বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের মার্চে আমি ছিলাম দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনে মিশন-প্রধান। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে গণহত্যা চালায়, তার খবর দু-এক দিনের মধ্যেই দিল্লিতে বসে আমরা পাই। তখনই সিদ্ধান্ত নিই পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার। ২৮ মার্চে আমি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা তখনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। পরে ৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে আমি ও প্রেস অ্যাটাচে আমজাদুল হক পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করি। আমার এ সিদ্ধান্তের পেছনে আরেকটি বিবেচনা কাজ করেছে। তখন রাজনৈতিক নেতারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কূটনীতিক হিসেবে আমি ভাবলাম, বিষয়টি বিদেশিদের জানানোর এখনই উপযুক্ত সময়।

১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্নিঝরা দিনগুলোর পর দীর্ঘ ৪০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ বছর আমরা স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপন করছি। এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৯৭১-এ আমাদের, বিশেষ করে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের স্বপ্নের কথাই বারবার ভাবি, যা ১৯৭১-এর এপ্রিলের ভয়াবহ দিনগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে দিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। একাত্তরে আমরা পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে নারকীয় অত্যাচার-নিপীড়ন চালাচ্ছিল তার প্রতিবাদ জানাতে।

আমরা শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও এ ব্যাপারে অগ্রণী হয়েছিলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে। ওই দুঃসময়ে আমাদের চোখজুড়ে ছিল এমন এক বাংলাদেশের—স্বাধীন বাংলাদেশের—সেখানে স্বাধীনতা পরিপূর্ণ অর্থেই বিকশিত ও অর্থবহ হয়ে উঠবে বাংলাদেশের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমাদের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ হবে একটি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে অবারিত। জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করতে পারবে, যেখানে দেশবাসী একনায়কত্ব বা সামরিক অপশাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হবে না, যে বাংলাদেশ সুশাসন নিশ্চিত করবে সামাজিক সম্প্রীতি, সবার জন্য আর্থসামাজিক সুবিধাবলি এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা।

আমরা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই স্বপ্ন দেখছিলাম এমন এক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনটি মূল স্বপ্ন—প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও সংসদ স্বাধীন এবং কার্যকরভাবে তাদের ভূমিকা পালন করে যেতে পারবে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ ছাড়াই। বিশ্বসমাজে আমরা বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছি এক মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে।

তরুণ প্রজন্মই পারে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে

স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এখন যখন ভাবি তখন মনে হয়, আমাদের স্বাধীনতা বাংলাদেশের জন্য অনেক অর্জনই বয়ে এনেছে। স্বাধীনতা-উত্তর অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে আমরা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও পুনর্গঠনে সক্ষম হয়েছি। আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে অনেক। তবে সংগ্রামী বাঙালি তার শ্রম ও কষ্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্যোত্পাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমরা এ ব্যাপারে প্রায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছি। জাতীয় উত্পাদনে আমাদের শিল্প ও সেবা খাত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষার প্রসার হয়েছে অনেক, নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে আমাদের অর্জন উল্লেখযোগ্য, মানব উন্নয়ন সূচকের উন্নয়নে আমরা অনেক এগিয়ে আছি পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের বাইরেও সামাজিক পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য, তা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। আমি যখন বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছি, তখন দেখেছি সবাই কীভাবে বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রতিরোধব্যবস্থা এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে থাকে।

তবে এসব অর্জনের বিপরীতে স্বাধীন বাংলাদেশের আরও অনেক অর্জন ও প্রাপ্তি সম্ভব ছিল, যা অর্জিত হয়নি এবং যা সব দেশবাসীর মতো আমাকেও বিষণ্ন করে তোলে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরমতসহিষ্ণুতার অভাব। সংঘাতসংকুল আচার-আচরণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পরিপূর্ণভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারাটা আমাদের জন্য এক বিরাট ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার জন্য আমাদের সবার চিন্তিত হওয়া উচিত। অনেক বছর ধরে দুর্নীতি রোধে আমাদের অক্ষমতাও আমাদের জন্য এক বিরাট চিন্তার কারণ। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থকে বড় করে দেখায় আমাদের জাতীয় স্বার্থ ব্যাহত হচ্ছে অমার্জনীয়ভাবে।

এখন সময়েরই দাবি, সংঘাতের পথ পরিহার করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে সবাইকে। আমরা লাখো বাংলাদেশি, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছি, আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়কে উত্সর্গ করেছি, তাদের জন্য এ ইতিবাচক পরিবর্তন হবে অসমাপ্ত স্বপ্নপূরণের প্রক্রিয়ায় এক বিরাট অর্জন।

অভিজ্ঞতার আলোকে আমার আরও মনে হয়, এক মর্যাদাশীল ও গতিবান ক্রম-উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমেই পরিমাণগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সব পর্যায়ে শিক্ষার মানকে উন্নত করতে হবে। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে মেধাভিত্তিক করে আরও সক্ষম করে তুলতে হবে। আত্মঘাতী দলাদলি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগকে অবশ্যই তাদের নিজ নিজ বলয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। প্রশাসনে ও রাজনৈতিক বলয়ে সব জায়গাতেই সবাইকে বুঝতে হবে, দুর্নীতিলব্ধ অর্জন কখনোই স্থিতিশীলতা আনতে পারে না। আমাদের অবশ্যই জাতীয় জীবনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরেকটি মুক্তিসংগ্রামের সূচনা করতে হবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসই সব অতীত অর্জন, বিশেষ করে পরাধীন আমলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের অর্জন সামলে আমাদের অর্জনই অর্জিত হয়েছে কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ নীতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ থেকে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়েছে তার গণতান্ত্রিক অধিকার জোরালোভাবে দাবি করে। আমরা তখনই আমাদের উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে পেরেছি, যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমরা সবাইকে সমভাবে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ সমৃদ্ধিও আমি মনে করি, এ নীতিগুলোর প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থনের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে।

নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে আমরা কী ভাবি?

default-image

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা বাস্তবায়নে এক বিরাট অবদান রাখতে পারে। তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে তা বিকাশের সুযোগ আমাদের অবশ্যই করে দিতে হবে। তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে, তাদের জীবনে হীনম্মন্যতার কোনো স্থান নেই। এক যোগ্য নতুন বাঙালি তরুণ প্রজন্ম অবশ্যই বাংলাদেশকে তার অভীষ্ট উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারবে।

কে এম শিহাবউদ্দীন: সাবেক কূটনীতিক।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত