বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের মার্চে শেষবার বাবা নূর মোহাম্মদকে দেখেছিলেন ছেলে মোস্তফা কামাল। তখন তাঁর বয়স মোটে আট বছর। বাবার সঙ্গে সাইকেলে চড়ার একটা ঘটনা আজও তাঁর মনে আছে। সাইকেলে চড়ার সময় তাঁর হাতে ছিল একটি কঞ্চি, তার খোঁচা লেগে নূর মোহাম্মদ শেখের কপাল কেটে যায়। রক্ত দেখে আঁতকে উঠেছিলেন মোস্তফা, বলেছিলেন, ‘দেখো, বাবা, কত রক্ত!’ উত্তরে বাবা সেদিন স্বগতোক্তি করেছিলেন, ‘আরও কত রক্ত ঝরবে!’ শিশু মোস্তফা এ কথার মর্মার্থ সেদিন বুঝতে পারেননি।

ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের চণ্ডীবরপুর ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামে। ছোটবেলায় মা-বাবা হারানো নূর মোহাম্মদ লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ১৯৫৯ সালে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর)। যশোরে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ল্যান্স নায়েক থাকার সময় স্বাধিকার সংগ্রামে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। ইপিআরেও লাগে তার ঢেউ। যশোরের ইপিআর দপ্তর হয়ে ওঠে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বের সদর দপ্তর। শার্শা উপজেলার একেবারে উত্তর প্রান্তে কাশিপুর সীমান্ত ফাঁড়িতে গড়ে তোলা হয় মুক্তিফৌজের ক্যাম্প।

default-image

কাশিপুর সীমান্ত ঘাঁটির অদূরে গুলবাগপুরের দায়িত্ব পান নূর মোহাম্মদ। কয়েক দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত নূর মোহাম্মদের কাছে ৫ সেপ্টেম্বর খবর পৌঁছায়, শত্রুবাহিনী কপোতাক্ষ পার হয়ে গুলবাগপুর ঘাঁটি দখল করতে এগিয়ে আসছে। গুলবাগপুর হাতছাড়া হলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে কাশিপুর ঘাঁটি। অসুস্থ শরীর নিয়েই বেরিয়ে পড়েন নূর মোহাম্মদ। সঙ্গী নান্নু আর মোস্তফা। কিন্তু অজান্তে তিন দিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনী, সংখ্যায় তারা শতাধিক। আর নূর মোহাম্মদরা মোটে তিনজন। অবশ্য আশপাশের গ্রামগুলোতে ততক্ষণে অবস্থান নিয়েছেন আরও জনাবিশেক মুক্তিসেনা। পিছু হটার পথও খোলা নেই। ভারী অস্ত্র বলতে একটি এলএমজি।

দুই ঘণ্টা ধরে অসম যুদ্ধ চলে। হঠাত্ মর্টারের আঘাতে গুঁড়িয়ে যায় নূর মোহাম্মদের হাঁটু, ডান কাঁধে আঘাত হানে আরেকটি গুলি। দুজন গুরুতর আহত, অক্ষত শুধু মোস্তফা, তিনিও ক্লান্ত। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নান্নু আর মোস্তফাকে ঘাঁটিতে ফেরত পাঠিয়ে দেন নূর মোহম্মদ। ততক্ষণে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধারাও পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ তীব্র করে। একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। নিজের জীবনের বিনিময়ে নূর মোহাম্মদ যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোদ্ধাদের এবং অস্ত্র রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। সহযোদ্ধারা তাঁকে কাশিপুরে সমাহিত করেন। পরে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। পাশের সাড়াতল বাজারে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কলেজ।

স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর এ বীরশ্রেষ্ঠর জন্মগ্রাম মহিষখোলার নাম হতে চলেছে নূর মোহাম্মদনগর। নূর মোহাম্মদের স্মরণে সরকার হাতে নিয়েছে আরও কিছু প্রকল্প, যার মধ্যে রয়েছে লাইব্রেরি ও জাদুঘর। প্রস্তাবিত নূর মোহাম্মদনগরেই এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইনস্টিটিউশন এমনকি দেখভাল করার মতো তেমন কোনো জনবল ও পরিবেশ না থাকায় পাশের ফেদি গ্রামে স্থাপনাগুলো নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। জেলা পরিষদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মহাবিদ্যালয়ের দান করা ১২ শতাংশ জমির ওপর এই স্থাপনাগুলো হচ্ছে। নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। গত ৭ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি ভবন উদ্বোধনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত