বিজ্ঞাপন
default-image

চা-শ্রমিকদের ‘গুল্লি বয়েগা...লবণ দেয়ে গা...’ বলেছিল পাকিস্তানি সেনারা। না মানায় ২২ জন চা-শ্রমিককে ঘরে নিয়ে গিয়ে সুপারি খাইয়ে অবচেতন করে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাযজ্ঞে আমিই একমাত্র জীবিত। আজও বয়ে বেড়াই ভয়ংকর মুহূর্তগুলো। এখনো সবিস্ময়ে ভাবি, ২২ জনের মধ্যে ২১ জন মারা পড়ল, আমি বাঁচলাম কেমনে!

মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে হানাদার বাহিনী ঘাঁটি তৈরি করে সিলেটের চা-বাগানের বাংলোয়। চা-বাগান কর্তৃপক্ষের স্থাপনাগুলো হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের। চা-শ্রমিকদের নিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনাও ছিল না। সব পরিচালিত হতো পাকিস্তানি সেনাদের মাধ্যমে। সিলেটের খাদিমনগর চা-বাগানে কর্মরত আমাদের তখন চা-পাতা চয়ন বন্ধ রেখে বলা হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের গুলির বাক্স বহন করতে। বাগান কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এ ফরমান শুনে আমাদের মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। আমাদের জব্দ করতে এমন এক হত্যাযজ্ঞের ঘটনা যে ঘটানো হবে, তা কল্পনায়ও ছিল না। সুপারি খাওয়ার কথা বলে একটি খুপরিঘরে নিয়ে ২২ জনের মধ্যে সবাইকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়।

সেদিন বৈশাখ মাসের ৫ তারিখ ছিল। পরে হিসাব করে বের করেছি, ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল ছিল সেদিন। গুলির বাক্স বহন করলে রেশন দেওয়া হবে বলে বাগান কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানিদের নিয়ে আমাদের জড়ো করে। আমরা সাহেবের (ম্যানেজার) বাংলোর একটি খুপরিঘরের সামনে দাঁড়াই। সেখান থেকে গুনে গুনে ২২ জনকে নিয়ে যাওয়া হয় ওই ঘরে। সেই ২২ জনে আমিও ছিলাম। ভেতরে একজন পাকিস্তানি সেনা খেদোক্তি করে অনেক কথাবার্তা বলে। আমি কিশোর বয়সের। ভয়ের মধ্যে ছিলাম। সেনা বলল, ‘গুল্লি বয়ে গা, রেশন-চাল-ডাল পয়সা দেয়ে গা...লবণও দেয়ে গা...।’ তখন লবণের খুব কদর ছিল। আমরা নিরুত্তর ছিলাম। এই নিরুত্তর থাকাটাই কাল হলো। সকাল ১০টায় আমাদের ওই ঘরে ঢুকিয়ে যখন এক ঘণ্টা পরও কোনো জবাব পাচ্ছিল না তখন পানের বাটা এগিয়ে দিয়ে বলল পান-সুপারি খেতে, খেয়েদেয়ে ঝটপট বলতে।

প্রবীণেরা প্রথম সুপারি খেলেন। আমরাও খেলাম। খাওয়ার পরই শুরু হলো নরকযন্ত্রণা। ভরদুপুরে সবাই চোখে ঝাপসা দেখছি। কাছ থেকে কাউকে চিনতে পারছি না। খানিক পরে শুরু হলো পেটে আর বুকে ব্যথা। কেউ যেন বুকের ভেতর কলজে খাবলে ধরছিল। সারা ঘর ধোঁয়ায় অন্ধকার। এর প্রায় ১৫ মিনিট পর আমি অনুভব করলাম, কানেও কিছু আর শোনা যাচ্ছে না। চোখেও দেখছি না। এ অবস্থায় ঘরের জানালা দিয়ে বন্দুক ঢুকিয়ে এক এক করে ফায়ার শুরু হলো। কিন্তু ঘরের ভেতর আমরা কেউই তা টের পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে পান-সুপারিতে বিষ দেওয়া হয়েছে আর এই বিষক্রিয়ায় সবাই মুমূর্ষু। গুলি এসে কার ওপর বিদ্ধ হলো আর কে মারা গেলেন—সবই হচ্ছিল নীরবে।

ঘরে একটি উঁচু চুলা ছিল। মাটি দিয়ে তৈরি। আমি হাতড়ে ওই চুলোর মধ্যে লুকাই। জানালায় তাক করা বন্দুক আর আমাকে বিদ্ধ করতে পারেনি। সৌভাগ্যক্রমে অক্ষত থাকি। ঘণ্টাখানেক পর মরদেহ যখন ঘর থেকে বের করা হচ্ছিল, তখন আমি মরার ভান করে পড়ে থাকি। মরদেহের সঙ্গে আমাকে সরানোর পর ঘরের বাইরে এসে আমি স্বাভাবিক হই। শোকাহত শ্রমিকদের বলি। তাঁরা স্বজনদের লাশ রেখে আমার মুখে মৃত্যুর ভয়াবহতা শোনেন। শেষে আমিই গুনে গুনে ২১টি মরদেহের পাশে ফাঁকা জায়গায় বালিচাপা দিই।

ওই ২১ জনের একজন মাত্র স্বজন বেঁচে থাকায় তাঁকে (মানিকলাল হাজাম) নিয়ে দেশ স্বাধীন হলে পরে ২১ লাশ সত্কার করার স্থানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করি। আমরা চা-বাগানের শ্রমিক আর কর্মকর্তারা সেই স্মৃতিফলক দেখে স্মরণ করি নিহতদের।

অনুলিখন: উজ্জ্বল মেহেদী, সিলেট

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত