বিজ্ঞাপন
default-image

মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আমি জেনেভায় উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার সদস্য। এই সম্মেলন চলাকালে ২৬ মার্চ ১৯৭১ বিবিসির মাধ্যমে আমি জানতে পারি যে বাংলাদেশের অবস্থা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ঢাকায় সাংঘাতিক কিছু হয়েছে, কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে সঠিক কিছু জানা যাচ্ছে না। এ খবর শুনে আমি অত্যন্ত মর্মাহত, চিন্তিত ও ব্যাকুল হয়ে উঠি। অধিবেশন চলা অবস্থায় সংস্থার তৎকালীন সভাপতি আঁদ্রে আগিলাকে আমি জানাই যে আমার দেশসংক্রান্ত গভীর দুঃখজনক সংবাদ আমি জানতে পেরেছি। আমার পক্ষে অধিবেশনে অংশগ্রহণ আর সম্ভব নয়। আমি মধ্যাহ্নে জেনেভা ত্যাগ করি এবং বিকেলের দিকে লন্ডন এসে পৌঁছি।

আমি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের দুজন কর্মকর্তাকে চিনতাম। একজন ইয়ান সাদারল্যান্ড। তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান। অপরজন এন জে ব্যারিংটন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড হিউমের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

পরের দিন যদিও ছুটির দিন ছিল, তবু আমি উভয়কে তাঁদের অফিসে আসতে অনুরোধ জানাই। পররাষ্ট্র ভবনে উপস্থিত হলে তাঁরা আমাকে জানান, ঢাকা থেকে এখনো সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা কফি খাচ্ছি এমন সময় সাদারল্যান্ডের একান্ত সচিব খবর দেন, ঢাকা থেকে একটি টেলেক্স আসছে। সাদারল্যান্ড তথ্য সম্পূর্ণ হলে সেটি নিয়ে আসতে বলেন। সচিব একটি বিশাল টেলেক্স নিয়ে আসেন। সাদারল্যান্ড গোটা জিনিসটা পাওয়ার পর আমাকে বলেন, জাস্টিস চৌধুরী, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, ঢাকার সংবাদ খুবই খারাপ। বহু ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা ভীত যে শিক্ষকেরাও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বাদ পড়েননি। নগরে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই বেশি।

আমি আরও জানতে পারি, ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার জানিয়েছেন তাঁর পক্ষে আর টেলেক্স করা সম্ভব নয়। তিনি ব্রিটিশ নাগরিকদের ফেরত নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, গোটা বাংলাদেশ একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় আমার পক্ষে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা অপমানজনক। আমি তখনই লর্ড হিউমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সে সময় তিনি স্কটল্যান্ডে তাঁর দেশের বাড়িতে ছিলেন। আমি অবিলম্বে কমনওয়েলথ সচিবালয় সাধারণ সম্পাদক আর্নল্ড স্মিথের সঙ্গে দেখা করি এবং ঢাকায় হত্যা বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে বলি।

ইতিমধ্যে বহু বাঙালি জড়ো হতে থাকে। সবার নাম মনে রাখা সম্ভব নয়। তবে বিশেষভাবে আমি কয়েকজন চিকিৎসকের কথা বলতে চাই, যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। নয় মাস ধরে যে আন্দোলন চলে, তাতে কিছু কিছু কর্মীর কাছ থেকে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু চিকিৎসক কর্মীরা কোনো দিন কোনো অসুবিধা করেননি, বরং তাঁদের ত্যাগ, কর্মনিষ্ঠা ও কষ্টসহিষ্ণুতা অন্যদের জন্য আদর্শ হিসেবে প্রজ্বলিত ছিল। ডা. আবদুল হাকিম, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও মোশারফ হোসেন জোয়ারদার সারাক্ষণ পরিশ্রম করতেন।

এখানে বলা প্রয়োজন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমগ্র গ্রেট ব্রিটেনে বাঙালিদের মধ্যে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রায় প্রতিটি বাঙালি এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বিভিন্ন এলাকায় কমিটি গঠন করে। কিন্তু একটি সংগঠনের সঙ্গে অন্য সংগঠনের যোগাযোগ ছিল কম। ফলে নেতৃত্বের প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেয় এবং নিজেদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক দলই আমাকে তাদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেয়, কিন্তু আমি একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত না হলে কোনো দলেই যোগ দেব না বলে জানাই।

লর্ড হিউমের সঙ্গে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। এই মধ্যবর্তী সময়ে আমি বিভিন্ন একাডেমিশিয়ান এবং বিশ্ববিদ্যালয়-প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকি। এ ছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার অ্যালেন বুলক এবং ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লর্ড জেমসের সঙ্গে দেখা করি। তাঁরা আমাকে স্যার হিউ স্পিরংগারের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তিনি ছিলেন কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মুখপাত্র।

default-image

ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড জেমস একটি মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করেন এবং প্রায় ২০ জন বিভাগীয় প্রধানকে ওই ভোজে দাওয়াত করেন। আমি তাঁদের কাছে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করি। তাঁরা গভীর সহানুভূতির সঙ্গে তা শোনেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে লর্ড জেমস ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে; পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনি হিসেবে ব্যবহার করা আর সম্ভব হবে না। এরপর আমি স্যার হিউ স্পিরংগারের সঙ্গে দেখা করি। তিনি বলেন, ‘হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’ তিনি আরও বলেন, তিনি তখনই ইয়াহিয়া খানকে একটি টেলিগ্রাম করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য।

তারপর আমি আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনের সাধারণ সম্পাদককে টেলিফোন করে সব ব্যাপার জানাই। তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশ আন্দোলনে তৎপর বিভিন্ন সংগঠন একত্র করার জন্য আমরা সবাই চেষ্টা করি। কাজটি ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। রাত দুইটা-তিনটা পর্যন্ত মিটিং চলত। বাড়ি ফিরে নিজের কাছে শপথ করতাম, পরদিন আর যাব না। কে কোন দলের নেতা হবেন, তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল। কিন্তু পরদিন আবার ঠিকই যেতাম।

১০ এপ্রিল লর্ড হিউমের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। সাদারল্যান্ড ও ব্যারিংটন আমাকে তাঁর কাছে দিয়ে যান। লর্ড হিউম আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বলেন যে তিনি পাকিস্তানের হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন। অবস্থা ঠিকই আছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি বলি, শুধু একজনের কথাতেই প্রমাণ হয় না যে অবস্থা ঠিক আছে। আমি আমার সম্পূর্ণ বক্তব্য পেশ করি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানোর জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট খবর আছে যে শেখ মুজিব ভালোই আছেন।

লর্ড হিউমকে আমি জানাই যে আমরা শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। তিনি তাতে কোনো আপত্তি করেননি। সেদিক থেকে এটা অত্যন্ত সাফল্যজনক সাক্ষাৎকার ছিল। সেদিনই আমি চারটার সময় বিবিসিতে যাই। পিটার গিল সেখানে আমার একটি একক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারে আমি পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করি। বিবিসিতে কর্মরত দুজন বাঙালি সিরাজুর রহমান ও শ্যামল লোধ আমার বিবৃতি নেন ও প্রচার করেন।

অতঃপর আমি বাসা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিই। কয়েক দিন পরে গোছগাছ করে যখন আমি রওনা হচ্ছি, ঠিক তখনই একটি টেলিফোন আসে। জানতে পারি, টেলিফোনটি কলকাতা থেকে করা হয়েছে। অপর পারে কথা বলছেন টাঙ্গাইল থেকে সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তাঁরা আমাকে জানান যে তাঁরা আমার সিদ্ধান্তে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। তাঁরা চান যে সরকার গঠনের পর আমি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করি।

আমার আনুষ্ঠানিক কর্মের অংশ হিসেবে আমি সে মাসেই নিউইয়র্ক যাই। ওখানকার বাঙালি কূটনীতিক মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে প্রায় দুই শ বাঙালি আমার সঙ্গে বিমানবন্দরে মিলিত হন। এই দৃশ্য অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিল। কারণ এতে আমাদের আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক সমর্থনের লক্ষণ দেখা যায়। যেদিন আমি নিউইয়র্কে পৌঁছি আরও কয়েকজন বাঙালি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী যথা এ এম এ মুহিত, খোরশেদ আলম, হারুন রশীদ এবং আরও অনেকে আমার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। মাহমুদ আলী বিভিন্ন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমি তাঁদের সঙ্গে মিলিত হই এবং প্রকৃত অবস্থা তাঁদের সামনে তুলে ধরি। একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারের কথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত বারুদি, যিনি খ্রিষ্টান ছিলেন, রোকেয়া হলের ঘটনা শুনে তিনি এত বেশি আলোড়িত হয়েছিলেন যে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন যে তিনি সৌদি বাদশাহকে সমস্ত কথা জানাবেন এবং সর্বতোভাবে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালাবেন।

জাতিসংঘের বিভিন্ন কূটনৈতিক সদস্যের সঙ্গেও দেখা করি এবং বক্তব্য দিই। জাতিসংঘের তৎকালীন অধিবেশনে সভাপতি নরওয়ের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ হয়। আমরা প্রচারপত্র বিলি করি এবং বিভিন্ন সাংবাদিকের সঙ্গে মিলিত হই।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত