বিজ্ঞাপন
default-image

ফারুক আহমেদ ঢাকায় এসেছেন অনেকবার। গেল বছর তিনি প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আসেন। মুক্তিযোদ্ধা বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের নানা রোমাঞ্চকর ও বীরত্বগাথা ঘটনার বিবরণ শুনে তা বুকে লালন করেই বড় হয়েছেন তিনি। বাবার সেসব বীরত্বের কাহিনী শুনে আরও বেশি করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে জাগে তাঁর। সেই আগ্রহই তাঁকে টেনে নিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। একের পর এক সে সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দলিল, ছবি, অস্ত্রশস্ত্রসহ এটা-ওটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। হঠাত্ একটি ছবির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। বার কয়েকে একটি ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন। এরপর দেশের বাড়ি কুষ্টিয়ায় ফিরে গিয়ে বাবা মোকসেদ আলীকে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তিনি একটি ছবি দেখেছেন তাঁর বাবার মুখাবয়বের সঙ্গে ভীষণ মিলে যায়! মোকসেদ আলীও সেই ছবিটা দেখতে চান। তাঁর যেন আর তর সইছে না! ঢাকায় এসে সোজা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আসেন মুক্তিযোদ্ধা মোকসেদ আলী। সেই ছবি দেখেই তাঁর চোখের সামনে ভাসতে থাকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নানা স্মৃতির কথা। ‘আরে, এ তো আমারই ছবি’ সবাইকে বলতে থাকেন মোকসেদ আলী। মুক্তিযোদ্ধা মোকসেদ আলীর আরও একটি ছবির সন্ধান মেলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাঁর ছবির পাশে লিখে দেন মুক্তিযোদ্ধা মোকসেদ আলীর নাম। এরপর মোকসেদ আলীকে নিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেন ট্রান্সকম ফুডসের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্য আক্কু চৌধুরী। এর জন্য ঢাকায় এসে আক্কু চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান মোকসেদ আলী।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আহম্মদপুর গ্রামের মোকসেদ আলী। কাজ করতেন একটি লোহার কারখানায়। বিয়ে করেছেন, সংসারে আছে স্ত্রী আর দুটি ফুটফুটে সন্তান। ভালোই চলছিল তাঁর ঘরকন্না। সময়টা ১৯৭১ সাল, দেশে ভীষণ যুদ্ধ। প্রতিদিনই চারদিক থেকে আসছে মানুষ মরার খবর। এসব খবর মেনে নিতে পারেন না মোকসেদ আলী। রোজ সময় করে বাজারে যান, চুপি চুপি রেডিওতে খবর শোনেন, দেশের এখন কী হাল, তা জানার জন্য। সারা দেশে নির্বিচারে মানুষ হত্যার খবর শুনে তাঁর মনে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠতে লাগল। চিন্তা করলেন, আর হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই। দেশকে শত্রুমুক্ত করতেই হবে, তাতে হয় প্রাণ থাকবে নয়তো নয়। এমনই একটি সময় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বেতার তরঙ্গে ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর সেই অমর কবিতা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মোকসেদ আলী বুঝে গেলেন সামনে পথ একটিই, আর তা হলো যুদ্ধ। স্ত্রী আর সন্তানদের মায়া ছেড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। এরপর একের পর এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হতে লাগল। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিলেন তিনি। এরপর ৩০ মার্চ আনুমানিক ভোর চারটায় কুষ্টিয়ায় শত্রুপক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে অংশ নেন। এর কয়েক দিন পরই দেশের সীমান্ত পার হয়ে ভারতের বনগাঁর পেট্রাপোলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করে দেন। কাজের প্রতি তাঁর আগ্রহ আর দেশপ্রেম ছিল প্রবল। প্রশিক্ষকেরা তাঁর কাজে অত্যন্ত আস্থা পেতে শুরু করেন। মোকসেদ আলীর দুর্বার গতি আর স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে তাঁকে সীমান্তে নিরাপত্তারক্ষীর বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানেই তাঁর যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ছবি ক্যামেরাবন্দী করেন ভারতীয় ফটোসাংবাদিক অমিয় তরফদার। কিছুদিন পর কমান্ড প্রশিক্ষণের জন্য মোকসেদ আলী চলে যান দুর্গম এক পাহাড়ে। এই প্রশিক্ষণের পালা শেষ হওয়ার পর তিনি চলে যান ভারতের শিকারপুর ৮ নম্বর সেক্টরে। সেখানে বিশেষ দায়িত্বে থাকা মেজর মঞ্জুর রহমান তাঁকে ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলের প্রধান করে পাঠিয়ে দেন কুষ্টিয়ায়। উদ্দেশ্য, হানাদারদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত পোড়াদহ রেলস্টেশনটি উড়িয়ে দেওয়া। সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝে দিয়ে সামনে চলছেন মোকসেদ আলী। সময় রাত একটা। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। তীব্র আক্রমণ চালানো হলো শত্রুদের ওপর। আকস্মিক আক্রমণের জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিল না শত্রুপক্ষ। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান প্রায় শেষের দিকে। শত্রুরা কুপোকাত। ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই। কিন্তু এ পর্যায়ে ঘটে গেল একটি দুর্ঘটনা, হঠাত্ একটি গুলি এসে লাগল মোকসেদ আলীর বাঁ হাতের কনুইতে।

তীব্র যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে যান মোকসেদ আলী। পড়ার সময় বেকায়দায় পড়ে বাঁ পায়ের হাঁটুতেও প্রচণ্ড আঘাত লাগে তাঁর। ভেঙে যায় পায়ের হাড়। এরপরও থেমে যাননি মোকসেদ আলী। প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরপরই আবারও লেগে যান দেশকে শত্রুমুক্ত করার কাজে। ভারতীয় সীমান্তের কাছে মানিকনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর হূদয়পুর ক্যাম্পে অভিযান চালাতে যান ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে। কিন্তু এ যাত্রায় আর সফল হতে পারেননি তিনি। ভুল তথ্যের কারণে সবাইকে জমদূতের সাক্ষাত্ পেতে হয়। সামনেই ওত পেতে থাকা শত্রুরা সরাসরি গুলি চালায় এই দলটির ওপর। ফলাফল—বেঘোরে মারা পড়েন ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা। ভাগ্যের জোরে কেবল বেঁচে যান মোকসেদ আলী। সেখান থেকে ফিরে এসে আবারও চলে গেলেন নতুন অভিযানে দেশকে শত্রুমুক্ত করার নেশায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া ও সশস্ত্র সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরের কিছু অভিযানের কথা এভাবেই বর্ণনা করলেন মুক্তিযোদ্ধা মোকসেদ আলী।

প্রতিবেদক: মোছাব্বের হোসেন