বিজ্ঞাপন
default-image

এখন তৈরি করতে হবে ঘোষণালিপি। ট্রান্সমিটার ভবনের অফিসকক্ষের টেবিলটা পূর্ণ দখলে। একখণ্ড কাগজে লিখেছিলাম, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

আবুল কাসেম সন্দ্বীপ বলেছিলেন, বেলাল ভাই, “বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র” বললে ভালো হতো না?’

বেশ তো, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। লেখার মাঝখানে তীরচিহ্ন দিয়ে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি লিখেছিলাম। অবশ্য দুই দিন পরই ২৮ মার্চ কেন্দ্রের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল মেজর জিয়াউর রহমানের বরাত দিয়ে লে. শমশেরের প্রস্তাবক্রমে।

কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে স্টুডিওতে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখনই টেলিফোন বেজে উঠেছিল। অন্য প্রান্ত থেকে দ্রুত এবং চাপা কণ্ঠ ভেসে এসেছিল।

বেলাল সাহেব, আপনারা দেরি করছেন কেন? যা পারেন, প্রচার শুরু করে দিন। এখন সাড়ে সাতটা। লোকেরা রেডিওর কাঁটা ঘোরাচ্ছে। পৌনে আটটা বাজলেই ‘আকাশবাণী’ ধরবে। আপনাদেরটা কেউ শুনবে না—বলেছিলেন বার্তা সম্পাদক সুলতান আলী। তিনি দু-একটা সংবাদ-তথ্যও বলে দিয়েছিলেন।

ঠিক সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছিল: স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।

একই নাম ঘোষণা পরে আবদুল্লাহ আল ফারুক ও সুলতানুল আলমের কণ্ঠেও প্রচারিত হয়েছিল সেই অধিবেশনে। ডাক্তার আনোয়ার আলীর কাছ থেকে পাওয়া হ্যান্ডবিলটিও বারবার প্রচারিত হয়েছিল আমাদের বিভিন্ন কণ্ঠে। বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত ‘জরুরি ঘোষণা’ এবং কবি আবদুস সালামের ভাষণ।

অধিবেশন চলাকালে আমি স্টুডিওতে ছিলাম। খুদে স্টুডিও। জরুরি অবস্থায় কাজ চালানোর উপযোগী কেউ একজন আমাকে হাতের ইশারায় বাইরে ডেকে নিয়েছিলেন। স্টুডিওর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুজন আগন্তুক। একজন আমার পূর্বপরিচিত ডাক্তার আবু জাফর, অন্যজন এম এ হান্নান। বলেছিলেন, আপনারা মাইকে আমার নাম ঘোষণা করুন। আমি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করব।

জি, আচ্ছা। তবে একটা কথা, আপনার নামটা প্রচার করা হবে না। আপনি নিজের কণ্ঠে শুধু এটি পাঠ করবেন।

কেন? দুপুরবেলা আমি তো আমার নামসহ এটি প্রচার করেছিলাম। এখন অবশ্য বক্তব্যটি একটু বড় করে লেখা হয়েছে।

বলেছিলাম, দুপুরবেলা আপনি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণাপত্রটি প্রচার করেছিলেন। এখন তা নয়। এখন থেকে এ হচ্ছে একটি গুপ্ত বেতারকেন্দ্র। এখান থেকে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। তাই কোথায় এর অবস্থান, তা আমরা শত্রুদের জানাতে চাই না। জানলেই বিপদ। সহজেই ওরা আক্রমণ করতে পারবে। এমনিতেও তারা যন্ত্রের (ম্যাগনেটিক ওয়েভ) সাহায্যে আমাদের অবস্থান জানতে পারবে। তবে তার জন্য তাদের কিছুটা সময় লাগবে।

default-image

আরও বলেছিলাম, চট্টগ্রামের শ্রোতারা কিন্তু আপনার কণ্ঠস্বর ঠিকই চিনতে পারবেন।

এম এ হান্নান মেনে নিয়েছিলেন এবং নাম ঘোষণা ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করেছিলেন বেতারে নিজের কণ্ঠে দ্বিতীয়বার।

প্রায় আধা ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল এই সূচনা অধিবেশন। প্রক্ষেপণের কাজে নিজের ইচ্ছায় এসে যোগ দিয়েছিলেন মেকানিক আবদুশ শুকুর। কালুরঘাট পর্যায়ে তিনি শেষ দিনটি পর্যন্ত প্রকৌশলিক সহযোগিতায় নিয়োজিত ছিলেন।

অফিসকক্ষে শুধু আমরা দুজন। আমি ও মেজর জিয়াউর রহমান। বলেছিলাম: আচ্ছা, মেজর সাহেব, আমরা তো সব ‘মাইনর’, আপনি ‘মেজর’ হিসেবে স্বকণ্ঠে কিছু প্রচার করলে কেমন হয়?

কথাটা ছিল নিতান্ত রসিকতা। তিনি নিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হিসেবে। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন: হ্যাঁ। কিন্তু কী বলা যায়, বলুন তো!

আমি এক পাতা কাগজ এগিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি নিজের পকেট থেকে কলম হাতে নিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি লিখেছিলেন, I, Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh.

আমি তখন বলেছিলাম: দেখুন, ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে’ বলবেন কি?

তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। এরপর নিজের নামের শেষে তীরচিহ্ন দিয়ে লিখেছিলেন, ‘on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, ... ...

লেখকের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গ্রন্থ থেকে

বেলাল মোহাম্মদ: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক।

আজকের অনুভূতি

স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে ওঠেনি

রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিয়ে ভাবাবেগের চেয়ে এখন নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের সার্থকতা ও ব্যর্থতার কথাগুলো অকপটে বলে যাওয়াই সুকর্তব্য। ঐতিহাসিক সত্য এই, স্মরণকালে ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা বাঙালিদের মধ্যে প্রথমবারের মতো পূর্ণ বিকশিত হয়েছিল একটি জাতিসত্তা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একচ্ছত্র নেতৃত্বেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল। আর এতেই এর আগে ব্রিটিশ-ভারতে উসকানিপ্রাপ্ত ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারত্ব প্রমাণিত হয়েছিল। অধিকন্তু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে একটি শোষণমুক্ত ও সর্বজনীন কল্যাণরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়েছিলাম।

কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টোটি। স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিককে স্বনির্ভর এবং জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত না করা গেলে সেটা নিঃসন্দেহে আমাদের অস্তিত্বের সংকট। ‘শরীরের সব রক্ত মুখে’—উঠে আসার মতো তিলোত্তমা শহর-নগর গড়ার শোডাউন নিতান্তই জতুগৃহ, নিছক তাসের ঘর।

১৯৭১ সালের একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং কষ্টার্জিত স্বাধীন দেশের এক আশাবাদী নাগরিকের চোখে আজ এটা সুস্পষ্ট যে, দীর্ঘ ৪০ বছরেও আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে ওঠেনি।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত