বিজ্ঞাপন
default-image

চর্যাগীতির ভাষাকে যদি আদি বাংলা হিসেবে গণ্য করা যায় তাহলে বলা চলে, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের দোঁহা রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু। ভাষাতত্ত্বের মতে, ‘চর্যার ভাষার সঙ্গে মৈথিলী, ওড়িয়া ও অসমীয়া ভাষার কিছু সমর্ঙ্ক আছে।’ চর্যাপদের রচনাকাল অষ্টম শতক থেকে শুরু, যদিও এ সমের্ক ভিন্নমত রয়েছে। কাল বিচারে তাই আদি বাংলা কাব্যগীতি ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান আদি কাব্য থেকে পিছিয়ে নেই। চর্যাগীতির চরিত্র বিচারে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, চর্যার ভাষা যেমন লৌকিক, তেমনি তাতে রয়েছে বাঙালি জনজীবনের প্রতিফলন, এর অন্তর্নিহিত মানবিক আবেদনও অনস্বীকার্য। আর চর্যাগীতির রচয়িতাদের অধিকাংশই যে ছিলেন নিম্নবর্গীয় শ্রেণীর অন্তর্গত, এ তথ্যের তাত্পর্য গুরুত্বপূর্ণ।

চর্যাগীতির উর্বরকাল পেরিয়ে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ও পদাবলী সাহিত্যে লৌকিক চেতনার পাশাপাশি মানবিক চেতনার প্রকাশও সত্য। পরবর্তী পর্যায়ে ধর্মীয় কাহিনী, পুরাণকথা এবং অনুরূপ কাহিনী কাব্যে সমন্বয়ের মানসিকতা সঙ্ষ্ট, যেমন সঙ্ষ্ট লৌকিক ধর্মবিযুক্ত প্রেমকাহিনীতে মানবিক চেতনার আভাস। এ যুগের সাহিত্য প্রচেষ্টা হিন্দু-মুসলমান কবিদের অবদানে সমৃদ্ধ। বাংলার বাউলসাধনা পূর্বোক্ত মরমিয়া, সহজিয়া ধারার পরিমুক্ত রূপ, যা সামাজিক ধর্মসামঙ্রদায়িক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে মনের মানুষ খুঁজে ফেরার আকুতি নিয়ে গানের তানে সুরে-স্বরে পরস্ফুিট। তাদের মিলন সাধনা যেমন পরমের সঙ্গে তেমনি মানুষে-মানুষে।

উনিশ শতকে পাশ্চাত্য আধুনিকতায় উদ্বুদ্ধ ধর্মসামাজিক নবজাগরণের মধ্যেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনার পাশাপাশি মানবিক চেতনার ধারাও প্রকাশ পায়, যদিও প্রথমটি ছিল অধিকতর শক্তিমান। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তখন একই সঙ্গে বিভাজিত সমঙ্রদায়-চেতনার প্রতিফলন ঘটে। বিশ শতকের প্রথমদিকে সাহিত্যে আধুনিকতার চরিত্রবদল সত্ত্বেও ওই বিভাজন-চেতনা মুছে যায়নি। তবু পূর্বোক্ত ধারাবাহিকতায় সমন্বয়বাদী মানসিকতা সমাজের একাংশে রাজনীতি-সংস্কৃতির চর্চায় প্রকাশ পেয়েছে।

তা না হলে প্রথম বঙ্গবিভাগ (১৬ অক্টোবর, ১৯০৫) পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক স্বার্থের অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও মুসলমান সমাজের কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব আবদুল হালিম গজনভি, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, আবুল হুসেন, লিয়াকত হোসেন, আবুল কাসেম, দেদার বকস, দীন মহম্মদ, ডা. গফুর ইসমাইল, মহম্মদ ইউসুফ বা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ বঙ্গবিভাগ রোধের প্রতিবাদে অংশ নেবেন কেন? হয়তো জাতিসত্তার বিভাজন তারা চাননি।

এ বিষয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়েই বলা যায়, বঙ্গবিভাগের শাসনতান্ত্রিক ঘোষণার আগেই ১৯০৪ সালের ১৮ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী জনসভায় গৃহীত বঙ্গবিভাগ রোধের যে প্রস্তাব সরকারি দরবারে পাঠানো হয়, তাতে মুসলমান স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে নবাব সৈয়দ আমীর হোসেন, নবাব সৈয়দ আবদুস সোবহান, খান বাহাদুর, মোহাম্মদ ইউসুফ, মওলানা শামসুল হুদা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

আরো উল্লেখ্য, ওই বছরই জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে বঙ্গবিভাগবিরোধী জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জমিদার আনোয়ার আলী খান এবং বগুড়ায় অনুরূপ জনসভায় (২২ জুলাই, ১৯০৫) সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় ভূস্বামী সৈয়দ হাফিজুর রহমান চৌধুরী। সর্বোপরি বঙ্গবিভাগের দিন সমন্বিত জাতীয়তার প্রতীক হিসেবে ফেডারেশন হল নির্মাণ এবং স্বদেশী শিল্প ও শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে গঠিত ‘ন্যাশনাল ফান্ড’-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সোবহান চৌধুরী, আবদুর রসুল, আবদুল হালিম গজনভি (অন্যতম সেক্রেটারি) প্রমুখ।

ওই বছরই (২৩ সেপ্টেম্বর) কলকাতার রাজপথে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের বিশাল প্রতিবাদী মিছিল মনে করিয়ে দিতে পারে ঠিক চার দশক পর (১৯৪৫) নভেম্বরে ছাত্র-জনতার মহামিছিলে তিনদলীয় পতাকার ঐক্যবদ্ধ যাত্রা এবং ছিচল্লিশের ফেব্রুয়ারিতে রশীদ আলী দিবস উপলক্ষে অনুরূপ ঘটনা। কিন্তু সেই ঐক্যচেতনা ধরে রাখা বা এর প্রসার ঘটানো যায়নি। বিদেশী সরকারের বিভ্রান্তিকর প্রচার, ঢাকাই নবাব ও তার সঙ্গীদের ভূমিকা এবং কৃষক বনাম জমিদার-মহাজনদের শ্রেণীসংঘাতের মতো প্রতিকূল ঘটনা, রক্ষণশীল মওলানাদের সামঙ্রদায়িক প্রচার ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বদেশীদের বাস্তবিক ভুল-ভ্রান্তি ওই ব্যর্থতার কারণ। এতসব সত্ত্বেও তখনকার ঐক্যবোধের প্রতীকী প্রতিফলনই বোধ হয় ঘটে থাকবে বঙ্গবিভাগের স্বদেশী আবেগে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ সাড়ে ছয় দশক পর স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার মধ্যে।

ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকারগণ চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, কেন দেশের দুই প্রধান সমঙ্রদায়ের মধ্যকার রাজনৈতিক বিভেদ দূর হয়নি, কেন ভূখণ্ড বিভাগ রোধ করা যায়নি। সেসব ঐতিহাসিক সত্যের পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, বিভাজিত স্বতন্ত্র ভুবন তত্কালীন পূর্ববঙ্গে সাহিত্যচর্চায় পাকিস্তানি চেতনার প্রাথমিক আবেগ থিতিয়ে আসতে মোটেই সময় লাগেনি এবং সাহিত্য সৃষ্টির প্রধান ধারা ঐতিহ্যের অবদান হিসেবে রেখেই পথ চলেছে। তাই রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ থেকে তিরিশের বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পীদের প্রভাব সাহিত্যচর্চায় নানাভাবে এসেছে। এমনকি চল্লিশের দামাল দশকে সৃষ্ট সমাজ প্রগতির সংরক্ত আবেগ অবস্থাবিশেষে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।

বিভাগোত্তর সাহিত্য

আসলে পাকিস্তান অর্জনের রাজনৈতিক আবেগ স্বাভাবিক নিয়মেই সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার প্রাথমিক দিনগুলোতে যথেষ্ট প্রভাব রাখে, যদিও তা হয়ে ওঠে স্বল্পকালীন। ওই আবেগের টানে শুরুতে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে সাহিত্য রচনার চেষ্টা চলে, চলে ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে স্বাতন্ত্র্যবাদী জবরদস্তি। এ প্রচেষ্টায় সমঙ্ন্ন ফসলের চেয়ে অপুষ্ট চিটা ফসলের পরিমাণ ছিল বেশি। অবশ্য একই সঙ্গে চলেছে ঐতিহ্যানুসারী ও প্রগতিবাদী সাহিত্যের ধীর পায়ে চলা। প্রধানত কবিতা এবং অংশত কথাসাহিত্যে ওই তত্পরতার প্রকাশ।

কিন্তু পাকিস্তানি রাজনীতির অনাচার ও শাসনতান্ত্রিক ভেদনীতির কারণে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষা আন্দোলন বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে এসে প্রচলিত ধারার অন্ধ অচলায়তন ভেঙে ফেলার কাজ সমঙ্ন্ন করে। এর ফলে রাজনীতিতে যেমন গণতান্ত্রিক চেতনার যাত্রা শুরু তেমনি সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায়, ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে, সর্বোপরি সাহিত্য সৃষ্টিতে আধুনিক চেতনার পথ চলা শুরু। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস তথা ভাষাদিবস পালনের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয় ‘একুশে সাহিত্য’ যেমন প্রায় দুই দশক পর আত্মশাসনের আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেরণায় সৃষ্টি ‘মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য’। দুই দশকের ব্যবধানে দুটো বাঁধভাঙা-বাঁকফেরার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির ক্ষেত্রে গভীর ও তাত্পর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটায়।

একুশে চেতনার আলোকিত পথে নতুন করে যে আত্মপরিচিতির (আইডেনটিটির) অন্বেষা শুরু সে পথ ধরেই পূর্ববঙ্গীয় বাঙালির ভাষিক জাতীয়তাবোধে উত্তরণ আর সেই ধারাবাহিকতায় ঊনসত্তরে গণআন্দোলন, সত্তরে জাতীয়তাবাদের একাট্টা বিজয় এবং তা রক্ষায় একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধ জাতীয় জীবনের জন্য সত্য হয়ে ওঠে। মধ্যবর্তী সময় রাজনীতির অগ্রপশ্চাত্ টানাপড়েনে বিদ্ধ। বাহান্ন থেকে একাত্তর রাজনীতির প্রাধান্য এতটাই তীব্র ও ব্যাপক হয়ে ওঠে যে, এর প্রভাব পড়ে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। সাহিত্যে বিষয়গত দিকটা বড় হয়ে ওঠে, প্রকরণগত পরিচর্যা পিছিয়ে পড়ে। অবশ্য ষাটের দশকের প্রথমদিকে রাজনৈতিক পিছুটানের সময়পর্বে দেখা যায় প্রকরণগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঝোঁক, কবিতায় ও কথাসাহিত্যে। মননপ্রাধান্য ও জৈবযন্ত্রণার ব্যবচ্ছেদ আধুনিকতার সমার্থক হয়ে ওঠে।

কিন্তু ষাটের দশকের শেষদিকে অবস্থা পাল্টে যায়। গণআন্দোলন ও রাজনৈতিক সংঘাতের আবহে কবি-লেখক হয়ে ওঠেন সাংস্কৃতিক যোদ্ধা, কলম হয়ে ওঠে হাতিয়ার। কবিতার চিত্রকল্পে, প্রতীকে একুশের শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া রঙের ব্যবহার তখন কবিদের অতীব প্রিয়, লেখকদের জন্যও প্রিয় অনুষঙ্গ। এভাবেই জাতি পৌঁছে যায় একাত্তরের রণাঙ্গনে। গুলি-বারুদ ও রক্তের আবহ মানুষের মনে এমনি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি জাতি-জাতীয়তার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়। তরুণ কবির আবেগধৃত পঙিক্ত-‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়ে যায়।

বাস্তবেও দেখা যায় তরুণ কবি-লেখকদের হাতে কলমের বদলে স্টেনগান। তখন তারা যোদ্ধা। অন্যদিকে নবীন-প্রবীণ সবার কলমে মাতৃভাষার আবেগ স্বাধীন মাতৃভূতির আকাঙ্ক্ষায় পৌঁছে যায়। নিজ বাসভূমে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা লেখক-শিল্পীদেরও কুরে কুরে খায়। যুদ্ধের পটভূমিতে দুঃসময়ের ছবি আঁকেন কবি-কথাসাহিত্যিক সবাই। সবকিছু একই আবেগে সৃষ্টি, সব সৃষ্টি মিলে যেন একটা বিশালায়তন ক্যানভাসের রূপ নেয়। শহর-নগর-বন্দর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত গোটা দেশই যেন রণক্ষেত্র। আক্রান্ত নিসর্গ, আক্রান্ত মানুষ-নর-নারী-শিশু। এ অবস্থায় তরুণ কবির প্রতিক্রিয়া : ‘ধলপাড়া জেগে ওঠে কিশোরীর ভয়ার্ত চিত্কারে।’

এ জেগে ওঠার পরিণামে প্রতিরোধ ও সংঘাত সর্বজনীন রূপ গ্রহণ করে। বাউল মাটির মমতামাখা স্বদেশের জন্য স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়। ‘নদীর বুকে হাছন-লালনের একতারার গভীর আকুতি’ নিরুপদ্রব করে তোলার তাগিদ অনুভব করেন সর্বস্তরের মানুষ। অবশ্য ব্যতিক্রম পাকিস্তানি ভাবাদর্শে দীক্ষিত গোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিক্রিয়া স্বাধীন বাসভূমির পক্ষে বলেই কৃষকের সংকল্প রূপায়িত হয় আঞ্চলিক ভাষার কাব্যপঙিক্ততে : ‘লাঙল ফেলিয়া বাহে এই হাতে অস্ত্র নিছিলাম ঘরের বাহির হওয়া ঝাঁপ দেই অকূল গাঙেতে।’

স্বাধীনতাযুদ্ধ (১৯৭১) এভাবে বাঙালি জীবনের ঘরে-বাইরে সমান তাত্পর্যে প্রবেশ করে। অকূল গাঙে ঝাঁপ দেওয়া মানুষ সবাই কি তীরে উঠতে পারে? কেউ পারে, কেউ পারে না; যেমন যুদ্ধে, তেমনি ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মিছিলে, তেমনি ঘরবন্দি অবস্থায়ও। এ পারা-না পারার ছবি যুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবতার পাশাপাশি আঁকা হয়েছে কবিতায়, গল্প-উপন্যাস-নাটকে, যেমন যুদ্ধকালে তেমনি যুদ্ধ-উত্তর সময়ে। তাই যুদ্ধ শেষের পঙিক্তমালায় তরুণ কবির বিষণ্ন উচ্চারণ :

‘ছোটভাইটিকে আমি কোথাও দেখি না

নরোম নোলকপরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখি না

কেবল পতাকা দেখি

স্বাধীনতা দেখি।’

এমন রক্তঝরা দুঃসহ বেদনার বিস্তর নেপথ্য ঘটনা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি জাতির সংগ্রাম, বিজয় আর ভালোবাসার চালচিত্র রচনার তাগিদে কবির মনে হয়েছে এসবই ‘রূপোকথা হয়ে বেঁচে থাকবে, পৃথিবীর অনেক প্রাচীন রূপোকথার মতো।’ কবিতার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাসেও ওই ‘রূপোকথা’ রচনার প্রয়াস বাংলাদেশী সাহিত্যের বিশেষ দিক।

বাহান্ন থেকে একাত্তর, এমনকি তারপরও আন্দোলন, প্রতিবাদ ও লড়াইয়ের আবেগ নিয়ে নানামাত্রিক সৃষ্টি কবিতায় এতটাই প্রসাদগুণে ও আয়তনে পরস্ফুিট যে তা প্রমাণ করে, বাংলাদেশে সাহিত্য সৃষ্টির অন্যতম প্রধান মাধ্যম কবিতা, এর পর গল্প-উপন্যাস-নাটক। একটি ভাষিক জাতিসত্তার আত্মিক ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ঐতিহাসিক প্রকাশ সর্বাধিক ঘটেছে কবিতায়। হয়তো তাই সংকটে, সংগ্রামে, পরিত্রাণে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ থেকে সুভাষ-সুকান্ত অনেকের কবিতা ঐতিহ্যধারায় উদ্দীপক সঙ্গী। বাংলাদেশের সাহিত্যে তাই সার্বিক বিচারে রাজনৈতিক আবেগের প্রভাব ও প্রাধান্য এক স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলাদেশকে ঘিরে পরস্ফুিট এ আবেগের অংশীদার হয়েছেন তত্কালীন একাধিক পশ্চিমবঙ্গীয় নবীন-প্রবীণ সাহিত্যিক। তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ আবেগে তাড়িত হয়ে বিষ্ণু দে লেখেন :

‘জ্যেষ্ঠ, তোমরা গড়ে দিলে প্রতিভাস

তাই আমাদের গঙ্গার চরে চরে

মেঘনার স্রোতে গড়ে তুলি ইতিহাস।’

জাতিচেতনা, সমাজচেতনা ও শ্রেণীচেতনাজারিত বিষ্ণু দে’র কবিতা সংকলন রবিকরোজ্জ্বল নিজদেশে প্রবীণ কবির ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ থেকেই প্রকাশিত হয়।

স্বাধীনতা-উত্তর সাহিত্য

কিন্তু রবিকরোজ্জ্বলতার স্বপ্নপূরণের ক্ষেত্রে বাস্তবে অনেক সমস্যা-সংকট দেখা দেয় মূলত রাজনৈতিক-সামাজিক নৈরাজ্যের কারণে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ও হতাশা সমাজ ও সাহিত্যে সমান তীব্রতায় ফুটে ওঠে, তবে সাহিত্যে এর প্রকাশ ইতি ও নেতির বৈপরীত্যে। যেমন কবিতার সুচারু পঙিক্ততে তেমনি রূঢ় ছত্রে। ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাব’ কবিতা মনে না করা হলেও মুক্তিযোদ্ধা কবির এ রচনাটি শিক্ষিত মহলে সাড়া জাগায়। জানি না বিভাগোত্তর পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক-সামাজিক নৈরাজ্য ও সহিংসতার পটভূমিতে কবি বিমল ঘোষের লেখা ‘রামরাজ্যের প্রথম বলি অশোকবনের সীতা’ কতটা সাড়া জাগিয়েছিল।

বাংলাদেশে এরপর অভাব, সংকট, নিরাপত্তাহীনতা ও নৈরাজ্য যত বেড়েছে, অস্থিরতা যত ব্যাপক হয়েছে, পরবর্তী দশকগুলোতে নাগরিক সমাজের একাংশ সুশীলসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যত সোচ্চার হয়েছে কবিতা ওই নানামাত্রিক প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ধারণ করেছে। একই সঙ্গে ওই প্রতিক্রিয়ার টানে ক্ষুব্ধ হতাশায় কবিতা ব্যক্তিচেতনার বৃত্তে প্রাকরণিক চর্চায় ফিরে যেতে চেয়েছে। এদিক থেকে নয়া প্রজন্ম আগ্রহী। জীবন-বাস্তবতার চেয়ে মনোগহনের রহস্য বিশ্লেষণের প্রবণতা এদের মধ্যে সর্বাধিক। অন্যদিকে কারো কারো আগ্রহ লোকজ ঐতিহ্যকে আধুনিকতার রূপচিত্রে তুলে ধরা, প্রতি-রোমান্টিকতা বা প্রতিকবিতার চর্চায় মগ্ন হওয়া। আশার কথা যে, সামঙ্রতিক কবিদের অনেকের বিশ্বাস আবেগ ও মননধর্মিতা, ব্যক্তিচেতনা ও সমাজচেতনার সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে কবিতার সত্য প্রকাশ পেতে পারে।

প্রসঙ্গত, এই দীর্ঘ সময়ে ব্যবহূত কাব্যভাষা সমের্ক এক কথায় বলা যায়, বাহান্ন থেকে এ তাবত্ কবিতার ভাষা ও শব্দ ব্যবহার ক্রমশ রক্ষণশীলতা অতিক্রম করে সময়ানুগ ও আধুনিকতার উপযোগী হয়ে উঠেছে; আঞ্চলিক শব্দ, অচেনা নতুন শব্দের লাগসই ব্যবহার বেড়েছে। কবিতার শিল্পরূপের ক্ষেত্রে এদিকেও নতুনত্ব বা অভিনবত্বের পথে পা বাড়ানোর চেষ্টা চলেছে।

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে গ্রামীণ জীবন ও আঞ্চলিক জীবনের সঙ্গে উঠতি মধ্যশ্রেণীর সমস্যা সংকটের যে চিত্রণ বিভাগোত্তর সময় থেকে শুরু তাতে বাহান্ন-উত্তরকাল থেকেই রাজনৈতিক প্রতিবাদের উত্তাপ যুক্ত হয়। ষাটের দশকের বেশ কিছুটা সময় পূর্বোক্ত কারণে কথাসাহিত্যও আত্মারতিতে মগ্ন থাকার পর রাজনীতিসংশ্লিষ্ট জীবনযুদ্ধের ব্যক্তিক ও সমষ্টিগত রূপ নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিষয়াদি ঘিরে।

ছোট গল্পে যে শৈল্পিক যাত্রা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’তে ব্যক্ত ছিন্নমূল জীবনের মানবিক ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে শুরু সে মানবিক চেতনা নানা হাতে নানা রূপে বিকশিত। কখনো তা স্যাটায়ারধর্মী তির্যক প্রকাশে, কখনো শহুরে বা গ্রামীণ জীবনের দুস্থরূপে কিংবা রোমান্টিক বা মননধর্মী আলেখ্যচিত্রণে গল্পের শিল্প হয়ে উঠেছে। ষাটের দশকের প্রথমদিকে যৌনতার শল্যচেরা চিত্রণপ্রচেষ্টা পেরিয়ে পরবর্তী কয়েক বছর, বিশেষত সত্তর-একাত্তরে জীবনযুদ্ধের নানামুখী যন্ত্রণা বা স্বদেশী বন্দিশিবির ছেড়ে অসহায় উদ্বাস্তু জীবনের ট্র্যাজেডি এবং যুদ্ধ শেষে ফিরে আসার পরও নিরাপত্তার অভাব বা ক্ষুধা মেটানোর তাগিদে লড়াই গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া স্বাধীন স্বদেশেও দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য, ক্ষুধার তাড়না, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে অসহায়তা, ভোগবাদের আধিপত্য, গ্রাম-নগর পারাপার গল্পকারদের হাতে নানাভঙ্গিতে ছবি হয়ে উঠেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঘরে ফিরে ছাওয়াল-মেয়ার হাত ধরে এঘাট-ওঘাট চষে বেড়ানো এজন রামশরণের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ‘স্বাধীনডা কি, অ্যাঁ, স্বাধীনডা কোঁয়ানে’ যেমন শৈল্পিক সত্য হয়ে ওঠে তেমনি সত্য হয়ে ওঠে চেনাজানা পরিবেশেও গদ্যময় ক্ষুধার তাড়নায় বৃদ্ধ ইমান আলীর অমানবিক মৃত্যু।

আবারও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। লালসালুই (১৯৪৮) প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে আধুনিক উপন্যাসের শিল্পসার্থক যাত্রার পথ প্রশস্ত করে। এতে ধর্মীয় সংস্কারবদ্ধ গ্রামীণ মানস এবং গ্রামের আর্থ-সামাজিক শোষণের নানামাত্রিক রূপ উদঘাটিত। লেখকের পরিপূরক মন্তব্য সঠিক যে, ওই পরিবেশে ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি।’ পাশাপাশি আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়ী (১৯৫৫) পূর্ববঙ্গের নিম্নবর্গীয় জীবনের নিপুণ শিল্পরূপ, কিন্তু এর পটভূমি পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে দেশবিভাগকালে সীমাবদ্ধ। পরবর্তী এক দশকের উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনের রূপ সময় ও সমাজের দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

পাশাপাশি উঠতি মধ্যবিত্ত মানসের আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সংকট ও আত্মজিজ্ঞাসা মূলত ষাটের দশকের উপন্যাসে পরস্ফুিট। নিয়তিনির্ভরতা ও অধ্যাত্মচেতনার স্থান দখল করেছে ব্যক্তি জীবনবোধ, সমাজ ও স্বাধীনচেতনাবিষয়ক সত্য ও মূল্যবোধ। শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২) যেমন ব্যক্তিমানসের স্বাধীনতাসঙ্ৃহার প্রতীক তেমনি বাংলাদেশী উপন্যাসের শৈল্পিক সার্থকতার প্রতিনিধি। এ দশকেই ব্যক্তিসত্তার মুক্ত চেতনার পাশে ব্যক্তিমানসের বিচ্ছিন্নতাবোধ ও আত্মদাহের চিত্রণও উপন্যাসে স্থান পেয়েছে, যেমন রাজিয়া খানের বটতলার উপন্যাস (১৯৫৯)। আইউবি আমলে শিক্ষিত শ্রেণীতে নাগরিক চেতনা উদ্ভাসের সঙ্গে অর্থনৈতিক টানে সৃষ্ট আত্মিক স্ববিরোধিতা ও জটিলতাও উপন্যাসে প্রকাশ পেয়েছে। ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসা ও অন্তর্নিহিত আত্মিক সংকটের আধুনিক রূপ কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)। আশ্চর্য যে, এ আধুনিক শিল্পকাহিনীর পটভূমিও গ্রাম।

এ ধরনের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও বাংলাদেশী উপন্যাসের প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে রাজনৈতিক পটভূমি ও কাহিনীতে। যদিও পটভূমি আবারও গ্রাম, তবু শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক (১৯৬৫) সময়চেতনা ও জীবন চেতনা নিয়ে বাঙালির রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সার্থক রূপচিত্র এঁকে তুলেছে। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলন যে বাঙালিচেতনার মর্মমূলে কতটা শক্তি মান উপকরণ হিসেবে সক্রিয় তা প্রকাশ পায় আরেক ফাল্গুন উপন্যাসে।

কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রাম তথা স্বাধীনতাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি ও সমাজজীবনের রূপচিত্রণই উপন্যাসে প্রধান হয়ে থেকেছে। এ বিষয়ে লেখা বহু উপন্যাসের মধ্যে শওকত ওসমানের জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১) প্রতিনিধিস্থানীয় রচনা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্ত মানসের আত্মদ্বন্দ্ব ও তেপান্তরের বাস্তবচিত্রণ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬)। মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ব্যক্তি, সমাজ ও রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে একাধিক লেখকের হাতে নানা ব্যঞ্জনায় প্রকাশ পেয়েছে বহুসংখ্যক উপন্যাস, যা আলাদা করে উল্লেখ প্রায় অসম্ভব।

পরবর্তী দশকগুলোতে আবেগ থিতিয়ে ঘোলাস্রোত স্বচ্ছ হয়ে ওঠার পর উল্লিখিত লেখকদেরই কারো কারো হাতে চিত্রিত হয়েছে ব্যক্তি ও সমাজজীবনের অন্তর্নিহিত সত্যাসত্যের বিচিত্র জটিলতা ও দ্বন্দ্বের স্বরূপ। প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক অবক্ষয় ও নষ্ট মূল্যবোধের জবানবন্দি, হঠাত্ বিত্তবান শ্রেণীর অনাচারের ইতিকথা। মধ্যশ্রেণীর আত্মরতি ও আপসবাদিতার চিত্রও চিত্তাকর্ষী হয়ে উঠেছে। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে না-পারা মানুষ যেমন ক্ষুব্ধ সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তেমনি ওই ক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত লেখকও প্রতিবাদী রচনার পরিবর্তে মনোযোগী হন ব্যক্তিচরিত্রের রহস্যময় মনোগহনের অন্বেষায় ও বিশ্লেষণে। আধুনিক পাশ্চাত্যের নব্যশিল্পাদর্শ তাদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে।

অন্যদিকে আঞ্চলিক সমাজ ও জীবনবৈচিত্র্য রূপায়ণের দিকেও কারো কারো ঝোঁক লক্ষ করা যায়। নদীমাতৃক দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় জীবনে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। এতে আদিমতার প্রকাশও ঘটে। এ ছাড়া প্রাচীন ইতিহাসও পুরাণকথার আধুনিক বয়ানে চর্যাপদের চরিত্র থেকে চাঁদবেনে বা বৌদ্ধ সামন্ত উপন্যাসের নায়ক হয়ে ওঠে। লোককাহিনী, গাথা বা আদিবাসী জীবনও লেখকদের আকর্ষণ করে। এমনকি লেখা হয় আয়না বিবির পালা নিয়ে আধুনিক সময় ও সমাজ-পরিবেশে।

সবদিক বিচারে বলা চলে যে, বাংলাদেশের সাহিত্য চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে যতটা ব্যক্তিমনস্তত্ত্ব সংশ্লিষ্ট, তুলনায় অনেক বেশি জাতীয় জীবনের তরঙ্গবিক্ষোভ ও জোয়ারভাটার টানাপড়েননির্ভর। সাহিত্য ও রাজনীতির পারসিরকতা এক আবেগনির্ভর সত্য। সত্য সংস্কৃতিচর্চার আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও। এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক বাস্তবতা, যে বাস্তবতার টানে ভাষা, ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠী একই রাজনৈতিক আবেগের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পাক শাসক শ্রেণীর অদূরদর্শী আচরণ ওই আবেগ তৈরিতে সাহায্য করেছিল। বিশেষত বাঙালির মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি বিরূপতা প্রদর্শন করে, নজরুলকে খণ্ডিত করে, রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা ও রবীন্দ্রবিষয়ক অনুষ্ঠানাদির বিরোধিতা করে, সর্বোপরি ভাষিক ঐতিহ্যের শেকড় কাটার চেষ্টা করে। প্রতিক্রিয়ায় সাহিত্যের মতো, রাজনীতির মতো সংস্কৃতিচর্চাও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।

ওই প্রতিবাদী ধারাতেই অনুষ্ঠিত হয় বাহান্নর আগস্টে কুমিল্লায় সংস্কৃতি সম্মেলন, যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর চুয়ান্নতে ঢাকায় অনুরূপ বিশাল সম্মেলন, ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলে মহাসমারোহে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি সম্মেলন। এগুলোতে সঙ্ষ্ট হয়ে ওঠে অসামঙ্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিচেতনার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সুর। কুমিল্লা সম্মেলনের বৈশিষ্ট্য ছিল বিজন ভট্টাচার্যের জবানবন্দী নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-ইকবালের গান, লোকসঙ্গীত এবং রমেশ শীলের যুদ্ধ ও শান্তি শীর্ষক কবিগান। টাঙ্গাইল (কাগমারি) সম্মেলনে গণতান্ত্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতি চেতনার সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিক শান্তিচেতনার প্রেক্ষাপটে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরোধিতা উত্তাপ ছড়ায়।

অন্যদিকে ঢাকা সম্মেলনে বাংলা সাহিত্যের আবহমান ঐতিহ্য ও আধুনিক প্রগতিবাদী চেতনা, দেশহিত, বিশ্বশান্তি ও মানবতার আদর্শ আলোচনায় প্রাধান্য পায়। সেখানে রমেশ শীলের প্রতিবাদী কবি গান, লোকগীতির মরমি মাধুর্য এবং রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-ইকবালের গানে যে বৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটে, তাতে চমক জাগায় সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব লায়লা সামাদের উদাত্ত আহ্বান ‘ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এসো নারী’ যা তখন স্থানীয় সামাজিক পরিস্থিতিতে ছিল খুবই প্রাসঙ্গিক। পুরুষশক্তির আরোপিত আদিম নারীর বন্দিদশার প্রতীক আধুনিক নারীর নোয়া (লৌহবলয়) পরিধানের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।

সেসব অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে মঞ্চনাটক ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের সমস্যা নিয়ে যুক্তিবাদী ও প্রতিবাদী ধারায় দৈশিক ঐতিহ্য ও আন্তর্জাতিক প্রগতির প্রভাব জারিত হয়ে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। এই সাফল্য সমাজ পরিবর্তনের আদর্শ নিয়ে পথনাটকে প্রসারিত। এভাবে বাংলাদেশের নাট্যাভিনয় নিজস্ব ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে।

সাহিত্য ও রাজনীতির পারসিরকতা প্রসঙ্গের জের টেনে সবশেষে বলতে হয়, এর অনুকূল প্রতিকূল দুদিকই বিচার-ব্যাখ্যার দাবি রাখে। সুশীল রাজনীতির প্রভাব সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাকে শুদ্ধতার দিকে এগিয়ে দেয়, কিন্তু রাজনৈতিক দুঃসময় তাকে পিছে টানে। আপাতত বিচারে যুক্তির চেয়ে আবেগের টান শক্তিমান হলেও তা সাময়িক, যদিও সে কখনো দ্রুত গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু যুক্তির নিরাসক্তি নৈর্ব্যক্তিক মননধর্মিতার গুণে সার্থক শিল্প সৃষ্টিতে সহায়ক হয়ে থাকে। সময় ও ইতিহাস কখনো কখনো ব্যক্তিমানসকে সদর্থক পাঠ দিয়ে থাকে, দেয় শিল্পীসত্তাকেও। হয়তো তাই রাজনৈতিক-সামাজিক নৈরাজ্যের মধ্যেও একালের কোনো কোনো সাহিত্যকর্মী তাঁদের শিল্পাদর্শে যুক্তি ও আবেগ, হূদয় ও মননের সমন্বয় ঘটানোর পক্ষপাতী। আধুনিকতার নানা তত্ত্বে ভর দিয়ে সাহিত্য সৃষ্টিতে সেসবের প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট। এতে সুফল কতটা মিলবে একমাত্র ভবিষ্যত্ সময়ই তা বলতে পারবে।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত