মুক্তিযোদ্ধা ছিদ্দিকুর রহমান। জন্ম ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থানার বাজরা এলাকায়। নড়াইলের লোহাগড়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালে দেশমাতার ডাক আসে। আগপিছ না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে যান। গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে স্বদেশে আসেন হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়তে। পদে পদে বিপদ মাড়িয়ে একদিন সেই যুদ্ধে ঠিকই জয়ী হয়ে সদর্পে ঘরে ফেরেন। সেদিনের সেই টগবগে যুবক এখন ষাটোর্ধ। কিন্তু এ বয়সেও জীবিকার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বর্তমানে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে একটি তৈরি পোশাক-কারখানার নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এই বয়সেও তিনি স্বপ্ন দেখেন যোগ্য সত্ নেতৃত্বের। তিনি বিশ্বাস করেন, যুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের জন্ম, তা কখনো ব্যর্থ হতে পারে না।
মার্চের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানি সেনারা এলাকায় নির্বিচারে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে। এলাকায় টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যায়। তাই হঠাত্ করেই ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এলাকা থেকে একসঙ্গে চারজন রওনা হই সীমান্তের উদ্দেশে। পথে পথে অনেক বাধা। পাকিস্তানি সেনাদের কড়া নজর এড়িয়ে যেতে হতো। শেষ পর্যন্ত আমি ও বন্ধু হুমায়ুন কবির যাত্রা অব্যাহত রাখি। বাকি দুজন ছিটকে পড়েন। আমরা বেনাপোল সীমান্তের কাছাকাছি তালবাড়িয়া গ্রামে এক বাড়িতে রাত যাপন করি। পাশেই ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। এ জন্য সারাক্ষণ ভেতরে ভয় কাজ করেছে। শত্রু শিবিরের কাছে নিশ্চিন্তে ঘুমানো কঠিন। ওই বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে বাইরে বাগানে রাত কাটালাম। এখান থেকে বেনাপোল দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে গেলাম বনগাঁওয়ের ৫ নম্বর টালিকোলা এলাকায়। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক বাছাইয়ের কাজ শেষে ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানো হয়। বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন নড়াইলের লোহাগড়ার লে. মতিউর রহমান। হুমায়ুন কবির নৌকমান্ডো ট্রেনিংয়ের জন্য পলাশী গেল। আমি গেলাম বিহারের চাকুলিয়া বিমানবন্দরে। সেখানে ট্রেনিং শুরু করলাম ৫ নম্বর শাখায়। ট্রেনিং শেষে পাঠানো হলো ২৪ পরগনার বাগুন্দি ক্যাম্পে। এখানে কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। তারপর অস্ত্র নিয়ে দেশের ভেতর ঢুকলাম।
প্রথম অপারেশন হয় বেনাপোল সীমান্তের কাছে। একটি পুকুরে সহযোদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান নিই। দুই পাশে পাকিস্তানি বাহিনী। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষে ক্ষয়ক্ষতি হয়। একটি অপারেশনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। যুদ্ধটি হয় গোপালগঞ্জের উলপুর এলাকায়। দলনেতা ছিলেন ক্যাপ্টেন বাবুল। ওই যুদ্ধে আমাদের ১৬-১৭ জন সহযোদ্ধা শহীদ হন। বোয়ালমারী থানার শীবগ্রাম এলাকার যুদ্ধে আমার নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার অবস্থা হয়েছিল। ওই যুদ্ধে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। এখানে হেমায়েত নামে এক সহযোদ্ধা শহীদ হন। শুধু পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ নয়, একবার নড়াইলের লোহাগড়ায় নকশাল নামধারীদের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়।
আমাদের দলের বেশির ভাগ অপারেশন ছিল গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস কেন্দ্রে। এই ওয়ারলেস অক্ষত রাখার দায়িত্ব ছিল আমাদের কাঁধে। পাকিস্তানি বিমান বাহিনী মাঝেমধ্যে এখানে বিমান হামলা চালাত।
যুদ্ধ শেষে ৭২ সালে নৌবাহিনীতে যোগ দিই। চিফ পেটি কমান্ডার রহমত উল্লাহ আমাদের ডেকে চাকরিতে ঢোকান। ১৮ বছর চাকরি করার পর ১৯৯০ সালে অবসরে যাই। পরে কয়েক বছর বেকার থাকার পর যমুনা সেতুতে হল্যান্ডের জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি নিই। এখানে দুই বছর চাকরি করি। আবার বেকারজীবন। পরে খালিশপুরে লিবার্টি সিনেমা হলে বুকিংয়ের কাজ নিই। জীবনসংসারের তাগিদে কাজ করতাম। বেতন খুবই কম। আয় বলতে ছিল পেনশনের টাকা। স্ত্রী ও চার ছেলের সংসার। এ সময়টায় কষ্টে-হতাশায় দিন কেটেছে। দেশের বাড়িতে অল্প যা জমিজমা ছিল, ছেলেদের পড়ালেখা শেখাতে সব বিক্রি করতে হয়েছে।
অনুলিখন: মাসুদুল হক, গাজীপুর