আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি উত্থাপনের জন্য সোচ্চার হওয়া, গ. একনায়কত্ববাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধকে সমর্থন করা, ঘ. বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নিজ নিজ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা, ঙ. শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার মুক্তির জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ওপর চাপ প্রয়োগ করা, চ. পরিষদের বিভিন্ন উদ্যোগ সফল করার জন্য আর্থিক সহায়তা করা।

৬ জুলাই ১৯৭১, পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জহির রায়হান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। তাতে জরুরি ভিত্তিতে পরিষদকে আর্থিক ও বস্তুগত সাহায্য প্রদানের আবেদন করা হয়। চিঠির সঙ্গে তাদের প্রচারপত্রটিও যুক্ত করা হয়। আর্থিক সহায়তা পাঠানোর জন্য ড. মল্লিকের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়।

পরিষদ পরবর্তী সময়ে ‘বাংলাদেশে: একটি উপস্থাপনা’ নামে আরেকটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। তাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে মৌলিক তথ্য, সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করা হয়। প্রচারপত্রটি আগের প্রচারপত্রের ধারাবাহিকতা বলা যেতে পারে। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে পরিষদ অপর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। তাতে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন রাখা হয় যেন তারা তাদের সংসদ সদস্য, রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য আবেদন করে।

প্রচারপত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা ছাড়াও পরিষদ আরও কিছু উদ্যোগ নেয়:

ক. ১৩ আগস্ট কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে পরিষদ মিছিল ও সমাবেশ করে। একই দিনে এর সদস্যরা বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি দেন।

খ. ফরাসি সাহিত্যিক ও ভাবুক অঁদ্রে মালরোসহ বেশ কিছু বিশ্ববরেণ্য বুদ্ধিজীবীর কাছে জয়প্রকাশ নারায়ণ আহূত বাংলাদেশ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ’-এ যোগ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে পত্র দেয়। সে চিঠির উত্তরে জহির রায়হানের কাছে মালরো বাংলাদেশের প্রতি সংহতি জানান।

গ. নিজেদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ড. মল্লিক ও পরিষদের অন্য সদস্যরা বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি উল্লেখ করে তাঁদের সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আবেদন রাখেন।

ঘ. পরিষদের শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগীত পরিবেশন করা হয়।

ঙ. স্টপ জেনোসাইড নামে জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

চ. সেপ্টেম্বর মাসে পরিষদ বাংলাদেশের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সিনেটের এডওয়ার্ড কেনেডির কাছে আবেদন রাখে, যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং শেখ মুজিবকে মুক্ত করার জন্য তিনি মার্কিন সরকারকে বাধ্য করেন।

ছ. শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ, সংগীতজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের জন্য আর্থিক সহযোগিতার আয়োজন করে।

জ. স্বাধীনতাযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে।

ড. মল্লিক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:

কলকাতায় এসে আমার প্রথম কাজ হয় বাংলাদেশ কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেনশিয়া গঠন করা। দেশের যেসব বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মী এত দিনে কলকাতায় শরণার্থী হয়েছেন, তাঁদের সংগঠিত করে মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে কাজ করা ছিল এর উদ্দেশ্য।

প্রথম দিকে এই কমিটির কর্মকর্তাদের কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় আমার প্রাক্তন ছাত্রী, সে সময়ে লবেটো কলেজের অধ্যাপিকা ড. পি সি ঘোষের বাসভবনে। তিনি এবং তাঁর স্বামী কমল ঘোষ ব্যক্তিগতভাবেই কমিটির কর্মকর্তাদের আপ্যায়ন এবং সভার আনুষঙ্গিক খরচাদির ব্যয়ভার বহন করতেন। এই বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে নেতাজি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এখানে আমার দুই মেয়ে এমি ও রীণা তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি, মুক্তিযুদ্ধের গতি, শরণার্থীদের অবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগৃহীত হয়। অরূপ চৌধুরীর অফিসও এই পরিষদের কাজে এবং পরবর্তী সময়ে স্থাপিত শিক্ষক সমিতির কাজে ব্যবহার করা হয়। পরে বাংলাদেশের শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে সংগীতানুষ্ঠান ও প্রচারমূলক বক্তব্যদানের ব্যবস্থাও হয় পরিষদের উদ্যোগে। এর কাজে কলকাতার মৈত্রেয়ী দেবী, গৌরী আইয়ুব, বিচারপতি মাসুদ ও অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ মাহমুদ খুব সাহায্য করেছিলেন।

পরিষদের তত্পরতা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় রায় লিখেছেন:

শেষোক্ত দুটি সংগঠন (লেখক সমিতি ও বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেনশিয়া) অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে ১৩ আগস্ট তারিখে শেখ মুজিবের প্রহসনমূলক বিচার বন্ধ ও মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ মিশনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল কলকাতা শহরের নানা সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান করে। এ ছাড়া সে সময় ও সেপ্টেম্বর মাসে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কলকাতার শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করতে এলে আমরা তাঁদের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি প্রদান করি। এসব স্মারকলিপি মুসাবিদা করেছিলাম আমি, জহির রায়হান ও আলমগীর কবির মিলিতভাবে। কেনেডির কাছে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে আমাদের মূল বক্তব্য ছিল, ‘আমরা আপনার কাছে (১) ইউএস সরকারের বাংলাদেশের প্রতি বর্তমান বৈরী মনোভাবের পরিবর্তন সাধনে, (২) নবগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি আদায়ে এবং (৩) বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা ও মুক্তির লক্ষ্যে আপনার সকল ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যবহার করবেন।’

ড. মল্লিক প্রবাসে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন এবং আরও আরও অনেক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকায় অন্য সহসভাপতি ও সম্পাদকেরা—বিশেষ করে জহির রায়হান—পরিষদ পরিচালনায় বেশি তত্পর ছিলেন। পরিষদের কোনো কোনো সদস্যের মধ্যে বাম চিন্তার প্রভাব থাকায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরিষদের সম্পর্ক উষ্ণ ছিল না। তাই পরিষদকে অনেকাংশে নিজেদের উদ্ভাবিত পথেই চলতে হতো। তবে সব শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কলকাতায় এটিই বৃহত্তম সংগঠন হওয়ায় এবং এতে বেশ কিছু প্রবীণ, নিরপেক্ষ ও সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবীর উপস্থিতির কারণে সরকারের পক্ষে পরিষদকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

পরিষদ তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ভারত ও অন্যান্য দেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা দিতে সক্ষম হয়। তাদের উদ্যোগে অঁদ্রে মালরোসহ কলকাতারসহ ও বেশ কিছু বিশ্ববরেণ্য বুদ্ধিজীবী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ অবলম্বন করেন ও বিভিন্ন তত্পরতা চালাতে শুরু করেন।

সূত্র

১. আমার জীবনকথা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, এ আর মল্লিক, আগামী প্রকাশনী, ২০০৭।

২. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, চতুর্থ, পঞ্চম, দ্বাদশ ও পঞ্চদশ খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২।

৩.বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান, সম্পাদক: রঙ্গলাল সেন, দুলাল ভৌমিক ও তুহিন রায়, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২।