আমি ১৯৭০-৭১ সালে ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ও স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সক্রিয় সদস্য ছিলাম। ’৭০ সালে ঢাকা থেকে মিরসরাই উপজেলার নিজ এলাকায় চলে আসি প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেনের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে। প্রচারণার পাশাপাশি আমার ও আমার সঙ্গীদের দায়িত্ব ছিল জনগণকে পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করা।
একাত্তরের আগস্টের মাঝামাঝি। একদিন খবর পাই একদল রাজাকারসহ পাঞ্জাবিরা মিরসরাই থানার মূল সড়ক থেকে আট-নয় কিলোমিটার পশ্চিমে সোফিয়া রোড হয়ে গ্রামের দিকে হানা দেবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যেভাবেই হোক ওদের মোকাবিলা করব। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা সুফি নূর মোহাম্মদ সাহেবের মাজারের কাছে অ্যাম্বুশ করি। পাঞ্জাবিরা ওই এলাকা অতিক্রম করার সময় গুলি করি।
আমাদের মধ্যে ছিলেন অহিদুল হক, নূর মোহাম্মদ, নিজামউদ্দিন চৌধুরী, কেনু দফাদার প্রমুখ। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল সীমিত। তাই প্রায় আধঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর আমরা পশ্চিম দিকে সরে পড়ি। কিন্তু পাঞ্জাবি সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় নিরীহ সুলতান ভূঁইয়া, গোলাম মোস্তফাসহ এলাকার বেশ কিছু লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন কর হয়। পরে মিঠাছড়া ওয়্যারলেস গেটে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় সুলতান ভূঁইয়া ও গোলাম মোস্তফাকে।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে স্থানীয় আলবদরদের সহযোগিতায় পাঞ্জাবিরা পুরো মিরসরাই এলাকাকে দুই ভাগে ভাগ করে মুক্তিযোদ্ধা ধরার অভিযান চালায়। এর মধ্যে আবুর হাট ও দুর্গাপুরে কয়েকবার খণ্ডযুদ্ধ হয়। দুর্গাপুরে শহীদ হন ফরিদ চৌধুরীসহ কয়েকজন। নভেম্বরের দিকে আরেক অপারেশন চালানো হয় আবু তোরাব বাজারে। এর মধ্যে শহীদ হন সিরাজুল মোস্তফা, আজিজুল হকসহ আরও কয়েকজন।
শত্রু বাহিনীর লোকজন প্রতিদিন রাতে কোনো না কোনো গ্রামে, পাড়ায় ক্যাম্প বসিয়ে বাড়িতে বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দিত। আমি, অহিদুল হক, নিজামসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে শত্রুর আগুনে। নভেম্বরে ভস্মীভূত করা হয় আবু তোরাব বাজারের অনেক দোকানপাট। প্রতিটি দিন ছিল যেমন-তেমন, রাত ছিল বিভীষিকাময়। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো তরুণ যুবক হত্যা কিংবা নারী নির্যাতনের ভয়ে মা-বাবারা ছিলেন উত্কণ্ঠিত, আতঙ্কিত। অনেক নারী-পুরুষকেই পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে চর শরত্, চর ইছাখালীসহ বিভিন্ন অজ্ঞাত স্থানে, থাকতে হয়েছে অভুক্ত। মিঠাছড়া ওয়্যারলেস গেটের কাছে ছিল পাকিস্তানি ক্যাম্প। যুদ্ধের পর ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে শত শত নরকঙ্কাল পাওয়া যায় সেখানে। ক্যাম্পে পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালিয়েছে।
অনুলিখন: মুহাম্মদ শামসুল হক, চট্টগ্রাম
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত