উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের—যা বস্তুত পাকিস্তানের দুই প্রদেশেই ঘটেছিল—প্রেক্ষাপটে আইয়ুব খানের পতন ও দৃশ্যপটে সামরিক শাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আগমন ঘটে সে বছর ২৫ মার্চ। পটপরিবর্তনের জ্বলন্ত বাস্তবতায় তাঁর প্রধান প্রতিশ্রুতিই ছিল পাকিস্তানে একটি সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান। তত দিনে লাগাতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রদেশজুড়ে বাঙালি তার স্বাজাত্যচেতনার এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনায় ঐক্যবদ্ধ। সবার মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট না হলেও বাঙালি হিসেবে আপসহীন জেদে মানুষ ছিল একাট্টা।
এক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ মানুষ আর জনতা নয় জাতি, একজনই নেতা—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দীর্ঘ লাগাতার জেল–জুলুম সয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব যেন আরও প্রখর, সংকল্পে ইস্পাতদৃঢ়, ভূমিকায় আত্মবিশ্বাসী, বক্তব্যে সুস্পষ্ট এবং যেকোনো মাপের ত্যাগের জন্য তিনি প্রস্তুত। এমন নেতা বাঙালি আগে দেখেনি, এমন ঐক্যও বাঙালি কখনো সৃষ্টি করেনি, এ রকম স্বপ্নও তারা কখনো দেখেনি। একটা জাতির—নতুন জাতির জন্ম হলো। তারা সমস্বরে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিল—তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা; এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।
ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের তারিখ দিলেন ৫ অক্টোবর ১৯৭০। পরে বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়ের কারণে নির্বাচনের তারিখ ৭ ডিসেম্বর পুননির্ধারণ করা হয়। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সহকারীরা বারবার বৈঠকে বসলেন, সংবিধানের অভাবে প্রয়োজনীয় আইনগত কাঠামো প্রণীত হলো এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি চলতে থাকল। বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত থাকলেন যুগপৎ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে এবং ছয় দফার পক্ষে গণরায় আদায়ের কাজে। এ নির্বাচন যেন তাঁকে স্বায়ত্তশাসনের ম্যান্ডেট দেয়, সেটা তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যও তাঁর মনের মধ্যে ছিল, সে খবর আমরা পরবর্তীকালে জেনেছি।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তাঁর নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ উচ্চারণ করেন। তিনি বঙ্গোপসাগর ব্যতীত বাংলা শব্দটির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে সেদিন বলেছিলেন, ‘জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম “পূর্ব পাকিস্তান”-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র “বাংলাদেশ”।’
৬ জানুয়ারি ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু আবার আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা জনগণকে জানিয়ে দেয়। সামরিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদেশের স্বার্থবিরোধী ষড়যন্ত্রের পুরোনো স্মৃতি অনেকের মনেই নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কার সৃষ্টি করেছিল।
তার ওপর মাওলানা ভাসানী নির্বাচনের বিরোধিতা শুরু করেন। এর আগে তিনি আইয়ুবের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা বিতর্কিত। তাঁর এ সময়ের ভূমিকা নিয়ে শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী কাল নিরবধিতে লিখেছেন, ‘মওলানা ভাসানীর কথাবার্তা ও কাজকর্ম আমাদের খুব বিভ্রান্তিকর মনে হতে থাকে।’ তিনি যে ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ এবং ‘ব্যালেট বাক্সে লাথি মারো’ আওয়াজ তুলেছিলেন সে কথা এবং সেই সঙ্গে ‘হুকুমতে রব্বানি’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে খোলাফায়ে রাশেদিনের জামানায় ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে কথাও আত্মজীবনীতে আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেছিলেন। এ সময় মাওলানার দলে ভাঙন হয়েছিল, যদিও বামপন্থীর একটি অংশ নির্বাচনের বিরুদ্ধেই ছিল। তবে সে সময় বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সবার ওপরে, সব বিতর্ক ও ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছে, যা আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং চীন ভ্রমণ নিয়ে লেখা বই আমার দেখা নয়া চীন–এ তাঁর এ পক্ষপাত স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
১২ নভেম্বর দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গেল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। এতে ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারান। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা থামিয়ে ত্রাণকাজে আত্মনিয়োগ করেন। আর গণচীন সফর শেষে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে উড়ে গেলেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় নামলেন না। এ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্য ও বৈষম্য-বঞ্চনার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত, যা নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লেগেছিল, ছয় দফার অনিবার্যতাও এতে আপনিই প্রমাণিত হলো।
নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণের কাছে ছয় দফা তুলে ধরার জন্য বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের ময়দানের বিশাল জনসভায় আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করার আহ্বান জানান। প্রতিদিনই তাঁকে নানা সভা, সংবাদ সম্মেলন বা এমনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল। এর মধ্যে ১৭ অক্টোবর দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে নৌকা গ্রহণ করেন—সেই চুয়ান্নর ভূমিধস বিজয়ের স্মৃতিবাহী যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক। ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক সম্প্রচার শীর্ষক বক্তৃতামালার অংশ হিসেবে পাকিস্তান টেলিভিশন ও রেডিও পাকিস্তানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি বিস্তারিতভাবে দুই প্রদেশে বৈষম্য এবং পূর্ব বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ ও বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে ছাত্রদের ১১ দফা কর্মসূচিকে ৬ দফার অন্তর্গত উল্লেখ করে এর পক্ষে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
সাধারণ নির্বাচনের আগে নভেম্বরেও এক বেতার ভাষণে তিনি পুনরায় বিস্তারিতভাবে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং শোষণ-নিষ্পেশনে বাংলার করুণ চিত্র তুলে ধরেন। সেই সময়েও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী দল ইসলামবিরোধিতার ধুয়া তুলেছিল। প্রত্যুত্তরে এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রসুলে করিম (দ.)–এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র।’
কেন তিনি জোট গঠন না করে এককভাবে আওয়ামী লীগের ব্যানারে নির্বাচন করছেন, সেই সমালোচনার জবাবে তিনি অতীতে যুক্তফ্রন্ট ও পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক আমলের তিক্ত স্মৃতির কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন জনগণের রায় নিয়ে জাতীয় পরিষদে এলে প্রয়োজনে তিনি ঐক্যজোট গঠন করবেন। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধি ছিল স্পষ্ট—‘এ দেশের ভাগ্যাহত মানুষের ভাগ্য প্রণয়নের দায়িত্ব বাংলার মাটি হতে অঙ্কুরিত আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে।’ এ লক্ষ্য পূরণে তাঁর স্বপ্ন, ক্ষমতার মসনদে বসা নয়। তিনি কৃষিবিপ্লব, শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশ, শ্রমিকের ন্যায্য হিস্যা আদায় ইত্যাদির ওপরও জোর দিয়েছিলেন।
৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করল—পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে পূ্র্বপাকিস্তানে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টির মধ্যে ২৮৮টি আসনে বিজয়ী হন দলের প্রার্থীরা। পরে জাতীয় পরিষদের ৭টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ১২টি মহিলা আসনও আওয়ামী লীগের পক্ষে আসে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নির্বাচনে চট্টগ্রামের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সাধারণ নির্বাচনে এত বড় ম্যান্ডেট আর কেউ কখনো পেয়েছে কিনা সন্দেহ। অতএব ছয় দফার ভিত্তিতে যে সংবিধান প্রণীত হবে, এ সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ রইল না।’
মানুষ ভেবেছে এক, ঘটেছে অন্য রকম। তবে সে অন্য রকম যে কল্পনারও বাইরে ছিল, তা নয়। বাঙালি নেতার হাতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং ছয় দফার বাস্তবায়ন—এ দুই ছিল কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমা নেতাদের কল্পনার বাইরে। এবার রঙ্গমঞ্চে মূল খলনায়কের ভূমিকা নিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি গোপনে ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁর খেলা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু এই সময় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে দক্ষ পাইলটের মতো দল ও জাতিকে নিয়ে এগিয়েছেন। দলীয় সাংসদদের তিনি ছয় দফার প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্যের শপথ করিয়ে নেন।
২৮ জানুয়ারি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন, কোয়ালিশন সরকার গঠনও তাঁর অ্যাজেন্ডায় ছিল—এমনটা তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন! তিন দিনের আলোচনা প্রত্যাশিতভাবেই ব্যর্থ হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকেন। এর দুদিন পরে ভুট্টো এটি বর্জনের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হন না, সংঘাতের ইশারাও দেন। এতে স্বভাবতই বাংলার জনগণ ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে তীব্র অসন্তোষে ফেটে পড়ে।
১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বিবৃতি দিয়ে ভুট্টোর দাবিকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
দুই প্রদেশের দুই নেতার পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও অবস্থানের মধ্যে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। রেডিওতে ঘোষণাটি আসার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রজনতা রাজপথে নেমে আসে। ষড়যন্ত্র ও বাধার মুখে বিক্ষোভ যেমন উত্তাল হয়েছে, তেমনি তাদের দাবিও হয়েছে চূড়ান্ত লক্ষ্যে অবিচল। এবার পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের দাবিতে মুখর হয়ে উঠল। তারা ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আঁতাতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ কায়েমের দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করল। সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেরিয়ে এবার যেন দেশের সহস্র নদীর কল্লোলিনী স্রোতের মতো রাজপথের জনসমুদ্র বজ্রকঠিন গর্জন তুলে স্বাধীনতার মোহনার লক্ষ্যে এগিয়ে চলল।
আবুল মোমেন: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত