১৯৫৮ সালের অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরি হয়। এর আগে পাঞ্জাবি সামরিক-আমলাচক্র এক যুগ ধরে পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় যে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছিল, তাতে মানুষ অনিশ্চয়তায় ভুগছিল। এ অবস্থায় আইয়ুব খান প্রাথমিকভাবে কিছু গণসমর্থনও পেয়ে যান; কিছু জোগাড় করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আইয়ুবের স্বৈরতান্ত্রিক ও পূর্ব বাংলার স্বাধিকারবিরোধী চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম বড় ধরনের প্রতিবাদ গড়ে তোলে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে—এটিই ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলগুলো ‘কপ’ নামে এক মোর্চা গঠন করে। এতে কট্টরপন্থী জামায়াত ও নেজামে ইসলামী একত্র হয় জাতীয়তাবাদের ধারক আওয়ামী লীগ ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার ন্যাপের সঙ্গে। ফাতেমা জিন্নাহ ছিলেন কপের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। এই নির্বাচন সামনে রেখে পূর্ব বাংলায় যে প্রচারাভিযান চলে, তাতে জনগণের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’দের বশে রেখে এবং ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে আইয়ুব খান আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেন। কিন্তু এই যুদ্ধের সময়েই পূর্ব বাংলার মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পারে যে বাস্তব অবস্থায় ‘পাকিস্তান’ নামের রাষ্ট্রের সঙ্গে তারা সম্পর্কহীন।
এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। পূর্ব বাংলার প্রবীণ নেতারা এতে সাড়া দেননি; পশ্চিম পাকিস্তানিরা তো নয়ই। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা—আতাউর রহমান খান, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবদুস সালাম খান প্রমুখও ৬ দফার বিরোধিতা করেন। পরের মাসেই আওয়ামী লীগের মূলধারার নতুন কমিটি হয়—সভাপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান, সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ।
নেতাদের মধ্যে দ্বিধা থাকলেও পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক কর্মীরা ৬ দফাকে কেন্দ্র করে স্বাধিকারের সংগ্রামে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন হরতাল চলাকালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক মনু মিয়া শহীদ হন; বাংলার মানুষের রক্ত মিশে যায় ৬ দফার সঙ্গে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের সব প্রধান নেতাকে পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার, সারা দেশে দমন-পীড়ন, ইত্তেফাক বন্ধ ও সম্পাদক মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার ইত্যাদি করেও আন্দোলন থামানো যায়নি। ১৯৬৭ সালে পিডিএম গঠন করে পাকিস্তানের কট্টর ও রক্ষণশীল নেতারাও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। মস্কো-পিকিং বিরোধ এবং স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুতে ন্যাপ ভেঙে যায় (ডিসেম্বর ১৯৬৭)। এর মোজাফ্ফর আহমদ নেতৃত্বাধীন অংশ পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের আন্দোলনে যোগ দেয়।
১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। ৩৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী ও রাজনীতিক ছিলেন। শুরু থেকেই আগরতলা মামলার তথাকথিত বিচারের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল।
এ পটভূমিতে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে গঠিত হয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে এতে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের দুই অংশ, এমনকি সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন এনএফএফের একাংশ সমবেত হয়। পরের মাসে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ও আওয়ামী লীগের ৬ দফার মতোই ১১ দফা বাংলার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের মধ্যস্তরের নেতা ও বিপুল কর্মিবাহিনী এবং ন্যাপের কর্মীদের নিয়ে এই ছাত্রসংগ্রাম পরিষদই ছিল প্রকৃতপক্ষে উনসত্তরের আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী নেতারা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বের কাছে ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ল। এ অবস্থায় পিডিএম কার্যত ভেঙে যায়। তবে পরের বছর (জানুয়ারি ১৯৬৯) এই দলগুলো আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি (ডাক)। গণ-আন্দোলনের শুরুর দিকে ডাক খানিকটা সমন্বয়কারীর ভূমিকায় ছিল।
১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে জনসভা শেষে তৎকালীন গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। পরদিন এর প্রতিবাদে হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে তিনজন বিক্ষোভকারী শহীদ হন। বলা যায়, এরপর থেকে হরতাল, বিক্ষোভ, পুলিশের লাঠিপেটা প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়।
ঢাকা শহরে এই বিক্ষোভের মূল কেন্দ্র ছিল দুটি এলাকা। ছাত্রদের মূল জমায়েত হতো কলাভবনের বটতলা থেকে শহীদ মিনার এলাকায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মূল জমায়েত ছিল বায়তুল মোকাররম চত্বরের খেলার টিকিট বিক্রির কাউন্টারের সামনে থেকে (বর্তমান মূল প্রবেশপথের সামনের চত্বর) সে সময়ে গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে রাখা মীর জুমলার কামান পর্যন্ত। বড় জমায়েতগুলো হতো পল্টন ময়দানে। ওই দুই অঞ্চলে ঢাকা শহরের অলিগলি থেকে প্রতিদিন শত শত মিছিল আসত। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল ও সমাবেশ, পুলিশের লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, বিক্ষোভকারীদের দিক থেকে পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল ছুড়ে মারা, রায়ট কার দিয়ে গরম রঙিন পানি নিক্ষেপ ইত্যাদি চলতে থাকে দিনের পর দিন।
১৯৬৯-এর ২০ জানুয়ারি এ রকম একটি সংঘর্ষ চলছিল মেডিকেল কলেজের সামনে। সেখানে দুপুরের পর পুলিশ গুলি চালালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র আসাদুজ্জামান ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এ ঘটনায় গণ-আন্দোলন যেন স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু এসব দমন-পীড়ন এবং ভীতি প্রদর্শন আন্দোলনকে স্তিমিত করতে পারেনি। বরং এই আন্দোলন দ্রুত ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শহরে একাধিক বিক্ষোভকারী শহীদ হন।
২৪ জানুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা সচিবালয় ঘেরাও করে। পুলিশ সচিবালয়ের অভ্যন্তর থেকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলে জনতা সচিবালয়ের গেটে অগ্নিসংযোগ করে এবং দেয়াল ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। সচিবালয়ের রাস্তার অপর পাশে রেলওয়ে কলোনি বস্তিতে (বর্তমান ওসমানী উদ্যান) বিক্ষোভকারীরা জমায়েত হয়। এখানেই ১ নম্বর গেটের উল্টো দিকে পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ১৪ বছরের কিশোর শেখ রুস্তম আলী। যতটা মনে পড়ে, রুস্তম আলী সে সময় ঢাকায় ঘুরতে এসেছিলেন। রুস্তম আলীর লাশ নিয়ে জনতার বিক্ষোভের সময় পুলিশ আবার গুলি চালায়। ওখানে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান শহীদ হন। সে সময়ের প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ অনুসারে ওখানে আরও দুজন শহীদ হয়েছিলেন—একজন ১৫ বছর বয়সী মহিবুল, অন্যজন অজ্ঞাতনামা। পুলিশ এ দুজনের মরদেহ সচিবালয়ের মধ্যে নিয়ে গুম করে ফেলে।
এরপর পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শহীদদের জানাজায় লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ হয়। রক্ষণশীল সংবাদপত্রগুলোও সারা শহরে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক বলে দাবি করে। সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ -এর কার্যালয় পুড়িয়ে দেয় জনতা এবং শাহবাগের মুসলিম লীগ অফিস (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপণি) তছনছ করে ফেলে। ঢাকায় সেনাবাহিনী তলব করে ২৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু এসব দমন-পীড়ন গণ-আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরে বাধা দিতে পারেনি।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি আন্দোলনের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দী অবস্থায় পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে। পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের জানাজা শেষে জহুরুল হকের লাশ আজিমপুর নেওয়ার পথে সচিবালয়ের পাশের এক মন্ত্রীর বাসভবন থেকে (বর্তমান শিক্ষা ভবনের পাশে) আবার পুলিশ গুলি চালালে একজন নিহত ও প্রায় অর্ধশত আহত হন। জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আগুন লাগিয়ে দেয় ওই অঞ্চলের তিন মন্ত্রীর বাসভবনে, মুসলিম লীগের একাধিক কার্যালয়, ঢাকা ক্লাব ও জিমখানা ক্লাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কয়েকটি জিপে।
এই তীব্র জনপ্রতিরোধের মুখে সরকার আপাতত নমনীয় হতে বাধ্য হয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিরোধী দলকে বৈঠকে বসার আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করার ইঙ্গিত দেয় সরকার। তবে তাঁর পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। আবার এরই মধ্যে ১৮ ফেব্রুয়ারি ইপিআরের গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হন।
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে সারা দেশ মিছিল ও বিক্ষোভের সমুদ্রে পরিণত হয়। কারফিউ জারি, সেনা মোতায়েন—কোনো কিছুতেই সরকার আর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়নি। এর মধ্যে আগরতলা মামলার এক বিচারকের বাসভবনে (বর্তমান পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের স্থানে) জনতা আগুন লাগিয়ে দেয়; বিচারক পলায়ন করেন।
অবশেষে ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সব অভিযুক্তকে নিয়ে বীরের বেশে বেরিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরদিন রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আহূত লাখ লাখ লোকের সমাবেশে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় ভূষিত করা হয়। বাংলার অবিসংবাদিত নেতারূপে জনতা তাঁকে বরণ করে নেয়। স্বৈরশাসক আইয়ুব গোলটেবিল বৈঠক ডেকে পরাজয়ই মেনে নিলেন। অর্জিত হলো ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত বিজয়। পূর্ব বাংলার মানুষ আরও এক ধাপ অগ্রসর হয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে।
সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ: উপাচার্য, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত