বিজ্ঞাপন
default-image

তখন আমার বয়স ২৫। আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলাম। একাত্তরে শেখ সাহেবের সেই ডাক, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে...।’ শুনে আর ঘরে থাকতে পারিনি। যুদ্ধ শুরু হলে কুষ্টিয়া মোহিনী মিল থেকে আমিসহ ১২০ জন আনসার ঝিনাইদহে যাই। সেখানে যুদ্ধ করে যশোর যাই, সেখানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তারপর যাই গোয়ালন্দ।

সেপ্টেম্বর মাসে কুষ্টিয়ায় ফিরে আসি। জানতে পারলাম, ভাদালিয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প করেছে। প্রতি রাতেই আমাদের গ্রাম দূর্বাচারাসহ পাশের এলাকা বংশীতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে আসে। হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে তাঁদের পরিবারের ওপর নির্যাতন চালাত। মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত ক্যাম্পে। এসব শুনে আমাদের রক্ত গরম হয়ে যেত। আমার জানামতে, কুষ্টিয়া জেলার সবচেয়ে বড় সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল সদর উপজেলার বংশীতলা মাঠে। সেদিন ছিল ৫ সেপ্টেম্বর। ভোর হতেই ভাদালিয়া ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা বংশীতলা গ্রাম লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বংশীতলা গ্রামের ত্রিমাথায় তিন দিক থেকে বাংকার করে পাল্টা অবস্থান নিই।

সকাল নয়টার দিকে যখন পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে প্রবেশ করে, তখন আমরা তিন দিক থেকে একসঙ্গে গুলি চালাতে থাকি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মারা পড়ে। আর আমার চোখের সামনেই সঙ্গে থাকা তাজুলসহ আরও তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা সেদিন সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। ওই দিন পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। ভাদালিয়া ক্যাম্পে নিয়ে তাঁদেরকে মেরে মাটির নিচে পুঁতে রাখে। কয়েক দিন পর কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁদের মধ্যে তাজুল ইসলাম, দিদার আলী, সাবান আলী, ইয়াকুব আলী, আবদুল মান্নানকে দূর্বাচারা হাইস্কুলের সামনে সমাহিত করা হয়।

দেশ স্বাধীন হয়। আমি ও আমার ছোট ভাই আক্কেল আলী অস্ত্রগুলো শহরে জমা দিই। সে সময় অনেকে ঢাকায় গিয়ে চাকরি নিয়েছে। আমি গ্রামে থেকে যাই। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম থাকলেও তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। দূর্বাচারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি টংঘর দিয়েছি। স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে টিফিনের সময় বিস্কুট-চানাচুর বিক্রি করি। স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা এই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুয়ে আছেন। প্রতিদিনই চোখের সামনে ওদের কবর দেখি। খুবই খারাপ লাগে। রাজাকাররা এখনো আমার দোকানেই পান-বিড়ি কিনে খায় আর দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করে। ভাবতে খুবই কষ্ট লাগে, কিন্তু কিছুই করার নেই।

সম্মুখযুদ্ধে অনেক সহকর্মীকে হারিয়েছি। তাঁদের কথা মনে পড়ে আর বেদনায় ভরে ওঠে মন। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মেলাতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধ করে একটি দেশ পেয়েছি। কিন্তু প্রাণ বাজি রেখে যে দেশটির জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, চেয়েছিলাম যে দেশ, সেই দেশ আজও পাইনি। অনেক রাজাকার রয়েছে, যারা এ দেশটাকে এখনো আগের মতো মনে করে। মনের মধ্যে শান্তি পাই না। কবে আসবে সেই দিন, যেদিন এ দেশে রাজাকারদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হবে। ওদের শাস্তি হবে।

অনুলিখন: তৌহিদী হাসান, কুষ্টিয়া

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত