প্রায় সব রাজনৈতিক মত ও বিশ্বাসের একটি বৃহত্ জনগোষ্ঠীর ধারণা যে ছয় দফা একটা ফেডারেশনের বৃত্তে গতানুগতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি। এই ফেডারেশনে আগের অভ্যন্তরীণ, অর্থনৈতিক ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি তার নিজস্ব এখতিয়ারে থাকবে। অন্যান্য বিষয় যেমন: দুটি অঞ্চলের মধ্যকার ও তাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক আর্থিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যাপার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। স্বায়ত্তশাসনের গতানুগতিক ব্যবস্থা থেকে ছয় দফার কর্মসূচি আসলে চূড়ান্তভাবে আলাদা। এই কর্মসূচি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রসংক্রান্ত বিষয়াবলি।
আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ও বৈদেশিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা ও ব্যাংক নীতিমালা প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, রাজস্বনীতি (রাজস্ব আয়-ব্যয়সহ) এবং বৈদেশিক মুদ্রার অর্জন বা ব্যবহার আঞ্চলিক সরকারের অধীনে থাকবে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে মূলধন বা সম্পদ পাচার হবে না। তবে দুই অংশের মধ্যে একই মুদ্রা চালু থাকতে পারে (এমনকি দুই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত সব ধরনের পরিবহন ও যোগাযোগ-সংক্রান্ত বিষয়াবলি দুই আঞ্চলিক সরকারের অধীনে থাকবে)। তাই যে মুহূর্তে কর্মসূচিটি বিশদভাবে তুলে ধরা হলো, তখন পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল যে ছয় দফা অর্থনৈতিক ইউনিয়ন বা বৈদেশিক বাণিজ্য শুল্ক ইউনিয়ন বলতে যা বোঝায়, তা থেকে অনেক আলাদা।
দুই অঞ্চলের মধ্যে একই মুদ্রার চলন, এই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবহারিক বা কার্যকর গুরুত্ব নেই। যেমন দুই অঞ্চলের মধ্যে দেশজ পণ্যের মুক্তবাণিজ্য বহাল থাকলেও এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বিদেশি পণ্যের পুনরায় রপ্তানির বিষয়টি নিষিদ্ধ থাকবে। যেহেতু অংশ দুটির ভিন্ন ভিন্ন আমদানি শুল্ক বা বিধি থাকবে, সে কারণে নিম্ন শুল্ক অঞ্চল থেকে উচ্চ শুল্ক অঞ্চলে পুনরায় রপ্তানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক অঞ্চলের শুধু রাজস্বের ক্ষতিই হবে না, উপরন্তু তাদের শিল্প-কলকারখানাগুলোকে বৈদেশিক প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করা যাবে না। এভাবে শিল্পায়নের প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দুই অংশের বাণিজ্যিক পণ্যের রুলস অব অরিজিন অর্থাত্ বিদেশে তৈরি, তা প্রমাণ করার জন্য যে প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ ও তদারকি দরকার হবে, তা-ও দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চলের মতোই।
একটি অঞ্চলের নিজস্ব পণ্যের অন্য অঞ্চলের অবারিত বাজারজাত ব্যাহত বা সীমিত করা যাবে, যদি দ্বিতীয় অঞ্চল বিদেশ থেকে অপেক্ষাকৃত সস্তা পণ্য আমদানি করে। আবার একটি অংশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে অন্য অংশে নতুন শিল্পকে রক্ষা করার জন্য তাকে কাঁচামাল কিংবা উত্পাদিত পণ্যে ভর্তুকি দিতে হবে। প্রতিটি অঞ্চলের বৈদেশিক শুল্কহার পৃথক হবে। প্রতিটি অঞ্চলের তার উপার্জিত বৈদেশিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য বিভিন্ন সেবা এবং তা থেকে উদ্ভূত বৈদেশিক আয় বা রেমিট্যান্স-জাতীয় অন্যান্য আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত ব্যয়ের হিসাব রাখা এবং এর পর্যবেক্ষণ ও তদারকির প্রয়োজন হবে।
এই হিসাবব্যবস্থায় আঞ্চলিক বাড়তি বা ঘাটতি মেটাতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। অন্যথায় যদি একই মুদ্রায় ঘাটতি মেটানো হয়, তাহলে সেই পন্থায় উদ্বৃত্তাঞ্চল থেকে ঘাটতি অঞ্চলে সম্পদের পাচার হবে। সম্পদের এ ধরনের স্থানান্তরের বিষয়টি ছয় দফায় স্পষ্টভাবে নাকচ করা হয়েছে।
একই মুদ্রাব্যবস্থায় যদি বিভিন্ন অঞ্চলে সুদ ও ঋণদানের বিধিতে পার্থক্য থাকে, তাহলে ঋণগ্রহীতা ও ব্যবসায়ীরা অল্প সুদ-অঞ্চল থেকে ধার করে অধিক সুদ-অঞ্চলে নিয়োগ করবেন। এতে করে আঞ্চলিক মুদ্রানীতি-সুদনীতি ব্যাহত হবে। তা ছাড়া মুদ্রা পাচার হতে পারে। দুই অঞ্চলের বিভিন্ন শিল্প-ব্যবসা অথবা একই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে তহবিলের আদান-প্রদান ও লেনদেন হয়। এ কারণে সব ধরনের তহবিল প্রবাহের বিষয়টি পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। ছয় দফায় একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক) পাশাপাশি দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংকের কথা উল্লিখিত হয়েছে। আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংকের কাজ হবে প্রতি অঞ্চলের ঋণ, সুদ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নীতিমালা নির্ধারণ ও প্রয়োগ করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হবে আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংকের অনুরোধে চাহিদা অনুসারে টাকা ছাপানো। আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক দুটির আয়-ব্যয়, হিসাব মেলানোর দায়িত্ব বর্তাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংক আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নীতিনির্ধারণী ভূমিকা নেই। দুই অঞ্চলের মধ্যে একই মুদ্রাব্যবস্থার আর একটি সমস্যা; তৃতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে দুই অঞ্চলের একই বিনিময়মূল্য থাকত হবে।
যদিও ভিন্ন অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে, আয়-ব্যয়ের ব্যাপারের কারণে আঞ্চলিক অসমতা দেখা যেতে পারে। সে কারণে বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও অসমতা দেখা যেতে পারে। অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক ইউরো জোনের যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তা উপরিউক্ত বিষয়টিকেই স্পষ্টতর করে। এটি সবাই মানছেন যে শুধু অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো জোনে কখনোই টিকবে না; যদি না সেখানে একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক নীতিমালাও থাকে।
ছয় দফা কর্মসূচির আরও দুটি প্রেক্ষিত আছে, যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা ও অবাস্তবতা প্রকাশ পায়। এক. কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় অর্থায়নের ব্যবস্থা; দুই. প্রতি অঞ্চলের বন্দোবস্ত। আঞ্চলিক আধা সরকারি বাহিনীর কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থের নিজস্ব কোনো উত্স থাকবে। স্থানীয় কি বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয়ের পরিমাণ নির্ভর করবে দুই অঞ্চল কর্তৃক অর্থ প্রদানের ওপর। সংবিধানে লিখিত থাকবে দুই অঞ্চলের অর্থ প্রদানের বাধ্যবাধকতা ও তার অনুপাত। কেন্দ্রীয় সরকারের মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশ প্রদানে রাজি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। তবে এতে একটা ফাঁকও ছিল। যদি পূর্ব পাকিস্তান এই অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানাত, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুই করার ছিল না।
পূর্ব পাকিস্তান যদি বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিত, তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কার্যকর এবং দুই অংশকে সংযুক্ত রাখার সামর্থ্য বা সক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের ছিল না। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারে (আইনি ও নির্বাহী অংশে) জনসংখ্যার ভিত্তিতে দুই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করার ব্যবস্থা ছিল। অপরটি ছিল সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রেও বাহিনীর আকার, শক্তি বা কাজ তাদের ব্যবহার করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুমোদন লাগত। কেন্দ্রীয় সরকারে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণেই তার বিরুদ্ধে ব্যবহূত হতে পারে, এমন আশঙ্কায় সামরিক বাহিনীর যেকোনো নিয়োগই তারা ঠেকিয়ে দিতে পারত।
উপরন্তু এমন একটি সম্ভাবনা আরও কম ছিল এই কারণে যে ছয় দফা কর্মসূচির অধীনে পূর্ব পাকিস্তান তার নিজস্ব সেনা বা আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে পারত; যার আকার, শক্তি ও কাজ পুরোপুরি পূর্ব পাকিস্তানই নির্ধারণ করত। এ জন্য যে কেউ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা যে আঙ্গিক থেকেই দেখা যাক না কেন, ছয় দফার কর্মসূচি মূলত ছিল শিথিল ও ভঙ্গুর বন্ধন; এটা হলো দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, যার অস্তিত্ব বা টিকে থাকা পুরোপুরি তাদের সদিচ্ছার ওপরই নির্ভরশীল।
জনমানসে ছয় দফা কর্মসূচি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। ব্যাপক অর্থে মনে করা হতো, ছয় দফা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানকে তার বৈদেশিক বাণিজ্য ও মুদ্রা অর্জন তথা রাজস্ব ও কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। ছয় দফার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছিল জটিল, কৌশলগত এবং সাধারণের কাছে তা সে অর্থে বোধগম্য ছিল না।
পাকিস্তানের সংবিধান ছয় দফার ভিত্তিতে রচিত হবে, বঙ্গবন্ধুর এমন সিদ্ধান্তের পর তিনি আমাকে ও আমার কয়েকজন সহযোগীকে এই কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এবং সংবিধানে তার সংযোজন ও বাস্তবায়নের পথ খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
আমরা যেহেতু ছয় দফার কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিতভাবে কাজ করেছি, আমরা স্বাধীনতার অপর নাম।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ছয় দফাকে বাস্তব রূপ দিতে কয়েকজন রাজনৈতিক সহকারীসহ বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে আমাদের সঙ্গে সংবিধানে এর অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনায় প্রাসঙ্গিক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণাপুষ্ট পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এটা পরিষ্কার ছিল যে একবার যদি দুই অঞ্চলের জন্য স্বতন্ত্র মুদ্রাব্যবস্থা, রাজস্বব্যবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বা ব্যয়ব্যবস্থা তৈরি করা হয়, একই সঙ্গে সম্পদ বা মূলধন আঞ্চলিক পাচার বন্ধ করা হয় এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভিন্ন পথে যায় মুদ্রাস্ফীতির, তাহলে অভিন্ন মদ্রাব্যবস্থার এই উদ্যোগ ধোপে টিকবে না। এমনকি দেশজ পণ্যের ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের মধ্যে একটি অবাধ ও মুক্তবাণিজ্য-ব্যবস্থা, যা উল্লিখিত হয়েছে, তা-ই ব্যাহত হবে।
ছয় দফা বাস্তবায়নের অর্থ বুঝতে পাকিস্তানি নেতৃত্ব বিন্দুমাত্র ভুল করেনি। এমনকি ১৯৬৬ সালের একেবারে গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধু যখন এই ছয় দফার কথা প্রথম ঘোষণা করলেন, তাদের কাছে এই ছয় দফা বাস্তবায়নের অর্থ ছিল পরিষ্কার। এ কারণেই পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ঘোষণা করলেন, মুজিবের ছয় দফার মোকাবিলা করবেন তিনি এক দফাতে; সেটি হচ্ছে বন্দুকের নল। এর পরের কয়েকটি বছর শুধু বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ মেয়াদে কারারুদ্ধ করে রাখাই নয়, তাঁর অনুসারীদের ওপর দমন-পীড়ন, নির্যাতন চালিয়ে কারারুদ্ধ করেই শুধু নয়, ছয় দফার আন্দোলনকে নস্যাত্ করে দিতে পাকিস্তানি শাসকেরা যে সেনাশক্তিকে ব্যবহার করবেন, এ বিষয়ে তাঁরা মনস্থির করে ফেলেছিলেন। আর এ কারণেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী স্থিতিশীলতার নামে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তথাকথিত রাজনৈতিক সমঝোতা আলোচনা করার আড়ালে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
নুরুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান। বর্তমানে রিসার্চ ফেলো ইমেরিটাস, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএসপিআরআই)
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত