বিজ্ঞাপন
default-image

আমি একজন ঘাতক। আইনের দিব্যদৃষ্টি থাকলে আমার ফাঁসি হতে পারত, গ্যাস চেম্বারে মৃত্যু ঘটতে পারত, নির্মম শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দেওয়া শাস্তির মতো মর্মান্তিক কিছু মাথা পেতে নিতে হতো। আমারও মৃতু হতো নিঃসন্দেহে।

কোপারনিকাস, সক্রেটিস বা মহান যিশুর মতো গৌরবের শাস্তি আমার জন্য নয়। নিষ্ঠুর হত্যাকারীর সহানুভূতিহীন কলঙ্কিত মৃত্যুই আমার জন্য নির্ধারিত হতো। কিন্তু আমি জানি, তা হবে না। কারণ আমি সভ্যতা নামক এক অদ্ভুত পর্দায় ঘেরা কপট পৃথিবীর অধিবাসী।

আমার বন্ধু বেলালকে আমি হত্যা করেছি, অত্যন্ত সুকৌশলে, অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে। ওর শরীরে একটা আঁচড় পর্যন্ত না দিয়ে কী চমত্কারভাবে ওকে আমি মেরে ফেলেছি।

অথচ আমরা কী প্রচণ্ড বন্ধু ছিলাম, সেই ছেলেবেলা থেকে। আমাদের বাড়ির পাশের মাঠটায় ঝাঁকড়া শিরীষ গাছের ওপর ভাঙা ভাঙা আকাশে হঠাত্ করে যখন শরতের নীল দেখা দিত, যখন আশ্বিন এসে পড়ত, ঘাসের ডগায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঝিকমিক করত শিশিরের বিন্দু, আর দূরে কালির বিলে চক্রাকারে উড়ত গাঙচিল, কোড়াল, তখন সেই হঠাত্ খুশির মতো সকালে আমরা দুই বন্ধু একই সাইকেলে চড়ে মফস্বল শহরের সীমানা ছাড়িয়ে যেতাম, কাঁচা রাস্তা ধরে চলে যেতাম অনেক দূরে। আমরা গলা ছেড়ে গান গাইতাম, প্রাণখুলে হাসতাম।

কিন্তু দেড় যুগ পরে আমার হাসিকে নির্বাসন দিয়ে আমি বেলালকে-আমার সেই প্রিয় বন্ধুকে মনের আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছি কত...কতবার। করেছি শুধু তমার জন্য। হ্যাঁ, তমার জন্যই।

তমা নামের সরল চোখের সুন্দরী মেয়েটির দৃষ্টি যখন নুয়ে-পড়া হাস্নাহেনার ঝাড়ের মতো সুরভি ঢেলেছে বেলালের দিকে, শুধুই বেলালের জন্য। তখন আমি তমাদের বসার ঘরের আড্ডায় সিগারেটের ধোঁয়ার মেঘ, হাসির গমগমে শব্দ, চায়ের পেয়ালায় ঝড় উপেক্ষা করে স্থির দৃষ্টিতে কেবল বেলালকেই দেখেছি। ইচ্ছে হয়েছে নিওল্যাথিক যুগের গুহামানবের মতো ওকে উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে ছুড়ে ফেলতে, পাথরের চাঙড়ে বিচূর্ণ করতে। ইচ্ছে হয়েছে, প্রস্তর যুগের বর্শার ফলকে ওকে বিদ্ধ করতে। ওর প্রতি আমার বিদ্বেষকে পজেটিভ ছবির মতো সজীব করে তুলতে পারলে সেই মুহূর্তে আমি ধন্য হই। আমি তখন ভুলে যাই, আমরা দুজন এক জ্যোত্স্না রাতে ইছামতী ডাকবাংলোতে পাশাপাশি বসেছিলাম, চিকচিকে রুপালি একটা নদীকে সামনে রেখে, সারা রাত শুনেছিলাম বাতাসে শালপাতা ঝরার শব্দ। সেসব ভুলেছি আমি, ভুলেছি তমার জন্য। তমা, হ্যাঁ, তমাই। ওকে নিঃশব্দে কতবার বলি, ‘তুমি তমা নও, তুমি প্রিয়তমা, শুধু আমারই। আমার নিঃশব্দ সংলাপের উচ্চারণ ওকে কখনো ছুঁয়ে দেয় না; ও জানে না ওর জন্য আমি ঘুমোতে পারি না, ওর সুন্দর মুখের আদল সারাক্ষণ আমার বুকে ঝড় হয়ে বইতে থাকে, ওর চমত্কার শরীর আমার জেগে থাকা রাতে ভূমিকমেঙ্র অস্থিরতা আনে। ও বোঝে না, বোঝে না হামবাগ বেলালটাও। কিন্তু কেন বোঝে না! ওর তো অত বুদ্ধি! ও তো এক বুদ্ধিদীপ্ত ধারালো যুবক! ও কবিতা লেখে, কবিতা বোঝে, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামায়, ইউটোপিয়ান সোশ্যালিস্টরা এখনো ওর মাথায় কিলবিল করে, পুঁজিবাদী পৃথিবীর বিরুদ্ধে ও সোচ্চার হয়ে কার্ল মার্কসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে, বিশ্ব রাজনীতি ওর নখদর্পণে, অথচ আমার বুকের সার্বক্ষণিক দাউ দাউ আগুনের তাপ ও অনুভব করে না। ও যেন এক আত্মমগ্ন নার্সিসাস।

আমাদের আড্ডার আসরে তর্কের ঝড়ে ও যখন নেতার ভূমিকায় নামে, কথার চুম্বকী ভঙিতে সবাইকে চমকে দেয়, ওর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসকে তখন আমি ঘৃণা করি। প্রচণ্ড ঈর্ষা তখন বিষাক্ত সাপের ফণা তোলে আমার বুকে।

এক হাতে চায়ের পেয়ালা, আর এক হাতের আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে ও যখন বলে-এ পৃথিবী এখনো মার্কসের মুখাপেক্ষী। বলে, পৃথিবী এখনো শ্রেণীবিভক্ত। ধনী দেশ-দরিদ্র দেশ, ধর্ম-অধর্ম, অস্ত্রধারী-নিরস্ত্র, বিচার-বিচারহীনতা এসব কি শ্রেণী-সংগ্রামের বীজকেই উপ্ত করছে না?

তারপরই যখন শুদ্ধ উচ্চারণে, ঠিক কবিতার মতো করে উদ্ধৃত করে-‘দি হিস্ট্রি অব অল হিটারটো এক্সিজটিং সোসাইটি ইজ দ্য হিস্ট্রি অব ক্লাস স্ট্রাগল বিটুইন ফ্রিম্যান অ্যান্ড ্প্যাভ, প্যাট্রিশিয়ান অ্যান্ড প্লিবিয়ান...’

আমি তখন কেবল তমাকেই দেখি। হাতের তালুতে গালের একটা পাশ চেপে রাখায়, ফর্সা গালে লাল বৃত্তটা কী চমত্কার গোলাপ হয়ে ফুটে উঠেছে। ওই লালফুলে ঠোঁট ছোঁয়ানোর তীব্র ইচ্ছায় আমি অস্থির হই, আড্ডার সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই। তমার ওপর অভিমানে গলে গলে পড়ে যায় সব উিক্ষপ্ত আগুন! ও তো আমার পাশে এসে বসতে পারে, আমার কাঁধে ওর কোমল হাতটি রেখে বলতে পারে-আপনি যে চা খেলেন না! ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কখন, বদলে দেব?

বলতে পারে-আপনিও বুঝি আপনার বন্ধুর মতো পৃথিবীর সব খবর রাখেন? ওর মতো সারারাত জেগে পড়াশোনা করেন বুঝি?

তমা ওর গোলাপ কুঁড়ি আঙুল আমার কোলের ওপর মেলে ধরে বলে উঠতে তো পারে-আপনিও কি বেলালের মতো হাত দেখতে জানেন? প্লিজ, আমার হাতটা দেখে দিন না! অথচ বেলালটা এসবের সুযোগই দেয় না। আমার চায়ের পেয়ালায় চা ঠাণ্ডা হয়ে পানি হয়, হাতের সিগারেট পুড়তে পুড়তে তাপদগ্ধ করে আঙুলকে, তমাও এসব খেয়ালই করে না। বেলাল যেন এক আশ্চর্যতম বাঁশিবাদক। আর তমার মুগ্ধ দৃষ্টি তার জাদুর সুরে সম্মোহিত।

তমাদের বাড়ির আড্ডা থেকে বেলালের সঙ্গেই ফিরি। বেলাল ওর গাড়িতে আমাকে লিফট দেয়, সারা পথ অক্ষম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুড়তে থাকি। বেলালের অনেক গুণ। ও সুদর্শন, বরাবর ভালো ছাত্র। ভালো পাসের গুণে পাস করার সঙ্গে সঙ্গে ডিপার্টমেন্টেই হয়েছে ওর চাকরি। বেলাল কবি, ওকে সবাই চেনে, মানে। সবাই ওকে পছন্দ করে, আমিও করতাম। কিন্তু ও তো জানে না, তমার সঙ্গে যেদিন আমি ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম, আর তমা ভীষণ উচ্ছ্বাসে বলে উঠেছিল,-কী সৌভাগ্য! আপনার সঙ্গে তাহলে পরিচয় হলো! আপনার কবিতা আমার কী যে ভালো লাগে! তমার চোখের অন্য রকম খুশির আলো সেদিন আমাকে বেলালের গুণমুগ্ধতা থেকে সহস্র যোজন দূরে ছুড়ে দিয়েছিল। তমা কি সেটা বুঝেছিল? হয়তো! তমার ওপরেই রাগ হয়েছিল। মেয়েরা কী আশ্চর্য প্রজাপতি! নতুন সৌরভে এক পলকে উড়ে গিয়ে রঙ ছড়াল অন্য ফুলে। আমাকে পাখার ঝাপটায় সরিয়ে দিল।

আমি কবিতা লিখি না, বিশ্বসাহিত্য জানি না, রাজনীতি আমার ভালো লাগে না। সুন্দর কথা বলার জাদু দিয়ে মেয়েদের মুগ্ধ করতে পারি না, তবুও তো আমরা বন্ধু ছিলাম, পরসেরর বিশ্বস্ত ছিলাম, আমি আর বেলাল। অথচ এখন অক্ষম হিংসায় তমাকে নয়, বেলালকেই ধ্বংস করতে চাই।

বেলালের গাড়িতে ফিরতে ফিরতে নিঃশব্দে সিগারেট পোড়াই। আড়চোখে বেলালকে দেখি, গাড়ি চালাতে চালাতে গান গাইছে মৃদু সুরে। আজ ওর মন খুব ভালো। আমি জানি, আজ বিদায় দেওয়ার সময় তমা ওর মুখটা কয়েক পলকের জন্য আলগোছে রেখেছিল বেলালের বুকে। দেখছিলাম, একটু দূরে দাঁড়িয়ে, তমার তাতে সংকোচ ছিল না।

রাস্তার দু ধারে বিপণির লাল-নীল আলো ্পো মোশন ছবির মতো সরে যাচ্ছে। বেলাল সাবধানী গাড়িচালক। গান থামিয়ে মুখ ফেরায়-কী রে গোমরা হয়ে আছিস যে! কী হয়েছে? প্রশ্নটা এড়িয়ে যাই, রুক্ষ কণ্ঠে বলে ফেলি-গাড়ি তো চালাচ্ছিস না, যেন গরুর গাড়িতে চলেছি। নিজের কণ্ঠের রুক্ষতায় তৃপ্তি পেলাম। অবাক হয় বেলাল-গাড়ি চালানোতে আবার কী দোষ পেলি!

জানিস তো রাশ ড্রাইভিং পছন্দ নয় আমার। উইন্ডোস্ক্রিন দিয়ে রাতের আকাশ দেখি, বলি-কবিতা লিখে লিখে একটা মিনমিনে পুরুষ মানুষ হয়ে গেছিস। ম্যানলিনেস চরিত্রে থাকলে তো গতি আসবে! বেলাল শব্দ তুলে হাসে। হাসিটাই ওর আত্মবিশ্বাসের সৌরভ। সেটাই আমাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে-মেয়েদের মতো সাবধানী লোকদের আমি পুরুষ ভাবতে পারি না। যতই তোর গুণ থাকুক না, আসলে তোর সাহস কম।

বেলাল প্রতিক্রিয়াহীন, অান হাসে। যেন আমার অভিযোগ ওর কাছে একেবারেই নিরর্থক। হাতের সিগারেট গাড়ির অ্যাস্ট্রেতে পিষে দিয়ে চিত্কার করে উঠি-হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। তোর সাহস কম, তুই একটা ভীতু মেয়েলি পুরুষ।

বেলাল নির্বিকার। অবিচল নির্ভাবনার প্রশান্তিতে নিরাবেগ, গাড়ির গতির ভারসাম্য অপরিবর্তিতই রাখে। আমার বাড়ির গলির মুখে মসৃণভাবে সিঙ্ড কমিয়ে আনে, ঝুঁকে দরজা খোলে, শান্ত কণ্ঠে বলে-নাম, তোর গন্তব্য এসে গেছে।

জ্বলতে জ্বলতে বাড়ি ফিরি। বেলালকে শতবার ধ্বংস করি মনে মনে। এত উদ্বেগহীনতা, নিজের ওপর এত বিশ্বাস ও কেমন করে, কোথা থেকে পেল! নিজের ওপরেই রেগে উঠি। ধিক্কার দিলাম নিজেকে। ছেলেবেলা থেকে আমার প্রশংসা, উত্সাহ আর আমার আন্তরিকতাই ওর আত্মবিশ্বাসের ভিতকে মজবুত করে দিয়েছে। আমি তো ওকে সারাক্ষণ বলতাম-বেলাল তুই একটা জিনিয়াস। আমার প্রশংসা যে বেলালকে গড়ে তুলেছে, সেই এখন ছিনিয়ে নিয়েছে তমাকে, সে এখন আমার শত্রু। আমি তো পারি না তমাকে জোর করে দু বাহুর মধ্যে বন্দি করতে। বলতে পারি না-তমা, তুমি তো আমার। তোমাকে আমি আর কারো হতে দেব না। তোমার জন্য আমি সব করতে পারি।

অন্ধকার গলিতে একটা ঘুমন্ত কুকুরকে জাগিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠি। নিজেকে মুহূর্তে মনে হয় দুর্ধর্ষ চেঙ্গিস খান। তরবারি উঁচিয়ে তেজি ঘোড়ার খুরে বিদ্যুত্ ছিটিয়ে ফিরছি প্রিয়া হরণ করে। যেন শক্তিমত্ত দশানন রাবণ আমি, বনবাসিনী সীতা আমার বাহুবলে বন্দিনী। ভুলে যাই, টেনেটুনে ব্যাচেলরস ডিগ্রি পাওয়া, এক ওষুধ কোমঙ্ানির অল্প মায়নার চাকুরে মাত্র আমি, আর কিছু নই। তবু আমি তমাকে চাই। তমাকে এক দিন না দেখলে রাতে আমার ঘুম আসে না, ছটফট করি। সিগারেটের আগুনে বিছানার চাদর পুড়িয়ে ফেলি। উিক্ষপ্ত হয়ে খেতে বসে ভাতের থালা ছুড়ে ফেলি, গোবেচারি মাকে অনর্থক গালাগাল দিই।

তমাদের ড্রইংরুমের আড্ডা সাপের নিঃশ্বাসের মতো আমাকে টেনে নিয়ে যায়। বসে বসে তমাকেই দেখি। তমা হাসে, কপালে উড়ে পড়া চুলের গোছা সরায়, বুকের ওপর শাড়ির আঁচল টান টান করে। আমার দৃষ্টি নিষঙ্লক হয়ে থাকে তমার ওপর। মনে মনে ক্রমাগত নিঃশব্দে বলি-তমা, তুমি আমার প্রিয়তমা, আমার ক্লিওপেট্রা, রানী নেফেরেতিতি, নূরজাহান। চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলে বেলাল, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদক্লিষ্টতার বিরুদ্ধবাদী সাহিত্য, পুঁজিবাদী অর্থনীতির আগ্রাসনে পৃথিবী জোড়া শিল্প-সাহিত্যের পাণ্ডুরতা, মিসরের তুতেনখামেনের রত্নাগার আর ফারাওদের কাব্যচর্চা নিয়ে মনোজ্ঞ বাক্যমালা সাজায়, আকর্ষিত করে শ্রোতাদের। রবীন্দ্রনাথের অসম বয়সী প্রেমিকা ভিকতোরিও ওকামেঙ্ার অজানা মনোরহস্য উদ্ঘাটন করে, আলো আকৃষ্ট পতঙ্গের মতো টেনে আনে তমার মুগ্ধতা, তখন আমার বুকে আগুন জ্বলে, আমি ও হত্যাকারী হতে চাই। হতে চাই ওর গুপ্তঘাতক।

বেলাল গাড়ি চালানোর সময় ছোটখাটো একটা অ্যাকসিডেন্ট করল এক দিন। দোষটা ওর নয়, আনাড়ি এক রিকশাচালকের। তবু গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল বেলাল। সঙ্গে সঙ্গে ওকে ঘিরে ফেলল উত্তেজিত মানুষের জটলা। বেলালকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। ফয়সালাকারীর ভূমিকাটা লুফে নিলাম। রিকশার তেমন ক্ষতি হয়নি বরং বেলালের ঝকঝকে নতুন গাড়ির শরীর জখম হয়েছে। তবু বেলালকে ধমকালাম-এ কী করেছিস! বেখেয়ালিপনায় একজন গরিব রিকশাওয়ালার ক্ষতি করলি!

বেলালের হয়ে, ক্ষমা চাওয়ার অভিনয় করতে গিয়ে ড্রাইভারের বেখেয়ালি গাড়ি চালানোর দোষটি উল্লেখ করলাম কৌশলে।

বেলালের বিভ্রান্ত চেহারা উল্লসিত করে আমাকে। গোলমাল মিটলে গাড়িতে উঠে বলি-তুই আজ এমন নার্ভাস হয়ে গেলি কেন রে?

গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রিত রেখে জবাব দেয় বেলাল-নার্ভাস কেন হতে যাব। এ শহরে দু-চারটি রিকশার সঙ্গে ধাক্কা না খেয়ে গাড়ি চালিয়েছে কে কবে!

চোখের কোণে বেলালের মুখটা দেখে নিই। নাহ, ও এখন সমঙ্ূর্ণ স্বাভাবিক। গাড়ির শরীরের আঁচড়গুলো নিয়েও যেন ওর মাথাব্যথা নেই।

তবুও বলি-তোকে কিন্তু এখন বেশ নার্ভাসই দেখাচ্ছে।

একটু যেন চকিত হলো বেলাল। সামনের আয়নায় নিজেকে এক ঝলক দেখে নিয়ে হাসল-কই, না তো।

আমি জানি, তমাদের বাড়িতে পৌঁছে বেলাল তার অভ্যাসমতোই খুব সহজ ভঙিতে বলবে-জানো তমা, আজ একটা কাণ্ড হলো!

বেলালের সব ভঙ্গিকে আমার চেয়ে বেশি কে চেনে! ও হাসবে, চায়ে ঠোঁট ছোঁয়াবে। আর অ্যাক্সিডেন্টের গল্পটা এমন সহজভাবে বলবে, যেন শার্ট পরতে গিয়ে দেখল গলার বোতামটা ছেঁড়া। তমা উত্সাহে শুনবে, তারপর আহ্লাদি ভঙিতে বলবে-ও, তাই। ভারি মজা তো।

যদিও ব্যাপারটাতে এমন কোনো মজা নেই। তবুও বলবে তমা। আমি জানি, এটা ওর বেলালকে মুগ্ধ করার জন্যই। বেলালকে আকর্ষণ করা ছাড়া এখন সবকিছুই তমার কাছে অর্থহীন।

তমাদের বাড়িতে পৌঁছেই বেলাল ওর গাড়ির জখম পরীক্ষা করতে শুরু করল। সুযোগটুকু নিতে দেরি হলো না আমার। আড্ডায় এসে গেছে সবাই। সবাই আমার কাছেই শুনল, বেলাল বিশ্রী একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, আর ঘটনাটা ঘটেছে ওর নার্ভাসনেসের জন্যই। বেলাল এসে ঢুকল তখনই, সবাই যখন ওকে ঘিরে নানা প্রশ্ন করছে, আমি উত্ফুল্ল মনে সিগারেট ধরালাম। বেলাল বেশ বিব্রত। সেদিন আড্ডায় তমা নয়, বেলালই থাকল আমার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে। ওর ওপর থেকে দৃষ্টি সরালাম না। সারাক্ষণই কেমন অন্যমনস্ক থাকল ও। আমেরিকার কনফেশনিস্ট কবিদের নিয়ে আলোচনার নিটোল ছন্দ বিঘ্নিত হয় বারবার। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী নিও-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশীয় ইউনিয়নের অনিবার্যতার কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর শাণিত করে তুলতে পারে না, ওকে সত্যিই নার্ভাস দেখাচ্ছে। ৯টা না বাজতেই তাড়া দিলাম বেলালকে। ঘরের সবাই শুনল, তমাও শুনল, আমি বলছি-ওঠ দোস্ত। সকাল সকাল ফিরতে হবে। আজ তুই বেশ আপসেট আছিস, আবার না অ্যাক্সিডেন্ট করে বসিস।

ফেরার পথে বেশ সাবধানেই গাড়ি চালাচ্ছিল বেলাল। তবু বারবার ওকে হুঁশিয়ারির খবরদারি করতে করতে ভীষণ হাসি পেল, বেলাল আজ গাড়ি চালাতে তার পুরনো ভারসাম্যটি থেকে বিচ্যুত্ হচ্ছে। ওর আত্মবিশ্বাসে সরু চুলের মতো একটা ফাটল এখন বেশ সঙ্ষ্ট। নিঃশব্দে বললাম-এই ফাটলেই আমি ধস নামিয়ে দেব।

এরপর মাঝে মাঝেই ওকে বলতে শুরু করলাম-বেলাল, এবার একটা ড্রাইভার রাখ। ড্রাঙ্ক ড্রাইভারের চেয়ে নার্ভাস ড্রাইভার বেশি বিপজ্জনক। হয়তো কোনো দিন বড় রকমের একটা অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবি। আমার মনের গোপন অভিপ্রায়টি বেলাল বোঝে না, ও আমাকে আগের মতোই নির্ভুলভাবে বিশ্বাস করে। তমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে একদিন বলল-ভাবছি গাড়ি আর চালাব না। একটা ড্রাইভার রাখব। তুই কী বলিস আসিফ? বেলালের কণ্ঠের ভাঙন সুসঙ্ষ্ট অনুভব করি। উল্লসিত হই আবার। ওর ভাঙন আমার নেশা, আমার আনন্দ। সেই হিংস্র আনন্দে বলে উঠি-তাই-ই ভালো। গাড়ি চালানোর জন্য তুই আর ফিট নস।

গাড়ি চালানো ছেড়েই দিল প্রায় বেলাল। তমা একদিন ওকে খুব আবদারের শাসনে বলল-আপনি যে কী! একদিন রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে বলে গাড়ি চালানোই ছেড়ে দিলেন। নিজের ওপর বিশ্বাস নেই আপনার?

বেলাল খুব অপ্রতিভ ভঙিতে বারবার বলল-বিশ্বাস থাকবে না কেন, যথেষ্ট আছে। বিশ্বাসটাই তো আমার শ্রেষ্ঠ সমঙ্দ।

খুব জোরালো শব্দের এই কথাগুলো তেমন জোরালো হয়ে প্রভাবিত করল না হয়তো তমাকে। বলল-জানি না কী হয়েছে আপনার, আপনি কেমন যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছেন!

তমা আমাকে খুব চমত্কার একটা সুযোগা করে দিল যেন। বেলাল যখন আড্ডার তর্কের আসরে ‘হ্যাভ-হ্যাভ নটস’ বিভক্ত পৃথিবীর চুলচেরা বিশ্লেষণে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে, ওকে তাচ্ছিল্যের আক্রমণ ছুড়ে মারি-তুই যা বলিস, আসলে তুই তা বিশ্বাস করিস না কখনো।

ঘুরে দাঁড়ায় বেলাল। ওকে আবার আগের মতোই ঝকঝকে শাণিত দেখায়-কী করে বুঝলি আমার বিশ্বাস নেই?

বিদ্রূপের ধারালো হাসি জ্বলে ওঠে আমার ঠোঁটে-কখনো অভাব কি তা জেনেছিস? ছেঁড়া-ময়লা কাপড় পরে না খেয়ে থাকার জ্বালা সহ্য করেছিস? বড়লোক বাবার প্যালেসের নিরাপত্তায় আয়েশের জীবন উপভোগ করে এসব ফাঁকা কথা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়।

আমি ভুলে যেতে চাই ছাত্রজীবনে আমি আর বেলাল একই সঙ্গে মার্কস-অ্যাঙ্গেল পড়েছি। বৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছি। রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষকে ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিগত সমঙ্দ আর ক্ষমতার কারাগার মুক্ত করতে চেয়েছি। পুঁজিবাদকে ঘৃণা করেছি।

ঝলসে ওঠে বেলাল-নীতি সমর্থন করাটা ভণ্ডামি নয়, কোনো গোষ্ঠীর মনোপলিও নয়। সমাজ পরিবর্তনে ছেঁড়া কাপড় পরা, অভুক্ত, পথে ভাসমান লোকেরা লিড দেয় না। দেয় মধ্যবিত্তরাই। স্ট্যালিন, লেনিন, ট্রটস্কি এরা কেউই...

বেলালকে থামিয়ে দিলাম-তোর ওই বিখ্যাত লিডারদের বিশাল ইমেজ ধূলিসাত্ হলো কেন তাহলে? কেন বার্লিনের প্রাচীর ধসে গেল? তোর প্রিয় ইজম মাওবাদের নীতি কেন পুঁজিবাদ প্রভাবিত নিও-ইমিিরয়ালিজমের পথে পা বাড়াতে আগ্রহী হলো। বল, এসব কি নীতিহীনতা নয়?

আমি জানি, বেলাল এখন সমাজতন্ত্রবিরোধী গ্লোবালাইজেশনের অন্তর্নিহিত কূটনীতির চাতুরীকে আক্রমণ করতে নামবে। ওকে সেই সুযোগ না দিয়ে আবার বলি-ভণ্ডামির সঙ্গে বিশ্বাসহীনতার যোগ থাকে বলেই সেটা কখনো সত্য হয়ে টিকে থাকে না, এ জন্যই তুই তোর আত্মবিশ্বাসে অনবরত জোড়াতালি দিয়ে চলেছিস। এটা এক ধরনের বিশ্বাসহীন ভণ্ডামির শিল্প চর্চা। আর কিছুই নয়।

আমার কথার ভঙিতে ঘরের সবাই হেসে উঠল। এমনকি তমার ঠোঁটেও হাসির আভাস, হাসি ছলকায় তমার চোখে।

সবার হাসি থমকে দেওয়ার মতো যুক্তি যে বেলালের হাতে অজস্র রয়েছে, সেটা জানি। কিন্তু তমার চোখের চিকচিকে হাসিতে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল বেলাল। তারপরই রেগে উঠল-আসিফ শুনে রাখ, বিশ্বাস সন্ত্রাসী খোঁজা পুলিশের হাতের বন্দুক নয়...বিশ্বাস একটা দর্শন। তাকে বুঝতে হলে তোদের সবাইকে অবশ্যই দার্শনিক হতে হবে।

হো হো শব্দে হেসে উঠলাম। এমন উপভোগ্য খেলায় কোনোদিন নামিনি আমি। আমার শিরায় শিরায় আদিম মানুষের যুদ্ধের ডঙ্কা বাজে। আমি দর্শন বুঝি না, এখন আমি সমঙ্ূর্ণ একজন যুদ্ধবাদী মানুষ। আমি এখন যুদ্ধ চাই। তমার জন্য যুদ্ধ, দখলের যুদ্ধ। সবাইকে শুনিয়ে অথচ মৃদু স্থির কণ্ঠে বলি-বিশ্বাসের গভীরতা না থাকলেই রাগ আসে। তোর রেগে ওঠাই প্রমাণ করছে, তুই বিশ্বাসহীন, উদ্ভ্রান্ত।

বেলাল রাগ করে উঠে দাঁড়ায়, ঘর ছেড়ে চলে যায়। ব্যাপারটা এতই অভাবনীয়, তমার মুখে নেমে আসে ান বিষণ্নতা। খুব আস্তে বলে-ও আজকাল বড় সেন্টিমেন্টাল হয়ে উঠছে, আগে তো এমন ছিল না!

আমার রাতগুলো এখন চমত্কার। আজকাল তমাদের ড্রইংরুমের আড্ডায় বেলালের কণ্ঠ কিছুটা স্তিমিত। কথা বলে কমই। বিষণ্ন আর গম্ভীর অন্যমনস্কতায় স্তব্ধ হয়ে থাকে। তবু তমার কোমল দৃষ্টি হাস্নাহেনার ঝাড়ের নমনীয়তায় ছুঁয়ে থাকে ওকে। আমি ওকে করুণা করতে চাই।

মনে মনে বলি-বেলাল আহমেদ, তুমি আর আমি এক শীত-বিকেলে রমনার মাঠে হেঁটেছি, স্বাধীন বাতাসের আনন্দিত বাতাস বুকে ভরে নিয়েছি, জীবনানন্দ দাশের কবিতা মিলিত কণ্ঠে আবৃত্তি করেছি, আমরা ছিলাম একাত্ম অনুভবের বন্ধু। তবু তোমাকে আমি ক্ষমা করব না, তুমি আমার তমাকে-আমার প্রিয়তমাকে কেড়ে নিয়েছো, যার গালের লাল বৃত্তের গোলাপটি ঘুম না আসা রাতে আমাকে পাগল করে তোলে।

বেলালের গাড়িটা গ্যারেজে পড়ে থাকে। গাড়ি চড়ে না বেলাল, হয়তো ভয় পায়, যদি প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়া বিশ্বাসে ফাটল ধরে যায়। আমি সেটা আড্ডার আসরে হাসির খোরাক কবে তুলি। বেলাল এখন রিকশায় চড়ে। তমাদের বাড়ি থেকে দুজনে রিকশায় ফিরি। বেলাল আগের মতোই আমাকে আমাদের গলির মুখে নামিয়ে দেয়। একসঙ্গে ফিরতে ফিরতে ওকে বলি-তুই এমন মনমরা হয়ে থাকিস কেন রে? এ তো ভালো নয়। তুই তো একজন সৃজনশীল মানুষ, মন মরে গেলে লিখবি কেমন করে!

বেলাল নিরুত্তর। গম্ভীর। আবার বলি-এজন্যই তোর কবিতা আজকাল ভালো হচ্ছে না।

বেলাল চমকায়। ওর কাঁপন আমি লক্ষ করি। ওর ভেতরের অবক্ষয় আমার দৃষ্টিতে সঙ্ষ্ট হয়ে ওঠে। ভয় বাসা বেঁধেছে ওর মনে। কাঁপিয়ে তুলেছে ওকে। নিস্তেজ-ভীরু কণ্ঠে কথা বলে বেলাল-কে বলেছে? আমার কবিতা ভালো হচ্ছে না?

মনে মনে হাসি। তবু আন্তরিকতার ভানে অনবদ্য আমি-খুব দুঃখ পাই, সবাই যখন বলে, বেলাল আহমেদের কবিতার আগের শাণিত ধার নেই। নতুন যে বইটা বেরোল তোর-সেটা নিয়েও কথা উঠেছে। কবিতাগুলো নাকি দুর্বল-একেবারেই বাজে লেখা। আকাশ মেঘলা। ফিনফিনে বৃষ্টি। রাস্তার সোডিয়াম আলো ঘোলাটে ঝাপসা। বেলালের কণ্ঠস্বরও ঝাপসা। ঝাপসা আর ক্লান্ত-জানি না কী হয়েছে আমার। ভালো লাগে না কিছু। কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না। তুই বলতে পারিস, কী করব এখন আমি!

পুরনো দিনের বন্ধুত্বের অভিনয়ে সন্তর্পণে ওর পিঠে হাত রাখার মতো করে বলি-তুই কি মনে করিস, তুই ফুরিয়ে গেছিস?

ভীষণ কেঁপে ওঠে বেলাল। রিকশার মৃদু গতিতে দু পাশের আলো-আঁধার ওর মুখে সাদা-কালো ধীরে ছায়া ফেলে যায়। আশ্রয় আর সমর্থন খোঁজার জন্য ও আমার হাতের মুঠি আকড়ে ধরে। বিশ্বস্ততার উষ্ণতায় ভরা সেই পুরনো দিনগুলোর ঝাপটা লাগে আমার বুকে। কিন্তু তমা! তমা কেন এখনো ফিরে আসে না। কেন এখনো বেলালের মুখে মুগ্ধতার দৃষ্টি মেলে রাখে। পলকে নিষ্ঠুর হয়ে যাই-লেখা তোকে দিয়ে আর হবে না।

করুণ শোনায় বেলালের কণ্ঠ-তুই বলছিস আসিফ?

-হ্যাঁ, বলছিই তো। ছেড়ে দে কবিতা-টবিতা লেখা।

রিকশাটা অন্ধকারে। বাতাসে দুলে ওঠে ফিনফিনে বৃষ্টির ঝালর। ঘিরে ফেলে যেন বেলালকে। খুব ক্লান্ত আর বিষণ্ন কণ্ঠে কথা বলে বেলাল-তাই-ই দেব। ছেড়ে দেব কবিতাকে, ছেড়ে দেব সবকিছুকে। সবাইকে।

ভীষণ রাগ হয়। ওকে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। বিশ্রী চিত্কারে বলতে ইচ্ছে করে-তুই একটা মিথ্যেবাদী। বিশ্বাসঘাতক। তমাকে তুই ছিনিয়ে নিয়েছিস। তুই তমার ভালোবাসা পছন্দ করিস। আমি জানি, তমাকে তুই ছাড়বি না।

বেলাল কদিন থেকে আড্ডায় অনুপস্থিত। আমি ওর খবর রাখি। বেলাল ওর গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে, সারা দিন ঘরে বসে থাকে। কবিতা লেখা কাগজগুলো কেবলই ছিঁড়ে ছিঁড়ে দলা পাকায়, ওয়েস্ট পেপারের ঝুড়ি ভরিয়ে তোলে। ডিপার্টমেন্টে ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়েছে বেলাল। চাকরিতে ঢোকার পর ছুটি ও খুব কমই নিয়েছে। ভালো শিক্ষক হিসেবে সুনাম আছে ওর। সবাই বলত বেলাল আহমেদ ক্লাস নেওয়ার সময় সুচ পতনের শব্দ শোনার নিস্তব্ধতা থাকে ক্লাসে। ছাত্রছাত্রীরা ওকে পছন্দ করে, ও পছন্দ করে তাদের মাঝে থাকতে। সেই বেলাল ছুটি নিয়ে ঘরে বসে কবিতা লেখা কাগজ ছেঁড়ার খেলা খেলছে। খবরটায় উদ্দীপ্ত হলাম। গেলাম বেলালদের বাড়িতে। নিষঙ্রভ ভাঙা একটা মানুষ হয়ে মাথা গুঁজে বসে আছে বিছানায়। যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়ি- কী রে, ব্যাপার কী। শুনলাম ডিপার্টমেন্টে যাওয়া বন্ধ করেছিস! কী হলো তোর?

কথা বলে না বেলাল। দু হাতে মাথা চেপে বসে থাকে। নতুন আঘাতের ইচ্ছা আমাকে উন্মাদ করে-কে যেন বলছিল তুই আজকাল ভালো পড়াতে পারছিস না।

কথা বলে না বেলাল। চোখ তুলে তাকায় একবার শুধু। নতুন অস্ত্রাঘাতের জিঘাংসায় উন্মত্ত হই! বেলালের মুখে তীক্ষ দৃষ্টি রাখি। ওর ভাবান্তর আমার নজর এড়ায় না। অস্ত্র উদ্যত করি-ভালো পড়ানোর টেকনিকটা কোনোদিনই তোর রপ্ত হয়নি, তুই আসলে কোনোদিনই ভালো পড়াতে পারিসনি।

উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি তোলে বেলাল-তবে যে ছাত্রছাত্রীরা বলত আমি ভালো পড়াই-তাই বলত বুঝি। কিন্তু এখন তো তোর ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই বলছে তোর লেকচার না কি ওরা ধরতে পারে না। ওরা মনে করে তুই কনফিউজ, আত্মবিশ্বাসহীন।

হতাশায় উদ্ভ্রান্ত বেলাল। জলে ডোবা মানুষের মতো আঁকড়ে ধরে আমাকেই-আমি কোথায় হারিয়ে ফেলেছি আমার বিশ্বাস, আমার আত্মবিশ্বাস? আমি তাহলে কে? আমি কী?

ওর মাথা নুয়ে পড়ে। বিড় বিড় করে একই কথা বলে চলে। রক্তক্ষরণে দুর্বল প্রতিপক্ষকে আঘাতের আনন্দে আমার রক্ত উত্তাল। কণ্ঠস্বর গভীর আর মায়াবী করে তুলি। বিষ ঢেলে দিতে থাকি ওর অবচেতনে। ওর কানে অটোসাজেশনের মতো ক্রমাগত ফিস ফিস করতে থাকি-তুই ব্যর্থ মানুষ। তুই পারিস না, কিছুই পারিস না। তুই অক্ষম, তুই অক্ষম, অক্ষম, অক্ষম।

বেলাল ডুবে যায় ক্রমে কাল্পনিক ব্যর্থতায়, নৈরাশ্যের গভীরে।

এরপর তমা একদিন এল আমার বুকে। এল বেলালের জন্যই। তমা কাঁদছিল, ভীষণ কাঁদছিল। আমার বুকে মুখ রেখে কেঁদে কেঁদে বলছিল-ওকে আপনারা ভালো করে দিন, সুস্থ করে দিন। ও কেন এমন হয়ে গেল!

কেন? আপনি ওর বন্ধু। আপনিও কি জানেন না?

তমার চুলের সুঘ্রাণ, দেহের সৌরভ পাগল করে দেয় আমাকে। কান্নার বৃষ্টিতে নুয়ে পড়া নরম লতাটিকে, আমি আমার সমস্ত বাসনা-কামনা আর ইচ্ছার প্রচণ্ডতায় পিষ্ট করতে চাই। ঝাপটা দিয়ে ওঠে তমা। অবিশ্বাস আর ঘৃণার আগুনে জ্বলে ওঠে কান্নাভেজা চোখ। আমার দৃঢ় বাঁধনে বন্দি তমা ডানা ঝাপটায়, ছটফট করে। সারা শরীরের বিদ্রোহ দিতে যেন চিত্কার করে-ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে। তোমাকে আমি ঘৃণা করছি, প্রচণ্ড ঘৃণা করছি।

তমাকে ছাড়ি না। কেন ছাড়ব! ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধের পরে ওকে দখল করেছি। ও কী করে বুঝবে কী কৌশলে বেলালকে নিঃশেষ করেছি আমি। বেলাল মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। রাতের পর রাত জেগে থাকে। দিন-রাত সারা ঘরে কী যেন খোঁজে। খুঁজে খুঁজে নির্বাক যন্ত্রণায় নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তমা জানে না, কেউ জানে না, কিন্তু আমি জানি বেলাল খুঁজছে ওর হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসকে, ভালোবাসাকে, খুঁজছে আত্মবিশ্বাসকে।

আমি নিজে এই মুহূর্তে আর ভালোবাসায় বিশ্বাসী নই, বিশ্বাসী দখলে। আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে তমার প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করি। ওকে দু বাহুর কঠিনতায় বন্দি করে মনে মনে বলি-প্রিয়তমার একটি তিলের জন্য যদি সমরখন্দ, বোখারা বিকিয়ে যায়, যদি হেলেনের জন্য ট্রয়ের যুদ্ধ হয়, মেহেরুননেসার জন্য শের আফগানকে হত্যা করা হয়, তবে তমার জন্য আমি কেন হত্যাকারী হব না!

তবুও দখলের উন্মাদনার মাঝে তমার শরীরে, ঠোঁটে ভালোবাসার সুরভি খুঁজতে থাকি পাগলের মতো আমিও।

পাগলের মতোই বিড় বিড় করি, তোমার শরীরে আমি ভালোবাসা খুঁজছি তমা। তুমি আমাকে ভালোবাসা ফিরিয়ে দাও। তোমার জন্য আমি ভালোবাসাকে খুন করেছি, হত্যা করেছি বন্ধুত্বকে। তুমি জান না, বেলাল আর আমি একসময় ভালোবাসায় বিশ্বাস রেখেছিলাম। জান না, এক জ্যোত্স্না রাতে ইছামতী ডাক বাংলোতে একটা চিকচিকে রুপালি নদীকে সামনে রেখে, সারা রাত জেগে বাতাসে শালপাতা ঝরার গান শুনেছি, আর পৃথিবীকে ভালোবেসেছি। সেই ভালোবাসাকে আমি হত্যা করেছি তমা। হত্যা করেছি দখলের জন্য, শুধু তোমাকে দখলের জন্য প্রিয়তমা।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত