বিজ্ঞাপন
default-image

‘প্রিয় বোন, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোত্সর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছে এক হাজার টাকা পাঠানো হলো। আপনি ওই টাকা মহকুমা প্রশাসকের কাছ থেকে সংগ্রহ করুন। আমার প্রাণভরা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।’—শেখ মুজিব।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সই করা ওই চিঠিটি ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আমার কাছে পৌঁছানো হয়। ওই চিঠি আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বামী সরাফত আলীর স্মৃতি নিয়ে আমার একাকী বসবাস। স্বাধীনতার চার দশক পার হচ্ছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চিঠির পর জোটেনি কোনো ধরনের ভাতা। উল্টো ভিটেবাড়ির জায়গা নিয়ে আইনি লড়াই করতে গিয়ে মহাবিপদে পড়েছি। এর মধ্যে তিন মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। এখন আমি হার্টের রোগী। প্রতি মাসে দুই হাজার ৩০০ টাকার ওষুধ লাগে। মেয়ের জামাইদের কাছ থেকে আর কত নেব।

প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর এলে আমাকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের বাসভবনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। গত বছর জানায়নি। তাই মনটা খারাপ হলো। এ বছরের জানুয়ারি মাসে জেলা প্রশাসক ও বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুল মালেক স্যারের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ‘আমি আপনার ব্যাপারে কী করণীয়, তা দেখছি।’ এরপর আর কোনো সাড়া মেলেনি। আমিও ডাক পাইনি। মালেক স্যারও বদলি হয়ে গেলেন।

এতসব দুঃখ আর কষ্টের মধ্যেও যুদ্ধদিনের কথা মনে এলে খারাপ লাগে। ১৯৭১ সালে আমার স্বামী সরাফত আলী নরসিংদী জেলার ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলে ওয়ার্কশপের কাজ করতেন। তিনি যুদ্ধে গেলেন। তখন আমি আমার তিন মেয়েকে নিয়ে মিলের কলোনিতে থাকতাম। তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মমতাজ বেগমের বয়স আড়াই বছর, মেজো মেয়ে ফরিদা ইয়াসমিনের বয়স ১৩ মাস এবং ছোট মেয়ে নাজমা বেগমের বয়স ৩৪ দিন। স্বামী যুদ্ধ করতে গেছেন। আর আমি তিন মেয়েকে নিয়ে ভয়ের মধ্যে দিন পার করছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৬ দিন আগে, অর্থাত্, ৩০ নভেম্বর বিকেল পাঁচটার সময় সরাফত আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ওই সময় কোত্থেকে একদল পাকিস্তানি পাঞ্জাবি এল। কিছু আঁচ করার আগেই সরাফতকে গুলি করে দিল। চারদিকে গুলির আওয়াজ। আমি তিন মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে ঢাকার বেগুনবাড়িতে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠি। ওই ঘটনার ২২ দিন পর এসে দেখলাম, কিছু চুল আর হাড় পড়ে আছে ওই স্থানে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পচে গেছে। এরপর আমার ভাই আর দেবর মিলে আমাদের সেখান থেকে কুমিল্লায় বাবার বাড়ি কালিয়াজুরিতে নিয়ে আসে। সেখানে মেয়েদের নিয়ে আমার বসবাস। যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এক হাজার টাকা ও শুভেচ্ছাপত্র পাই। সেই শুভেচ্ছাপত্রটা আমি আজও সংরক্ষণ করে রেখেছি। যুদ্ধের এত বছর পর একবার কয়েকটি টিন ছাড়া আর কিছু আমার ভাগ্যে জোটেনি।

আসলে আমার জীবনটা ধকলের মধ্য দিয়ে কাটছে। স্বামীর বাড়ি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার শ্রীবল্লভপুর গ্রামে। এক টুকরো বসতঘরের জায়গা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর মামলা পেয়েছি। তখন কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল আমাকে নানা বিষয়ে সহযোগিতা করেছেন। ওই বাড়ির মধ্যে একটা মাটির ঘরে থাকি। মেজো মেয়ের একটা ছেলে আমার কাছে থাকে। এতে কোনো রকমে দিন চলে যায়। বসতভিটায় দুটি ঘর করে ৪০০ টাকা দরে ভাড়া দিয়েছি। এ দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। মেয়েরাও সহযোগিতা করে। এটা দিয়ে ওষুধ কিনি। ২০০৮ সালে স্ট্রোক করার পর থেকে খরচ বেড়ে গেছে।

আমি আসলে সংগ্রাম করে জীবনের পথটুকু পাড়ি দিচ্ছি। কোথায় গিয়ে থামব, বলতে পারি না। আমি চাই, সরকার আমাকে বাঁচিয়ে রাখুক। জামাইদের কাছে আর যেতে চাই না। ওদের সংসার বড় হয়েছে। বাকি জীবনটা আমার সরকার চালিয়ে নিক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা দেখে মরতে পারলে শান্তি পাব।

অনুলিখন: গাজীউল হক, কুমিল্লা