বিজ্ঞাপন
default-image

এ বয়সে কি স্মৃতিগুলো ঠিকভাবে ধরতে পারা যায়? কিন্তু এমন কিছু স্মৃতি আছে, যেগুলো কখনোই পুরোনো হয় না। বিজয় দিবসে আমার অনুভূতি তেমনই একটি স্মৃতি। সেই দিনটির কথা মনে হলে আজও গর্বে বুক ভরে ওঠে।

একটু পেছনের কথা দিয়ে শুরু করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম তো আর এক দিনে হয়নি; এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ছিলাম রংপুরে। ছোটবেলা থেকেই আমি মায়ের সঙ্গে বসে তবলা বাজাতাম। তবলা বাজানোয় আমার বেশ দক্ষতা ছিল। বলে রাখি, তবলাকে বলা হয় সংগীতের মেরুদণ্ড। তবলা জানা থাকলে সংগীতের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হয়। ব্যাকরণিকভাবেই ছন্দ চলে আসে। ঢাকায় আসি বাষট্টির শেষ দিকে। এর আগে ছিল একষট্টি। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে এ দেশে বড় ধরনের একটি দ্বন্দ্ব শুরু হয়। জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল ইত্তেফাক ও সংবাদ পত্রিকা। বিপক্ষে ছিল আজাদ। দুটি পত্রিকায় তখন চলছিল বিবৃতিযুদ্ধ। সে সময় রংপুরেও আমরা রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছিলাম, মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্যকে গীতিনাট্য হিসেবে পরিবেশন করেছিলাম আমরা। আমি করেছিলাম আনন্দ চরিত্রটি। তখন আমার একটু একটু করে নাম হচ্ছে। অনেকেই আমাকে চিনতে পারছে। এর কিছুদিন পরই আমি ঢাকায় চলে আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য।

সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদ গণজাগরণের ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা একাডেমীসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় তখন অসংখ্য অনুষ্ঠান হতো। আমিও আস্তে আস্তে সেসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে লাগলাম। ঢাকায় আসার পর সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক আর কামাল লোহানী আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন।

১৯৬৪ সালেই শহীদ মিনারে ডাকসুর উদ্যোগে প্রথম উন্মুক্ত মঞ্চে ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান হয়। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। বিশাল চাঁদ আকাশে। বাতি ছিল না কোনো। সেই চাঁদনি রাতেই আমরা গান করেছিলাম। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। সে অনুষ্ঠানে আমি গাইলাম, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’। গানটি সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুর করা। আলতাফ মাহমুদই এ গানটি করতে অনুপ্রাণিত করেন আমাকে।

১৯৬৪ সালে দাঙ্গার পর আমি ঢাকা ছেড়ে চলে আসি রংপুরে। দাঙ্গার সময় আমার কথা ভেবে মা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েন, তাই সে সময় রংপুরেই অবস্থান করি। যতদূর মনে পড়ে, সে সময় পঙ্কজ ভট্টাচার্য রংপুরে এসে আমার গান শোনেন এবং আমাকে ঢাকায় চলে আসতে বলেন। যতদূর মনে পড়ে, ঢাকায় আসার পর বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিল সংস্কৃতি সংসদ। সে ছিল এ বিশাল সম্মেলন।

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। আমরা তখন গণমুখী গানই বেশি করতাম। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গণজাগরণমূলক গানগুলো তখন মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতাম আমরা। ঢাকার বাইরের অনুষ্ঠানগুলোতে হামলা হওয়ার আশঙ্কা থাকত; কিন্তু সেই আশঙ্কা তুচ্ছ করেই আমরা গান করতাম। পুরো দেশ তখন ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। দেশ তখন স্বাধিকার আন্দোলনে মাতোয়ারা।

এ সময় অনেকেই হূদয় দিয়ে কাজ করেছেন। শুধু গণসংগীতই নয়, গানের মাধ্যমে সে সময় যাঁরা অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে শেখ লুত্ফর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, সুখেন্দু চক্রবর্তী, আবদুল লতিফ প্রমুখের কথা বেশি করে মনে পড়ে। ষাটের দশকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পেছন থেকে সহায়তা করতেন ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন ও কামাল লোহানী। একুশে ফেব্রুয়ারির বিভিন্ন প্রধান অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, মতিউর রহমান, আবুল হাসনাত, আসাদুজ্জামান নূর, ইকবাল আহমেদ প্রমুখ।

এরপর একাত্তর। তখন তো প্রতিদিনই কোনো না-কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই যাওয়ার চেষ্টা করতাম আমি। সে সময় আমাদের হূদয়ে একটিমাত্র স্বপ্ন: স্বাধিকার। শোষণে জর্জর দেশকে স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

পঁচিশে মার্চের কথা মনে পড়ে। সে সময় ধানমন্ডি ওয়েস্ট এন্ড স্ট্রিটে ছোট্ট একটি বাড়িতে আমি থাকি। শহীদ মিনারে সেদিন ছিল অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠান শেষে বাড়িতে ফিরলাম রাতে। আশরাফুল আলম ছিলেন সঙ্গে। বাড়িতে পৌঁছে দেখি, আরও কয়েকজন সেখানে অপেক্ষা করছে। এরপর একসময় গুলির শব্দ। আগে থেকেই কানাঘুষা চলছিল, যেকোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আশঙ্কা সত্য করে ঠিকই শুরু হয়ে গেল আক্রমণ।

এ দেশে তখন থাকা নিরাপদ নয়, এটা জানতাম। কিন্তু দেশ ছাড়তে পারছিলাম না। আমার মা-বাবা ছিলেন রংপুরে। তাঁদের কোনো খবর না পেয়ে দেশ ছাড়ি কী করে? তিন-চার মাস মা-বাবার কোনো খবর পাইনি। সে সময় নিজের বাড়ি ছেড়ে ঢাকা শহরেই লুকিয়ে থাকতাম। বাফার সংগঠক আমানুল্লাহ চৌধুরী আর রাহিজা খানমের বাড়িতেই মূলত ছিল আমার আশ্রয়। তাঁদের আশ্রয় না পেলে সত্যি আমাকে বিপদে পড়তে হতো। অবশেষে খবর পেলাম, মা-বাবা ভালো আছেন। এবার ওপারে যাওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। মনিরুল ইসলাম মনু মুক্তিবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিল। সে যাত্রা ছিল ভয়ঙ্কর। যেকোনো মুহূর্তে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারত। দুই রাত দুই দিন ঘুরে ঘুরে অবশেষে পৌঁছে গেলাম আগরতলায়। সেখানে গিয়ে দেখা পেলাম ছাত্রনেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন আর শহীদুল ইসলাম সেলিমের। ওরা আমাকে খুব সমাদর করল। নিজেদের বিছানা ছেড়ে দিল। এরপর বিমানে করে কলকাতায় যাওয়া; সেখানে স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটাও ওরাই করে দিল।

কলকাতায় পৌঁছানোর পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক, শিল্পীরা আমাকে সিক্ত করল তাদের ভালোবাসা দিয়ে। কেউ দাদা, কেউ ভাইয়া বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমাদের সবার মনেই প্রতিজ্ঞা, ভালো কিছু ঘটাতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা লড়ছে রণাঙ্গনে, আমরা তাদের মনে সাহস সঞ্চার করব।

জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া ছায়াছবিতে আমি গেয়েছিলাম ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি। ছবিতে গানটি করেছিল আনোয়ার হোসেন। সেই গানটিই হয়ে গেল আমাদের জাতীয় সংগীত।

মনে আছে, একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে ঈদ এসেছিল একটিই। ঈদের দিন আমরা একটি গান করেছিলাম। গানটি লিখেছিলেন শহীদুল ইসলাম। সুর করেছিলাম আমি। গেয়েছিলেন রুপা ফরহাদ। গানের প্রথম তিন পঙিক্ত ছিল এ রকম:

চাঁদ তুমি ফিরে যাও

দেখো মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা

রূপালী আঁচল কোথায় রাখবে বলো।

কত যে গান, কত যে মানুষ সে সময় হূদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিল! সুকান্তর কয়েকটি গানে সুর করে গান করেছিলাম, মনে পড়ে।

তখন আমরা চাকরি হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করিনি। সে সময় আমাদের মধ্যে ছিল অসীম অনুপ্রেরণা। দেশের জন্য কাজ করছি, কীভাবে করব, কী করব, কী ধরনের অনুষ্ঠান হবে প্রভৃতি নিয়েই সবাই ব্যস্ত। একটা সুখানুভূতিও আমাদের হূদয় ছেয়ে থাকত। একদিন দেশ স্বাধীন হবে, সেই স্বাধীন দেশের মাটিতে গিয়ে দাঁড়াব আমরা—এই ভাবনা আমাদের উজ্জীবিত করে রাখত।

ষোলই ডিসেম্বরের সেই দিনটি কি ভোলা যায়। সবার মনেই আশঙ্কা, কী ঘটতে চলেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা যে একেবারেই খারাপ, সেটা বোঝা যাচ্ছিল কয়েক দিন ধরেই। তাদের প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হচ্ছিল বারবার। বেতার কেন্দ্রের সামনে একটি দোকানে চা খাচ্ছি, এমন সময় একজন এসে চিত্কার করে বলল, ঢাকার পতন হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন বাংলার নাগরিক! কী যে তখন মনের অনুভূতি, তা কি বলে বোঝানো যায়? আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে! এত তাড়াতাড়ি সত্যিই আমরা স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম!

শহীদুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানটি। সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। সেদিন কি কারও আর গান করার কথা মনে আছে। সবাই তো আনন্দে এ ওকে জড়িয়ে ধরছে। পারলে এখনই তারা ঢাকার পথে রওনা দেয়! গান গাওয়ার কথা বলতেই দাঁড়িয়ে গেল গোটা পঞ্চাশজন। তাদের আগ্রহে আনন্দ পেলাম আমরা, কিন্তু গানটা তো গান হতে হবে। তাই ১০ থেকে ১৫ জন মিলে গানটা করা হবে বলে ঠিক হলো। একজনকে তো শুরুটা ধরতে হবে। সুজেয় শ্যাম আমাকে বলল, ‘দাদা, আপনি লিডটা ধরুন।’ আমি ধরলাম। যখন ঢাকায় আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর হচ্ছে, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসছে গান—‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’।

গান হয়ে গেল। একটু পরেই দেখি, একের পর এক মিছিল আসছে। তাদের কেউ কেউ এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘দেশকে স্বাধীন করেছেন আপনারা; এ জন্য গর্ব করতে পারেন। এই বেতার ভবনটি চিরজাগ্রত থাকুক।’

সেদিনের অবস্থা বলে বোঝানো যাবে না। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে সেকি কান্না! এ কান্না আনন্দের। আমার মনে তখন বাজছে রবীন্দ্রনাথের গান—‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস’। মনে বাজছে—‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’।

ষোলই ডিসেম্বরের গর্ব, অহংকার সব সময়ই ধারণ করি বুকে। ওখানে হাত দেওয়া চলবে না।

অনুলিখন: জাহীদ রেজা নূর

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত