বিজ্ঞাপন
default-image

হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে এসেছি। এত উঁচু থেকে নিচের আদিগন্তবিস্তৃত নীল উপসাগরের কোনো ঢেউই আর চোখে পড়ে না। পাহাড়ি পাথরমাটি নানা রঙে ভরা; মাঝে মাঝে জলপাই বনের গাছগুলো কড়া রোদে ঝিমন্ত। ইতস্তত কয়েকটা ডুমুর ফলের গাছে তাজা ঘন বেগুনি রঙের ফলগুলো যেন কেউ হাত বাড়িয়ে পেড়ে না নেওয়ার অভিমানেই তলায় ছড়িয়ে রয়েছে। জীবনের খেলায় যোগ দিতে না পেরে ক্রন্দনপরায়ণ অভিযোগী শিশুর মতোই আছড়ে পড়েছে মায়ের বুকে; কোনো কোনোটা শুকিয়ে দেহত্যাগ করেই আবারও জীবনমূলে ফিরে গেছে। কোনোদিকে কোনো স্বর নেই, শব্দ নেই, এমনকি যেন আর হাওয়াও বইছে না।

পা ছড়িয়ে একটা গাছের গুঁড়িতে বসতে গিয়ে একটা পাথর গড়িয়ে নিচে পড়ে যেতে যেতে একটা বুনোগুল্মের মধ্যে আটকে গেল। আরো গড়িয়ে নিচে ওই সমুদ্রজলে পড়ে গেলেই যেন খুশি হতাম। একটা পাথরখণ্ড ছুড়ে দিলাম নিচে; কিন্তু না শুনলাম তার পড়ার আওয়াজ, না দেখলাম জলে কোনো ঢেউ। জিদ ধরে গেল। একটা, দুটো, ভারী আরো ভারী পাথর ছুড়ে ছুড়ে, নিস্তরঙ্গ জলে তার সংঘর্ষের আওয়াজ; তার সৃষ্ট ঢেউ না দেখে যেন স্বস্তি হলো না। তারপর একগুচ্ছ ডুমুর ফল পেড়ে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে খেতে শুরু করেছিলাম। তার ভেতরটা মিষ্ট। চিত্ হয়ে শুয়ে খেতে খেতে বহুদিন আগেকার আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল।

সে দেশও অনেক দিন হলো পেছনে ফেলে এসেছি। উত্তর-সাগরের ধারে, এক কিওর্তের জনপদ ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে বনে ঢুকে গিয়েছিলাম। বার্চ গাছগুলো যেন পরসেরর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগী। মাঝে মাঝে পাইন, ঝাউ, বুনো স্ট্রবেরিগুল্ম। কিওর্তের ধারে নোঙর করা জেলে-নৌকাগুলোর আশপাশে উড়ে চলা, কলরবমুখর কোলাহল কখন পেছনে মিলিয়ে গেছে। বনে যেন কোনোই শব্দ ছিল না। জুলাই মাসের মেঘঢাকা নীল আকাশের আলো মাঝে-মধ্যে গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে নেমে এসে ঘুমন্ত বনস্থলকে জীবনকাঠির সর্ঙ্শ দিয়ে দিয়ে ফুলে-ফলে জাগিয়ে তুলেছে। মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছিল দু-একটা নলশাকের পাতা; মাতাল রঙিন প্রজাপতির মতো, কিন্তু তার পতনশব্দও কানে বাজেনি। যেন সে পতন নয়, সমর্পণ। এক সময় একরাশ শুকনো পাতার তল থেকে একটা বুনো দুষ্ট ইঁদুরকে হঠাত্ ছুটে যেতে দেখে সঙ্গিনী ইউরুন আঁতকে উঠে ছুটে এসেছিল। তারপর ধাতস্থ হয়ে হাসতে শুরু করে দিল। আমি যতই গম্ভীর, হাসতে হাসতে সে ততই গড়িয়ে পড়ে এখানে-সেখানে, পাতার ওপর, মাটিতে। একটু একটু করে আমিও যেন সংক্রমিত হয়ে গেলাম। বনের গাছপালা, লতাগুল্ম, এমনকি এ-ডাল সে-ডাল বেয়ে চলা নিত্যকর্মরতা পোকাগুলোও যেন সেই বনকাঁপানো শান্তিতলের অশোভন সর্ঙ্ধায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাই দেখে, দেখিয়ে, এক একটার গঠন আকৃতি-প্রকৃতির সঙ্গে চেনাজানা জীবজন্তুর মিল দেখে আমাদের হাসি আরো বেড়ে গেল।

কিন্তু বনপ্রান্তে এসে অকস্মাত্ দুজনেই থেমে গেলাম। সামনে সবুজের ঢল উপত্যকা হয়ে নেমে গেছে একটা-দুটো রঙবেরঙের জনপদের দিকে; তার ঘরবাড়িগুলো যেন কাঠের তৈরি খেলনা; মাঠের সবুজ তারপর আবারও পাহাড় ডিঙিয়ে উঠতে গিয়ে তার ঘন সবুজে হারিয়ে গেছে। কয়েকটা চিত্র-বিচিত্র গরু চরছিল এদিকে-সেদিকে; খড়বাহী গাড়ির ঘোড়ার রাশ টেনে একটা মোটাসোটা, জোব্বা-জাব্বা পরা, মাথায় রুমাল বাঁধা এক চাষিগৃহিণীকেও পায়ে হেঁটে জনপদের দিকে মিলিয়ে যেতে দেখা গেল। আমাদের কাছেই একটা গরু বুনো আপেল গাছের ছায়ায় শুয়ে ছিল। আমাদের দিকে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখে আবারও নিজের জাবর কাটায় ব্যস্ত হলো। বসে একটা সিগারেট জ্বালিয়েছিলাম। দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা ভালো করে নিভিয়ে মাটিতে গুঁজে দিচ্ছি দেখে ইউরুনের মাথায় কী বুদ্ধি এসে গেল; নীল চোখ পাকিয়ে সে দিয়াশলাইটা হাতে নিল; তারপর একরাশ শুকনো পাতা জড়ো করে ডালে আপেল গেঁথে আগুনে পুড়িয়ে খেতে দিয়েছিল। তার স্বাদটা এখনো অনায়াসে অনুভব করতে পারি।

তবু আর যাই হোক, সে আপেল খেতে, প্রথম এইমতো ডুমুরের খোসার কষে হাত চটচট করে ওঠেনি। জলপাই পাতায় ঘষে ঘষেও তা দূর হলো না। ইতিমধ্যে রোদ আরো কড়া হয়ে উঠেছে। তেতে উঠেছে আশপাশের পাথরগুলোও। সাগর থেকে উঠে আসা একটা অসঙ্ষ্ট বাষেঙ্ পেনেলোপের লুকিয়ে থাকা ইথাকার দূর দৃশ্যও যেন ঝাপসা হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ আগেই হোমার বর্ণিত পেনেলোপের সেই গুহা দেখে এসেছি। ইউলিসিসের প্রতীক্ষারতা সেই পেনেলোপের কাল থেকে আজও পর্যন্ত কত মানুষই না সেখানে আসা-যাওয়া করেছে। বলেছে হোমার কবি, সমস্ত কাহিনী কল্পনামতি। আমার তা আদৌ মনে হয়নি। প্রুস্ত বলেছিলেন, রিয়ালিটি টেক্স শেপ ইন আওয়ার মেমোরি-অথবা ওই জাতীয় একটা কথা। হোমারের স্মৃতি যেন রক্তেবহা উত্তরাধিকার। তার কাহিনী যেন শাশ্বত সত্য। উপসাগরের তীরে উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোও এক স্তব্ধ প্রতীক্ষায় দিগন্তহারা সমুদ্রের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইউলিসিস, তার কীর্তি-কাহিনী যেন উপলক্ষই, আসল বস্তু ওই পেনেলোপের প্রতীক্ষা। তা-ই যেন চিরযুগের, চিরকালের জীবনসাধনারই প্রতীক। মনে পড়েছে পেছনে ফেলে আসা দূর মরুভূমির শবরীর প্রতীক্ষার কথা-

কিন্তু পেছনে কেবল মানুষ, দেশই ফেলে আসিনি। ভাবনাকেও ফেলে আসতে চেয়েছি। কিছু গুরুতর, মনভারীকরা কিছু ভাবব না বলেই তো এতদূরে এলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনে এল কাভাফির ‘দি সিটি’ নামক সেই কবিতাটি।...বন্দরে...হ্যাট কিনছিল ইংরেজ মেয়ে ক্রিস্টিন। আমার ছোট কুকুর পুপাকে দেখি হ্যাট ফেলে ছুটে এসেছিল। পুপা ইয়র্কশায়ার টেরিয়ার, এত ছোট যে ব্যাগে করে সঙ্গে নিয়ে বয়ে বেড়াই। বিকেলে ভাথী বন্দরের এক ধারে একটা বারে বসে...পান করছিলাম; ক্রিস্টিনকে কাছ দিয়ে যেতে দেখেই ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিল। হ্যাট পেয়ে ফিরে এল ক্রিস্টিন; পুপাকে আদর করতে গিয়ে তার হাতের বইগুলো নিচে পড়ে গেল; তার একটা ওই গ্রিক কবি কাভাকির সংকলন। পাতা উল্টাতে গিয়ে ওই কবিতায় চোখ আটকে গিয়েছিল : আপাতদৃষ্টিতে মর্মার্থটা খুবই বিষণ্ন মনে হয়েছিল। তুমি বলেছিলে, তুমি আরেক সমুদ্রে যাবে, আরেক দেশে, খুঁজে নেবে এরও চেয়ে ভালো আরো কোনো স্থান। কিন্তু অন্য কোনো সমুদ্র নেই, অন্য কোনো দেশ নেই। যেখানেই যাও এই একই শহর তোমার পেছনে যাবে, ঘুরে-ফিরে চক্কর দেবে একই পথে পথে, ওই একই বাড়িতে তুমি বুড়িয়ে যাবে। নিজেকে ছোট গণ্ডিতে আবদ্ধ করে তুমি গোটা পৃথিবীটাকে নিজের মতোই নষ্ট করে দিয়েছ।

যেন ওই কবিতাটা না পড়াই ভালো ছিল, কিছুক্ষণ আগেও ওই উপলক্ষভরা সমুদ্রতীরে বসেছিলাম। স্নানের সরঞ্জাম সঙ্গে ছিল, কিন্তু জলে লম্বা রকমের লাল লাল পোকা দেখে আর নামতে ইচ্ছে হয়নি। পুপা শান্ত সমুদ্রের ঢেউ আসতে-যেতে দেখে ঘেউ ঘেউ করে আগুপিছু করেছে উপলখণ্ডের ওপরে ছোটাছুটি করে। শেষ পর্যন্ত পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ছোট কুঁচোচিংড়ির দিকে মন দিয়েছে। এমন সময় দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে সাঁতারের কস্টিউমপরা একটি মেয়ে এগিয়ে এসেছিল; কাছে এসে পুপার কাণ্ডকারখানা দেখল একটুকাল; তারপর হেসে আমার দিকে তাকাল : কালীমেরা!

: কালীমেরা।

: আপনি গ্রিক না কী? মেয়েটি যেন অবাক হলো।

: ও হি! মাথা নাড়লুম আমি : সামান্য কাজ চালাবার মতো কয়েকটি কথা শিখেছি মাত্র। তা-ও এখানে এসে। সব শিক্ষার ওপর ঘেন্না ধরে গেছে বলেই এখানে এলাম।

মেয়েটি কৌতূহলী হয়ে কাছে বসল। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো অনর্থক হয়তো প্রয়োজনের অতিরিক্তই বলে ফেলেছি। আমার বাচালতা মেয়েটির পক্ষে নির্জনতা-বিতাড়নেরই ভূমিকা বলে মনে করা অসম্ভব নয়। এমনই জেরা শুরু হলো বলে হঠাত্ই পুপাকে ডাক দিয়ে উড়ে যেতে চাইলাম।

: আমিও এখানকার নই। এথেন্স থেকে এসেছি। এখানেই একটা গাঁয়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছি। বাবা-মা আর আমি। উপসাগরের এদিকটা যেখানে বেঁকে গেছে, ওইখানে একটা ছোটখাটো রেস্তোরাঁর মতো দোকানে। পাশে একটা কী দুটো জেলেবাড়ি। এ ছাড়া এদিকে দেশী-বিদেশী কাউকেই তো বড় একটা চোখে পড়ে না। মাঝে-মধ্যে অবশ্যি ছোট-বড় ইয়ট নিয়ে কেউ কেউ যেন ভুল করেই এসে উপস্থিত হয়। তাও কালেভদ্রে। নিজেদের জাঁকজমক দেখাতে না পেরে আবারও সঙ্গে সঙ্গেই সরে পড়ে-বলতে বলতে মেয়েটি হেসে উঠেছিল।

কথাটা অসত্য নয়। সেই ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা থেকে ওই গ্রিক দ্বীপগুলো পর্যন্ত শৌখিন ইয়টওয়ালারা এখন-তখন পাল উড়িয়ে হয়তো লোকের ভিড়ই খুঁজে বেড়ায়। ভাথিতেও তাদের ভিড়। ইয়ট, কেবিন-ক্রুজার। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার মতলবে প্রায় সকলেই নানা দূর দেশের নিশান উড়িয়েছে মাস্তুলে। মালিকরা নানা দেশের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যবয়সী প্রৌঢ়; কোমল শরীর রোদে পুড়ে তামাটে; মুখে অনেক দিন না কামানো দাড়ি; পরনে হাফপ্যান্ট, মাথায় নাবিকের টুপি, কব্জিতে মস্ত ঘড়ি, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল, পেছনের হিপ পকেটে মোটা মানিব্যাগ ও গলায় সোনার চেইনে ক্রুশ কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা ঝোলানো। কেউ কেউ বা শখ করেই হাতে-বাহুতে উল্কি এঁকে আরো জাতনাবিকের পর্যায়ে উঠেছে। তাদেরই একজন পুপাকে কিনে নিতে চেয়েছিল; একতাড়া দ্রাকমা, ডলার,...স্টার্লিং বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার ছোট মেয়ে আবদার ধরেছিল বলেই। আমার অনিচ্ছা দেখে নোটগুলো আবারও তার ব্যাগে পুরতে পুরতে বলেছিল, ওর চেয়ে ভালো দাম আমি আর পাব না। শুধু তাই! একটা কেবিন-ক্রুজার থেকে ধবধবে সাদা স্যুট পরা কোট-হ্যাট মাথায় দেওয়া এক আমেরিকান ভদ্রলোক আমার সঙ্গে এ-কথা সে-কথার পরে রীতিমতো উষ্মাই দেখালেন : গ্রিক সরকার বিদেশীদের কাছে আর নাকি কোনো আইল্যান্ড বিক্রি করতে চাইছে না। এত দূর থেকে আসাই তার ব্যর্থ হয়ে গেছে। ভদ্রলোকের বাড়ি ফ্লোরিডাতে, পূর্বপুরুষের কেউ কেউ গ্রিক। শুনেছিলেন ভূমিকমেঙ্র পর এই দিকে নাকি অনেক কেনাকাটার সুবিধা হয়েছে।

তার কাছ থেকে যেমন পুপাকে খেতে দেওয়ার ছল করে উঠে গিয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই এবারও উঠে পড়েছিলাম। মেয়েটি হয়তোবা একটু অপ্রস্তুতই হয়েছিল, কিন্তু গ্রাহ্যে আনতে মন চায়নি। তখনো...কর্ফুর জেলেপাড়ার সমুদ্রের কথা মনে আছে। সমুদ্রের ধারে বসে একটা বই হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। পুপা একটা ঝোপের ছায়ায় কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। উপকূল ধরে দূর থেকে গোলগাল একটি বেঁটে মেয়ে হেঁটে আসছিল। পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমার দিকে চেয়ে হাতের বইটা লক্ষ করে চলে যাচ্ছিল, এমন সময় পুপা জেগে উঠে ডাকাডাকি শুরু করে দিল; আমি বই বন্ধ করে তাকে কাছে ডাকলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেই ভদ্রমহিলা ফিরে তাকাল। ও! ইউ সিঙ্ক ইংলিশ?

এই এথেন্সের মেয়েদের মতো তিনিও কাছে এসে বসেছিলেন। এত নাম শুনে শুনে এতদিন মাস্টারি করে জমানো পয়সা জমিয়ে সামার হলিডেতে এসেছেন। কিন্তু কই, একটা লোকও তো কোথাও চোখে পড়ছে না! বললেন, এর চেয়ে বোধহয় ইতালিতে যাওয়াই ভালো ছিল। আমি তো সে দেশেই থাকি, আমার কী মত? বলেছিলাম নিঃসঙ্গতা, নির্জনতার আনন্দ তো সকলেরই কাম্য নয়। জীবনে যে যত বেশি ইনসিকিওর, জনতার প্রয়োজন যেন তাদেরই বেশি। সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড়ে মাদকতা আছে হয়তো, কিন্তু শান্তি নেই।

: আপনি ইন্ডিয়ান?

মাথা নেড়ে চলে এলাম। প্রশ্নের সঙ্গে তার মুখের হাসি দেখে মনে হয়েছিল যেন জীবন সমের্ক ভাবনা ভারতীয়দেরই জাত ব্যবসায়। যদি তবুও না উঠে পড়তাম জবাব দিতে হতো তার হাজারো কৌতূহলের। ভারতীয় দর্শন, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন-এর সঙ্গে তার পার্থক্য কী, যোগসাধনা যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি করে কি না, কামসূত্রের আসল পাণ্ডুলিপিটা না কী কোনো মন্দিরে তামা-কুলুপে লুকিয়ে রাখা, কোনো যোগীকে নিজ দেহ শূন্যে উত্তোলন করতে দেখেছি কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে স্টকহলম, এডিনবরা থেকে এথেন্স-এসব প্রশ্ন শুনে শুনে কান পচে গেছে।

পুপাকে খেতে দেওয়ার সময় হয়েছিল, তাই হেঁটে হেঁটে জেলেবাড়ির কাছে সেই রেস্তোরাঁমতন জায়গাটায় এসেছিলাম। কালেভদ্রে মাংস মেলে এদিকে। দ্বীপাঞ্চলে প্রধান খাদ্য মাছ। সপ্তাহে একদিন হয়তো একটা পাহাড়ি ছাগল মেরে টেলকেবাব বানায়, তার খণ্ডগুলো পুপার পক্ষে সামলানো দায়, বড় একটা পছন্দও করে না। কিন্তু ইতালিয়ান সঙ্াঘেটিতে তার অরুচি নেই। রেস্তোরাঁতে কিছুই জুটল না; ভাত আছে, সমুদ্র থেকে ধরা বড় চানিয়া মাছের মুড়োর ঝোল আছে, সবজি আছে। আমি পুপাকে ফেলে খেতে রাজি হলাম না।

দোকানি মধ্যবয়স্ক গ্রিক, বলল একটু পরেই সে আউটবোর্ড মোটর লাগানো নৌকা নিয়ে চেকাশুনিয়া যাচ্ছে নিজের ব্যবসায় উপলক্ষে। পুপার জন্য মেশিনে কাটা মাংস নিয়ে আসবে। পাশের জেলেবাড়ির লোকেরা প্রায়ই নাকি সঙ্াঘেটি রাঁধে। খোঁজ নিলে হয়তো কিছুটা মিলতেও পারে।

পাহাড়ের গা কেটেই ছোট একটা সাদা দোতালা বাড়ি। ওপরতলার রেলিংয়ে সবুজ রঙ করা, তার ধারে একরাশ জেবালিয়া ফুলের টব, এক পাশে দড়িতে ঝোলানো কয়েকটা তোয়ালে আর একটা সুইমিং কস্টিউম বাতাসে উড়ন্ত। নিচের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পরই ঘরের দরজা বন্ধ। জানালায় পর্দা, এদিক-ওদিক বারংবার তাকিয়েও কাউকেই চোখে পড়ল না। সামনে জলের ধারে চাটাই টাঙিয়ে রোদ আড়াল করা একটা জায়গা; তার পাশে একটা পাথরের ওপর বসে বারো-চৌদ্দ বছরের একটা ছেলে মাছ ধরছিল ছিপ হাতে করে; পুপা তার বড়শির মাথায় ছোট একটি মাছের ছটফটানি দেখে এদিকে-সেদিকে লাফিয়ে খেলায় মত্ত হয়ে গেল। ছেলেটিও বড়শিসুদ্ধ সেই মাছ পুপার সামনে নাচিয়ে নাচিয়ে যেন আনন্দে আত্মহারা হলো।

: ইওর ডগ?

তাকে ইংরেজি বলতে শুনে অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করতে বলল, সে ভামিেত স্কুলে পড়ে, সামান্য কিছু শিখেছে। ইচ্ছে আছে ভালো করে শিখবে, তারপর কানাডায় চলে যাবে। তার বাবা সেখানেই কাজ করে। তার কথা ভাঙা ভাঙা, হোঁচট খেতে খেতে পথচলার মতো। তবু একটু পরেই আবিষ্কার করা গেল ওই জেলে বাড়িটা তাদেরই। গেওরসি, তার মা আর এক বোন থাকে সেখানে। বুড়ি দাদী গত বছর মারা গেছে। এখন অপেক্ষায় আছে বাপ কবে টাকা পাঠাবে তারপর সবাই মিলে হয়তো কানাডাতেই চলে যাবে। কেবল মা-ই যেতে চায় না।

: কেন?

গেওরসী তার জবাব দিতে পারল না, ঘাড় দুলিয়ে না জানার ভঙ্গি করল। তারপর মাছটা খুলে জলে ছেড়ে দিয়ে আবারও টোপ গেঁথে জলে ফেলল।

: মাছটা ছেড়ে দিলে! তাহলে ধরো কেন?

: এমনি! শাদা দাঁত দেখিয়ে হাসল গেওরসি।

এই সময় পেছনে সাঁতারের পোশাক পরা ষোল-সতেরো বছরের একটি মেয়ের উপস্থিতি টের পেলাম। উবু হয়ে বসে পুপাকে আদর করতে শুরু করেছে।

: আমার বোন, হেলেন।

হেলেনের চোখ দুটি আশ্চর্যরকম বুদ্ধিদীপ্ত, লাজে ভরা। আমি তার ভরা যৌবনা শরীরের দিকে তাকাতেই যেন শরমে কুঁকড়ে গেল।

: মুশকিলে পড়েছি ওকে নিয়ে। তোমরা না কি স্মাঘেটি খাও!

হেলেন আমার মুখের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেওরসিকে তাড়াতাড়ি করে যা বলল তার একবর্ণও বুঝলাম না। গেওরসি বুঝিয়ে দিল, খায় বটে। তবে সেদিন করেনি। তবে তৈরি করতে কতক্ষণ। যদি রাজি হই, তবে হেলেনই তাকে খাইয়ে আনবে।

আপত্তি করিনি; পুপা তার কোলে চড়ে পরম আহ্লাদেই মুখব্যাদান করে হাসতে শুরু করে দিল।

আমি খেতে গেলাম রেস্তোরাঁতে। মালিক ইতিমধ্যে তার আউটবোর্ড মোটর লাগানো নৌকা ভট ভট করে চেকাশুনিয়া রওনা হয়ে গেছে। স্থির নীল সমুদ্রে তার সে নৌকাটা এখন একটা কালো বিন্দুর মতোই অসঙ্ষ্ট। দুয়ারের কাছে বসে তার স্ত্রী দাঁত খুঁটছিল। রেস্তোরাঁতে আর কেউ ছিল না। একটা টেবিলে বসে মেনু চাইলাম।

মহিলা দরজা থেকে উঠে এল; মুখের দাঁতনটা দাঁতে চেপে বলল : মেনু-টেনু নেই, যা দেব তা-ই খেতে হবে, যদি খেতে চাই।

অগত্যা। একটু পরেই গোটা প্লেটভর্তি একটা চার্নিয়ার মাথা এনে হাজির। নিচে ঝোল, কয়েকটা আলুর টুকরো, আস্ত রসুনের কোষ। কয়েক খণ্ড রুটিসুদ্ধ একটা...ঝাঁপিও এনে পাশে নামিয়ে দিলে; তারপর কাঠের টেবিলে হাতটা চেপে বললে : আর কী চাই?

: ওয়াইন নেই?

মাথা দুলিয়ে সে ঘরের সিলিংয়ের তলায় একটা র্যাকের দিকে ইঙ্গিত করলে। যেন বহুকাল কয়েক ডজন বোতল সেখানে মাকড়সার জাল-ঝুল মেখে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ইতালিয়ান বোতলও চোখে পড়ল।

বোতলটা আর একটা গ্লাস পাশে ঠক করে নামিয়ে সে আবারও দুয়ারের বাইরে নেমে কলাপসিবল কাঠের চেয়ারটার ওপর গিয়ে বসে পড়ল।

মাছের মুণ্ডুটা চোখ দুটো মেলে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ইথাকাতে ওই প্লেট দেখে তো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আহার্য বস্তু দেখে নয়, হাতে না কাঁটায় খাব সেই ভেবে। হংকংয়ে মাছের চোখ দিয়ে রান্না ভাত খেয়েছিলাম ভয়ে ভয়ে। কিন্তু ইথাকার সে রান্না আরো চমত্কার। যদিও বাঙালি মেয়ের রুই মাছের মুড়িঘণ্ট রাঁধার কৌশল পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো মেয়েরই জানা আছে বলে জানিনে।

খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই পাহাড়ের চূড়ায় চলে এসেছিলাম। ডুমুর ফলগুলো একটার পর একটা খেয়ে খেয়ে হয়তো আহার আধিক্যেই তন্দ্রা এসেছিল। এক সময় রোদে তেজে উঠে বসতে হলো। বেলা হেলে পড়েছে। রোদে ঝিম ধরে আছে যা কিছু চোখে পড়ে। পুপার কথা স্মরণ করে উঠে পড়লাম।

একটা ক্যাকটাস গাছে অজস্র ফুল। তার রঙ দেখে মন মুগ্ধ হলো। লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ। যেন রঙের মেলা। কাছে এগিয়ে বেশ কয়েকটা পেড়ে নেওয়ার পরেই হাতের তালুত আঙুল অজস্র অদৃশ্য কাঁটায় ভরে গেল।

হেলেন আর গেওরসি ঘরের বাইরে রোয়াকে বসে পুপাকে নিয়ে খেলায় মত্ত ছিল; পুপা আমাকে দেখে তাদের ফেলে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল।

: করেছেন কী! গেওরসির চোখ কপালে উঠল : অমন করে খালি হাতে ওই ফল তুলতে আছে!

হেলেনও শঙ্কিত মুখে ঘরে উঠে গেল। একটু পরেই তার মা এসে দাঁড়াল দরজায়। ভাঙা ইতালিয়ানে বললেন : কী কাণ্ড! ওগুলো ফেলে উঠে আসুন ওপরে। দেখছি কী করা যায়। এই বলে হেলেনকে কী আনতে আবারও ভেতরে পাঠালেন।

: সিসিলিতে এ ফল খেতে দেখেছি।

: তা বইকি! এখানেও খাই। স্বাদ চমত্কার। কিন্তু অমন করে খালি হাতে তুলতে নেই। ওর গায়ে রোঁয়ার মতো অজস্র কাঁটা। এখন দেখবেন হাতের ব্যথায় ঘুমোতেও পারবে না।

: আপনি ইতালিয়ান শিখলেন কোথায়?

হেলেনের মা বললেন : এখানে যুদ্ধের সময় বহু ইতালিয়ান ছিল। আমি ওই রেস্তোরাঁতে কাজ করতাম। তাদের কাছ থেকেই তো সঙ্াঘেটি খেতে শিখেছি।

ইতিমধ্যে হেলেন ছুটে একটা টুইজার নিয়ে এসেছে। দু হাতের সর্বত্রই অজস্র কাঁটা। হেলেনের মা বেশ তুলে ফেলে হেলেনকে বললেন : তুই দ্যাখ, আমি চোখে ভালো দেখতে পাইনে মনে হচ্ছে।

ঘণ্টাখানেকেরও বেশি হেলেনের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে বসে থাকতে হলো। তার হাত নরম, আঙুলগুলো লম্বা, প্রথমে কাঁপছিল, পরে সহজ হয়ে এল।

: তুমি পড়াশোনা করো না!

হেলেন বুঝতে পারল না আমার কথা; চোখ তুলে তাকিয়েই আবারও হাতের কাঁটা তোলায় মন দিল।

: ইংরেজি পারো?

হেলেন মাথা দোলাল : মনে হলো তার মুখ যেন সিঁদুরবর্ণ হয়ে উঠেছে।

গেওরসি নিচে পুপাকে নিয়ে খেলছিল, তাকে উঠে আসতে বললাম।

: জিজ্ঞেস করো হেলেনকে, বিয়ে করেনি কেন?

গেওরসি একমুখ হাসল : তারপর হেলেনকে বলতেই তার হাত থেকে যেন টুইজারটা মাটিতে পড়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর সারা মুখে যেন রক্ত উঠে এল; চোখ নামিয়ে টুইজারটা হাতে তুলেও সে যেন আর আমার হাতের কাঁটা তোলায় মন দিতে পারল না।

কোথায় ঘাট হলো বুঝিনি। তাকে এমন বিব্রত দেখে এক সময় নিজেই হাত টেনে নিলাম : থাক, যথেষ্ট হয়েছে। এখন আর তেমন ফুটছে না।

হেলেন আর আমার মুখের দিকে না তাকিয়েই তাড়াতাড়ি উঠে গেল।

পুপাকে ডেকে নেমে আসছি, হেলেনের মা পেছন থেকে ডাক দিল : গেওরসি।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত