‘হাজীপুর গ্রামটা তো আর নেই, নামটাই মুছে গেছে...।’ ‘না, মুইছা যায় নাই।’ দৃঢ়কণ্ঠে মোহাম্মদ সেলিম বললেন, ‘মেঘনা নদী আমাদের গ্রামটারে গিইল্যা খাইছে, তয় তার নামটা মুইছা দিতে পারে নাই। মানুষের মনে অহনো বাঁইচা আছে হাজীপুর।’
ভেবে দেখলাম, সেলিমের কথা সত্য। গ্রামটি হারিয়ে গেছে, কিন্তু নাম হারিয়ে যায়নি। এখনো উচ্চারিত হয় হাজীপুরের নাম।
১৯৮২ সালে প্রবল বন্যায় ভোলার দৌলতখান উপজেলার হাজীপুর গ্রামটি বিলীন হয়েছিল নদীগর্ভে। একদিন ঘরবসতির অন্য রকম জীবন যে সেখানে ছিল, সে কথা কে বুঝবে অবারিত জলরাশির দিকে তাকিয়ে? কিন্তু এই গ্রামের কথা এখনো মানুষের মনে আছে। পত্রপত্রিকা বা বইয়ের কালো হরফে হাজীপুরের নামটি থেকে গেল শুধু একজন মানুষের জন্য। এই গ্রামে জন্মেছিলেন মোহাম্মদ মোস্তফা। এই মানুষটির শৈশবের দুরন্ত সময় কেটেছিল প্রকৃতির খেয়ালখুশির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা পরিবার ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের দলিল-দস্তাবেজে এখনো মোহাম্মদ মোস্তফার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ আছে এই হাজীপুর গ্রামের নাম।
মোহাম্মদ মোস্তফা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে জীবনের চূড়ান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াইয়ের ইতিহাস তাঁকে দিয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’র মর্যাদা। নিজেকে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচিয়ে দেওয়ার তাঁর রণকৌশল গল্পের কল্পনাকেও হার মানায়।
সেই গল্পে পরে আসছি। আগে পারিবারিক ইতিবৃত্তটা একটু বলে নিই। ১৯৪৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর মোস্তফার জন্ম। ভেবে দেখুন, কী কাকতালীয় ঘটনা! ১৯৭১ সালের যে মাহেন্দ্রক্ষণে একটি দেশের মুক্তিকামী মানুষ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে, সেই দিনটিতেই ২২ বছর আগে জন্মেছিলেন তিনি। যেন নিয়তি তাঁর জন্মমুহূর্তকে একটি দেশের সর্বোচ্চ অর্জনের দিনটির সঙ্গে এক সূত্রে বেঁধে দিয়েছিল।
বাবা হাবিবুর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর হাবিলদার। মায়ের নাম মালেকা বেগম। গ্রামে তাঁর বাবাকে সবাই ‘হাবিব মিলিটারি’ নামে ডাকত। এই সম্বোধনে একটা সমীহ ছিল। এই ডাকই হয়তো সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে মোস্তফাকে। তা ছাড়া শৈশবে কিছুদিন বাবার সঙ্গে কুমিল্লা সেনানিবাসেও ছিলেন মোস্তফা। সেখানে সৈনিকদের জীবনপ্রণালি, কুচকাওয়াজ ও প্রশিক্ষণের নানা কসরত দেখে একধরনের মুগ্ধতাও তৈরি হয়েছিল মনে। কিন্তু বাবা চাইতেন না ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিক। এই না-চাওয়ার পেছনে কারণ ছিল অনেক। নিজে কখনো নিরবচ্ছিন্ন সংসারজীবন পাননি হাবিলদার হাবিবুর রহমান। ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। যোগদানের পর দীর্ঘ ২০ মাস পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না তাঁর। ১৯৪২ সালে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন।
সেই সময়টাতেই বিয়ে করেছিলেন মালেকা বেগমকে। কিন্তু বিয়ের মাত্র আড়াই দিনের মাথায় নববধূকে রেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। ফিরেছিলেন বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে। এ সময় তিনি পাকিস্তান, ভারত ও বার্মার বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় যুদ্ধে অংশ নেন। বীরোচিত ভূমিকার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে তিনটি এবং পাকিস্তান সরকার একটি মেডেল দেয়।
মেডেলগুলো যত্নে গচ্ছিত রেখেছেন মালেকা বেগম। এগুলো হয়তো গৌরবের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার প্রতীকও হয়ে ওঠে এই পদকগুলো। মনে করিয়ে দেয়, সুখে সংসারজীবন করার সময়টাতে তাঁর স্বামী ছিলেন কোন দূরান্তের যুদ্ধক্ষেত্রে।
কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও ছেলে মোস্তফাকে নিজের জীবনের পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত রাখতে পারেননি ‘হাবিব মিলিটারি’। সংসারী হওয়ার জন্য ছেলেকে বিয়ে করিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে পিয়ারা বেগমকে বিয়ে করেছিলেন মোহাম্মদ মোস্তফা। কিন্তু রক্তে যাঁর রণক্ষেত্রের দামামা, সংসার তাঁকে বেঁধে রাখবে কী দিয়ে? বিয়ের মাত্র এক বছর পর নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন মোস্তফা। সেই যে গিয়েছিলেন, ১৯৬৮ সালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি চূড়ান্ত হওয়ার পরই সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর। সৈনিকের ছেলে সৈনিক হয়ে ফিরে এসেছিলেন বাড়িতে।
শেষ কবে দেখা হয়েছিল ছেলের সঙ্গে—এই প্রশ্নের উত্তরে নবতিপর মালেকা বেগমের কণ্ঠে অদ্ভুত বিষাদ, ‘১৯৭০ সালের বন্যার পর কয়েক দিনের ছুটিতে শেষবার বাড়িতে এসেছিল মোস্তফা। ছুটি শেষে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে। আমি ওর পেছনে হাঁটতে লাগলাম। সঙ্গে বউ পিয়ারা বেগম ও একমাত্র ছোট ভাই মোস্তাফিজ। আমার বউমা তখন অন্তঃসত্ত্বা। এটাই যে শেষ দেখা, কে জানত?’
ছেলের সঙ্গে আর দেখা হয়নি মায়ের। কিন্তু সেই ছেলেকে যখন সারা দেশের মানুষ চিনল, জানল, যখন লোকে মালেকা বেগমকে শ্রদ্ধাভরে ডাকতে লাগল ‘বীরশ্রেষ্ঠ’র মা, তখন সব শোক-দুঃখ ছাপিয়ে ছেলের জন্য গর্বে-আনন্দেও অশ্রু নামত তাঁর চোখ বেয়ে।
এবার মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আসি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর স্বাধীনতার স্বপ্ন তীব্রতর হয়েছে এ দেশের মানুষের মনে। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম যে সশস্ত্র যুদ্ধে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে, তার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনানিবাসগুলোতে তখন থমথমে অবস্থা। বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও সিপাহিদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। তাঁদের মনেও সঞ্চারিত হয়েছে একই স্বপ্ন।
এদিকে সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর অবাঙালি অধিনায়কেরা বিভিন্ন বাঙালি রেজিমেন্টকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে দিচ্ছিল। কুমিল্লা থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে স্থানান্তর করা হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। মেজর শাফায়াত জামিল (পরে কর্নেল) কিছু বাঙালি অফিসারের সহায়তায় ২৭ মার্চ সকালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খানসহ পাকিস্তানি অফিসার আর জওয়ানদের নিরস্ত্র ও বন্দী করে ফেলেন। অন্যদিকে মেজর খালেদ মোশাররফ অন্য একটি কোম্পানি নিয়ে সিলেটের শমশেরনগর থেকে বিদ্রোহে যোগ দেন।
এপ্রিলের শুরু থেকেই চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সব কোম্পানি একত্র হয়ে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মেঘনা নদীর দক্ষিণ থেকে পশ্চিম বরাবর শক্তিশালী এক ডিফেন্স গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে। ধারণা করা হয়েছিল, এতে পাকিস্তানি সৈন্যদের রেললাইন আর ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে আসার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু মরিয়া পাকিস্তানি বাহিনী একযোগে হেলিকপ্টার, গানশিপ, নেভাল গানবোট ও এফ-৮৬ স্যাবার ফাইটার বম্বার বিমান নিয়ে আশুগঞ্জ ও এন্ডারসন খালের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি দুটিতে আক্রমণ করে। এই নানামুখী আক্রমণে দিশেহারা মুক্তিবাহিনীর পশ্চাদপসরণ ছাড়া কোনো পথ ছিল না। মুক্তিবাহিনী কৌশলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া রেলপথ ধরে চলে আসে আখাউড়ায়। এই আখাউড়াকে কেন্দ্র করে নতুন তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলা হলো। তিতাস নদের ব্রিজে, আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে এবং তার উত্তরে দরুইন গ্রামে।
মোহাম্মদ মোস্তফা জন্ম: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৮, মৃত্যু: ২০ আগস্ট ১৯৭১, জন্মস্থান: হাজীপুর, দৌলতখান, ভোলা, যোদ্ধা: ৪ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যুদ্ধ: আখাউড়ার দরুইন গ্রামে, পদবি: সিপাহি সমাধি: দরুইনে
যুদ্ধের মাঠে সিপাহি মোস্তফার সাহস, বিচক্ষণতা ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেখে মেজর শাফায়াত জামিল তাঁকে ২ নম্বর প্লাটুনের ল্যান্স নায়েক নির্বাচন করেন। ১০ জন সৈন্যের সেকশন কমান্ডার মোহাম্মদ মোস্তফা। দরুইন গ্রামের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দায়িত্ব ছিল এই ২ নম্বর প্লাটুনের।
এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসে আখাউড়া দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল একবার। প্রবল প্রতিরোধের মুখে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল তারা। কিন্তু কুমিল্লার দিক থেকে পুনরায় আক্রমণ চালিয়ে তারা গঙ্গাসাগরে এসে পৌঁছাল। গঙ্গাসাগরে মোহাম্মদ মোস্তফাদের ২ নম্বর প্লাটুন পাকিস্তানিদের হাওড়া নদীর দক্ষিণেই থামিয়ে দেয়।
১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এরপর শুরু হয় দরুইনের ওপর আর্টিলারি আর মেশিনগানের গোলাবর্ষণ। এরই মধ্যে ১৭ এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গলের ১১ নম্বর প্লাটুন রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে দরুইনে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিল।
১৮ এপ্রিল ভোর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিলেন, বাংলার এই ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে অপরিচিত পাকিস্তানি বাহিনী হয়তো দমে যাবে। সকালবেলায় তাদের নীরবতা দেখে সে রকমই মনে হচ্ছিল। গোলাবর্ষণ থেমে গিয়েছিল। শুধু হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছিল উজানীস্বর পুলের দিকে।
কিন্তু বেলা ১১টার দিকে আবার গোলাবর্ষণ শুরু করল পাকিস্তানি বাহিনী। গোলাগুলি করতে করতে এগিয়ে আসতে শুরু করল শত্রুবাহিনী। আধা ঘণ্টার মধ্যেই অবস্থান নিল মোগরাবাজার ও গঙ্গাসাগরে। মোগরাবাজারের একটি উঁচু ভবনে মেশিনগান বসিয়ে ফেলল তারা। দরুইনের ঘাঁটি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংগ্রহ ছিল শত্রুপক্ষের তুলনায় সামান্য। এর মধ্যে একটি গুলি এসে বিদ্ধ করল মোস্তফাদের মেশিনগানধারীকে। থেমে গেল মেশিনগান।
যুদ্ধের কৌশল বদলে প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে পেছনে সরে যাওয়ার একটা উপায় ঠিক করলেন মোস্তফা। প্রায় ৮০০ গুলি নিয়ে একটি এলএমজি হাতে ঢুকে পড়লেন ট্রেঞ্চের মধ্যে। এগিয়ে আসা পাকিস্তানিদের দিকে অনবরত বুলেট-বৃষ্টি ঝরিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখলেন তাদের।
নিরাপদে পিছু হটার জন্য সময় ও সুযোগ প্রয়োজন। পিছু না হটলে তো মুক্তিবাহিনীর পুরো দলটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মোস্তফা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিই কাভারিং ফায়ার দেবেন। একাই গুলি চালাতে লাগলেন উত্তরে, দক্ষিণে, পশ্চিমে। সবাইকে নির্দেশ দিলেন পিছু হটার জন্য। অন্যরা তাঁকেও সরে আসার অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু মোস্তফা জানেন, কেউ একজন কাভারিং ফায়ারের দায়িত্ব না নিলে বাকি সবাইকে মরতে হবে। নিজের অবধারিত মৃত্যু অন্য সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে রাখবে—এই বাস্তবতা বুঝতে পেরে একাই লড়ে যেতে থাকেন মোস্তফা। তাঁর নির্দেশে বাকিরা নিরাপদে পিছু হটে চলে গেলেন আখাউড়ায়।
একসময় গুলি ফুরিয়ে গেল মোস্তফার। তিন দিক থেকে গুলি এসে ঝাঁঝরা করে দিল তাঁর শরীর। নিজের জন্য এভাবে নিশ্চিত মৃত্যুকে বেছে নিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে রাখলেন মোস্তফা। তিনি জানতেন, যুদ্ধের এখানেই শেষ নয়। এই সহযোদ্ধারাই জারি রাখবেন আগামী দিনের যুদ্ধ।
দরুইনের মাটিতে এখনো শায়িত আছেন মোস্তফা। সমরবিশারদ মেজর দেলোয়ার হোসেন সামরিক পরিভাষায় তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘রিয়ারগার্ড অ্যাকশন হিরো’ হিসেবে। এই ‘রিয়ারগার্ড’ যেভাবে একক প্রতিরোধে সহযোদ্ধাদের রক্ষা করেছেন, যেকোনো যুদ্ধের ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা। কল্পনাকেও যেন হার মানায় যুদ্ধক্ষেত্রের এই বাস্তবতা। এ কারণেই মোস্তফার নামের সঙ্গে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ তকমাটি এত যুক্তিসংগত।
এই লেখা শুরু করেছিলাম মোহাম্মদ সেলিমের কথা দিয়ে। মোহাম্মদ মোস্তফার একমাত্র ভাই মোস্তাফিজের ছেলে এই সেলিম। তিনি এখন ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ মোস্তফা গ্রন্থাগার ও জাদুঘর’-এর গ্রন্থাগারিক। তিনি জানালেন, হাজীপুর গ্রামটি নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর মোস্তফার মা, ভাই ও পরিবার এখন থাকেন ভোলা উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুপী গ্রামে। মৌটুপী গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে মোস্তফানগর।
মোস্তফার নাম নিয়েও একটা বিভ্রান্তি আছে। কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় বা বইয়ে তাঁর নাম ‘মোস্তফা কামাল’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গ তুলতেই সেলিম বললেন, ‘এর কারণটা তো জানি না। সেনাবাহিনীতে বক্সার হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। হয়তো তখন কেউ কেউ কামাল আতাতুর্কের নামের সঙ্গে মিলায়া এই নাম রাখছে।’
মোহাম্মদ সেলিম সামান্য বেতনে চাকরি করেন তাঁর বিখ্যাত চাচার নামে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে। এ নিয়ে কিছুটা আফসোস আছে তাঁর। কিন্তু তারচেয়েও বড় আফসোস হলো গ্রন্থাগারে হাজার তিনেকের মতো বই থাকলেও জাদুঘরটা নামেই জাদুঘর, অব্যবহৃত ফাঁকা পড়ে আছে। এখানে যদি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, দুর্লভ ছবি বা প্রামাণ্যচিত্র সজ্জিত থাকত, তাহলে দূর–দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হতো না।
চমকপ্রদ একটা তথ্য দিলেন সেলিম। মেঘনাগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া হাজীপুরে আবার চর জাগছে। শুনে শিহরিত হয়েছি। প্রতীকীভাবে হলেও এ যেন বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসের নতুন করে জেগে ওঠা!
মোস্তফারা তো কখনো মরেন না!
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত