বিজ্ঞাপন
default-image

৭ জুনের সকাল। আমরা জানতে পারলাম, শত্রুসেনারা ফেনী থেকে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১০টার দিকে বন্দুয়ার আশপাশে শত্রু সেনারা এসে জমা হতে লাগল এবং প্রথমবারের মতো আমাদের পজিশনের ওপর গোলাগুলি চালাতে লাগল। আমার নির্দেশ ছিল যে শত্রুদের এই গোলাগুলির কোনো জবাব যেন না দেওয়া হয়। শত্রুসেনারা বন্দুয়া সেতুর ওপর একটা বাঁশের পুল নির্মাণ করে যেমনি পার হওয়ার চেষ্টা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের অগ্রবর্তী ডিলেয়িং পজিশনের বীর সৈনিকেরা তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে প্রথম সারিতে যেসব শত্রুসেনা সেতু অতিক্রম করার চেষ্টা করে, তারা সবাই গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যায়। এ পর্যায়ে শত্রুসেনাদের অন্তত ৪০-৫০ জন লোক হতাহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা পিছু হটে যায়।

কিছুক্ষণ পর আবার প্রবল গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র আক্রমণ চালায়। আমাদের ডিলেয়িং পজিশনের সেনারা শত্রুদের আরও বহু সংখ্যক লোক হতাহত করে বীরত্বের সঙ্গে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে, কিন্তু আক্রমণ যখন আরও তীব্র রূপ ধারণ করে, তখন ডিলেয়িং পজিশনকে তারা পরিত্যাগ করে প্রধান ঘাঁটি মুন্সিরহাটে পিছু হটে আসে। শত্রুরা কিছুটা সফলতা লাভ করায় আরও প্রবলবেগে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ছিলোনিয়া নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ওখানে এসে তারা নদী পার হওয়ার সব প্রস্তুতি নেয়। আমাদের প্রধান ঘাঁটি থেকে ৮০০ গজ সামনে আনন্দপুর নামক গ্রামে শত্রুসেনারা তাদের সমাবেশ ঘটাতে থাকে।

নদী পার হয়ে আমাদের আক্রমণ করার জন্য শত্রুরা সব প্রস্তুতি নিতে থাকে। নদী পার হওয়ার আগমুহূর্তে কামানের সাহায্যে আমাদের ঘাঁটির ওপর তারা প্রবল আক্রমণ আরম্ভ করে। তারা বৃষ্টির মতো গোলা আমাদের অবস্থানের ওপর ছুড়ছিল। এ আকস্মিক আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্য আমরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম। এই সুযোগে পাকিস্তানি সেনারা নদী পার হওয়ার জন্য নৌকা এবং বাঁশের সেতুর সাহায্যে এগিয়ে আসতে থাকে। যদিও আমরা শত্রুদের কামানের গোলায় যথেষ্ট বিপর্যস্ত ছিলাম, তবুও মানসিক দিক দিয়ে আমাদের সেনাদের মনোবল ছিল বিপুল। ওদের বেশ সংখ্যক সেনা নদী পার হয়ে আমাদের অবস্থানের ২০০-৩০০ গজ ভেতরে চলে আসে এবং কিছুসংখ্যক তখনো নদী পার হচ্ছিল। ঠিক সেই সময় আমাদের মর্টার ও মেশিনগান গর্জে ওঠে। আমাদের এ অকস্মাত্ পাল্টা উত্তরে শত্রুসেনারা অনেক হতাহত হতে থাকে। তবু তারা বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে প্রবলবেগে অগ্রসর হতে থাকে।

আর আমাদের সৈনিকেরাও তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। তবু তারা নিঃসহায় অবস্থায় ও দক্ষতার সঙ্গে অগ্রসর হতে থাকে, কিন্তু আল্লাহ হয়তো ওদের সহায় ছিলেন না। এ সময় তারা আমাদের সামনের মাইন ফিল্ডের মুখে এসে পড়ল। তাদের পায়ের চাপে একটার পর একটা মাইন ফাটতে আরম্ভ করল। আমাদের চোখের সামনে অনেক শত্রুসেনা তুলোর মতো উড়ে যেতে লাগল।

আমাদের গোপনে অবস্থিত পাশের মেশিনগানগুলোর বৃষ্টির মতো গুলি ও মাইনের আঘাত তাদের মধ্যে একটা ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। শুধু কয়েকজন শত্রু এসব বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমাদের কয়েকটি অগ্রবর্তী বাংকারের সামনে পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু আমাদের সৈনিকেরা গ্রেনেড হাতে তাদের জন্য প্রস্তুত ছিল এবং তারা সেখানেই আমাদের গ্রেনেডের মুখে ধ্বংস হয়।

এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে শত্রুসেনারা আর সামনে এগোতে সাহস পায়নি। যারা পেছনে ছিল তারাও এই সংকটজনক অবস্থা এবং ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পেছন দিকে পলায়ন করতে শুরু করে। শত্রুসেনাদের পালাতে দেখে আমাদের সৈনিকেরাও উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে এবং আরও প্রবল গতিতে তাদের গুলি করে মারতে থাকে। আমাদের মর্টারও পশ্চাদপসরণরত শত্রুদের ওপর অনবরত আক্রমণ চালিয়ে তাদের হতাহত করতে থাকে। আমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে ওদের খুব কম সেনা ছিলোনিয়া নদীর অপর পারে পিছু হটে যেতে সক্ষম হয়। এ সময় আমাদের ওপর শত্রুসেনারা অনবরত কামানের গোলা চালিয়ে যাচ্ছিল, যাতে তাদের বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত যেসব অবশিষ্ট সেনা ছিল তারা নিরাপদে আরও পশ্চাত্ঘাঁটি আনন্দপুর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এর কিছু পরে দুইটার সময় তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে একটা নীরবতা নেমে আসে।

আমরা কিছুক্ষণ আবার তাদের পুনরায় আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, কিন্তু পরে জানতে পারি তাদের অবস্থা সত্যিই বিপর্যস্ত এবং তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙে গেছে। পুনরায় আক্রমণের শক্তি আর তাদের নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অন্ততপক্ষে ৩০০ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং ছিলোনিয়া নদীতে কত ভেসে গেছে সেটারও হিসাব আমরা পাইনি। পরে জানতে পারি, এই পাকিস্তানি সেনারা একটা ব্যাটালিয়নের চেয়েও বেশি সেনাদল নিয়ে এই আক্রমণ চালিয়েছিল এবং এ ব্যাটালিয়নের ৬০ ভাগের মতো লোক নিহত বা আহত হয়েছে। এদের অনেকের কবর এখনো ফেনীতে আছে।

default-image

১৭ জুলাই রাত আটটায় আমাদের ওপর শত্রুরা অকস্মাত্ আক্রমণ শুরু করে দেয়। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তিনটি হেলিকপ্টার আমাদের অবস্থানের পাশ দিয়ে পেছনের দিকে চলে যায়। চারদিক অন্ধকার ছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। হেলিকপ্টারগুলো অবস্থানের পেছনে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সেনারা বুঝতে পেরেছিল যে শত্রুসেনারা প্রতিরক্ষাব্যূহের পেছনে ছত্রীবাহিনী নামিয়েছে। আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো থেকেও খবর আসতে লাগল যে শত্রুরা মুহুরী ও ছিলোনিয়া নদীর পাড় দিয়ে এগিয়ে আসছে। ওদের সঙ্গে ট্যাংকও আছে। অবস্থানের সামনে বিপুল সেনা নিয়ে শত্রুর আক্রমণের প্রতিরক্ষা আর পেছনে তাদের ছত্রীবাহিনী আমাদের সেনাদের পেছন থেকে ঘিরে ফেলার জন্যও প্রস্তুত। এ রকম একটা সংকটময় অবস্থাতেও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন গাফফার, লে. ইমামুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন শহীদের নেতৃত্বে সামান্য শক্তি নিয়েও যুদ্ধের জন্য আমাদের সৈনিকদের মনোবল ছিল অটুট। ... আমি বুঝতে পারলাম, সকাল পর্যন্ত তারা যদি আমাকে এভাবে ঘিরে রাখতে পারে, তাহলে তাদের বিপুল শক্তিতে দিনের আলোয় এবং ট্যাংক-কামানের গোলায় আমার সেনাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেবে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিলপত্র, দশম খণ্ড।

সংক্ষেপিত

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত