মে ১৯৭১। আগরতলার ক্রাফট হোস্টেলের শরণার্থী শিবিরে আমাদের কাছে সংবাদ পৌঁছায়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ এবং বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে ও স্বাধীনতার সপক্ষে তাদের সমর্থন আদায়ের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জুন মাসে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে এবং এ সূত্র ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হবে। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রথম প্রতিনিধিদল। দলের নেতৃত্ব দেবেন জাতীয় সংসদ সদস্য আবদুস সামাদ এবং অপর দুই সদস্য ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক দেওয়ান মাহবুব আলী ও আমি।
সত্তরের দশকে বিশ্ব দুই পরাশক্তির প্রভাববলয়ে বিভক্ত ছিল—যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন ও মাওবাদী চীনের নেতৃত্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ অবলম্বন করেছে এবং তারা গণহত্যার প্রতিবাদ জানাবে না। নিক্সন প্রশাসনের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গণচীনের সঙ্গে মৈত্রীর ভূ-রাজনৈতিক কৌশল অধিকতর গুরুত্ব পায়। জুলাই মাসে কিসিঞ্জার পাকিস্তান সফরকালে অসুস্থতার ভান করে পাকিস্তান থেকে বেইজিং সফরে যান এবং আনুষ্ঠানিক মার্কিন-চীন সমঝোতার পথ উন্মুক্ত করেন। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের এই উপকারের প্রতিদানে রিচার্ড নিক্সন কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ-সংক্রান্ত পলিসি পেপারে নিজ হাতে লেখেন ‘To all hands, don’t squeeze yahya at this time, R.N.’
এই পটভূমিতে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারের কাছে অপর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। মে-জুন অবধি সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশবিষয়ক অবস্থান যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল না। অবশ্য গণহত্যা শুরুর পর সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ইয়াহিয়া খানকে লিখিত প্রকাশ্যপত্রে নির্যাতন বন্ধ এবং সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করে রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান। এ জন্য বুদাপেস্টের শান্তি সম্মেলনে ভি কে কৃষ্ণ মেননের নেতৃত্বে কয়েকজন লোকসভার সদস্য, সিপিআইয়ের সম্পাদক ভুপেশ গুপ্তসহ একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করা হয়।
হাঙ্গেরি যেতে হলে পাসপোর্ট দরকার। আমাদের তিনজনের জন্য হলুদ মোড়কে আইডেনটিটি সার্টিফিকেট-সংবলিত ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ভারত সরকার প্রত্যয়ন করে, আমরা ভারত-বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির দপ্তর ১৪৪, লেনিন সরণিতে জন্মগ্রহণ করেছি। পরিবারের নিরাপত্তার জন্য আমাদের নাম পরিবর্তিত হলো—আবদুস সামাদ হলেন আবদুস সামাদ আজাদ (এ নামটি তিনি আমৃত্যু বহন করেছেন), আমার নাম গোলাম সারওয়ার ও দেওয়ান মাহবুব আলী মাহবুবুল আলম। দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যেহেতু ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, সুতরাং ভারতীয় প্রতিনিধিদল লোকসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উদ্বাস্তু সমস্যার সূত্র ধরে গণহত্যার প্রতিবাদ করবে। আমাদের সঙ্গে পৃথক আলোচনায় জানালেন, আপনারা নিশ্চয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে বক্তব্য দেবেন। আমাদের দায়দায়িত্ব বেশ বেড়ে গেল।
বুদাপেস্ট সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় এক হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারা এবং পশ্চিম ইউরোপের লিবারেল ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলগুলোর সংসদ সদস্য ও নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের প্লেনারি অধিবেশনে বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশচন্দ্র ও কৃষ্ণ মেনন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান সরকারের গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করলেন। দুটি পৃথক অধিবেশনে আবদুস সামাদ ও আমি বাংলাদেশের গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে জানাই, এটি আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই। তবে, সম্মেলনে রমেশচন্দ্র ও কৃষ্ণ মেননের বক্তব্য অনুযায়ী প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
সুতরাং, আমরা সম্মেলনে বিরতি ও হোটেল লবিতে তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিরামহীন আলাপ-আলোচনা চালাই। কিছুটা সাহসের সঙ্গে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে একটি স্বাক্ষর অভিযান চালাব। একটি খসড়া বিবৃতি তৈরি করলাম। এ বিবৃতিতে নির্বাচনের রায় অস্বীকার করা, গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বাধীনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, এ বিষয়গুলো স্থান পায়। তবে, ভারতের কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির তরুণ নেতারা জানালেন, তাঁরা এই খসড়া প্রস্তাবে স্বাক্ষর সংগ্রহ করবেন না। কারণ, এ ধরনের দলীয় সিদ্ধান্ত তাঁদের নেই।
অথচ আমরা এ ধরনের সম্মেলনে একবারে নতুন। অবশেষে সিপিআইয়ের সম্পাদক ভুপেশ গুপ্ত নানা প্রশ্নোত্তরের পর সিপিবির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তিনি সবাইকে স্বাক্ষরে নামার পক্ষে মত দেন। আমরা বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০টি স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে সমর্থ হই। বুদাপেস্ট সম্মেলনের পর মস্কো, ওয়ারশ ও বার্লিনে আলোচনার জন্য যাত্রা করি। এসব শহরে কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়। তাঁরা গণহত্যার বিরোধিতা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে সম্মতি জানান, কিন্তু স্বাধীনতার প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। আমাদের লক্ষ্য ছিল, স্বাধীনতার পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আদয় করা। পরিস্থিতির জটিলতা সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর এবং বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশচন্দ্রকে জানালাম।
ডি পি ধর ভারতীয় দূতাবাসে বুদাপেস্ট সম্মেলন থেকে প্রত্যাগত প্রতিনিধি ও সোভিয়েত পার্টির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালেন এবং আমাকে সিপিবির প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করলেন। ডি পি ধরের বক্তব্য তাঁদের দ্বিধা দূর করার বিষয়ে ভূমিকা রাখে। তিনি কূটনৈতিক আচারের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই আমাদের বক্তব্যটিই তুলে ধরেন। দুই মাস পর ডি পি ধর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়ে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতাবিষয়ক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ডি পি ধর মস্কোতে তাঁর অভ্যর্থনা আয়োজনের পর জানান, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তির খসড়া আলোচিত হচ্ছে এবং এই চুক্তি সম্পন্ন হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করবে বলে তাঁর বিশ্বাস এবং তাঁর মনে হয়েছে, আমাদের আলোচনা চুক্তি চূড়ান্তকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অবশ্য তাঁর মতে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ের পক্ষেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে গণচীনের অবস্থান তাত্পর্যপূর্ণ হতে পারে। বস্তুতপক্ষে পাকিস্তান হয়ে কিসিঞ্জারের বেইজিং সফর এবং চীন-মার্কিন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টির পর দ্রুততার সঙ্গে আগস্ট মাসে সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়।
প্রায় দুই সপ্তাহ বিদেশে প্রচারাভিযান চালানোর পর দিল্লি হয়ে আগরতলায় ফিরতে হয়। তবে, দেওয়ান মাহবুব আলী দুই দিন পর ফেরার পরিকল্পনা করেন এবং কলকাতার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে আকস্মিক হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আমার ধারণা, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে আমাদের আলোচনা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে তাদের দৃঢ় সমর্থন লাভে সহায়ক হয়েছে। এরপর মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার আরও দুটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে—জাতিসংঘে ও যুক্তরাজ্যে দলপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও আবদুস সামাদ আজাদ। পাকিস্তান আমলে স্বল্পসংখ্যক ছাত্র শিক্ষালাভের বৃত্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যে অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যে সিলেটের অনেক অধিবাসী বসবাস করত। তারা যুক্তরাজ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনমত সৃষ্টি এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহায্য সংগ্রহে সংগঠিত প্রয়াস চালায়। বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি ছাত্র ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের সামনে মানববন্ধন করে, নিয়মিত নিউজলেটার প্রকাশ করে এবং পত্র প্রেরণ করে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এনায়েত করিম, শামসুল বারী ও মুহম্মদ ইউনুস। এস এ জালাল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জাপানে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করেন এবং প্রবাসী সরকারের দূতের মর্যাদা পান। অবশ্য বিদেশে জনমত সৃষ্টির বিষয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাংবাদিকদের ভূমিকা সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ। নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে তাঁদের হূদয়গ্রাহী প্রতিবেদন সারা বিশ্বে সাড়া জাগায়। অসমসাহসী সাংবাদিক সাইমন ড্রিং, আরনল্ড জেটলিন ২৫ মার্চ গণহত্যার সময় জীবন বাজি রেখে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। টাইম, নিউজউইক, ডেইলি টেলিগ্রাফ, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও জার্মান রেডিও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সর্বোপরি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ঝটিকা সফর বিশ্ব জনমত সৃষ্টিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়।
ডা. সারওয়ার আলী: সংস্কৃতিসেবী, ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত