চলতি মাসের শুরুর দিকে অক্সফাম-বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ৬০ জনের সাক্ষ্য-এর (দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি) প্রকাশনা উত্সবের আয়োজন করে। ৬০ জনের সাক্ষ্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়াবহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের একটি সংকলন। সেই সময়ে এসব প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য সংগ্রহের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আমিই এখনো বাংলাদেশে বসবাস ও কাজ করে চলেছি। আমার মনে হয়েছে, ১৯৭১ সালে অক্সফাম-ইউকে কেন এ রকম প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নথি আকারে প্রকাশ করেছিল, তা পাঠকের জানা দরকার।
১৯৭১ সালে আমি ২৬ বছর বয়সী এক যুবক। আমি তখন অক্সফাম-ইউকের হয়ে সীমান্তের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় পাঁচ লাখ শরণার্থীর মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্বে। ভারতীয় সীমান্তের ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, বারাসাত, বনগাঁও প্রভৃতি আশ্রয়শিবিরে এসব ত্রাণকাজ চলছিল। কত দিন এ ভয়াবহ অবস্থা চলবে, তা আমাদের জানা না থাকায় কর্মপরিকল্পনা তৈরির সময় আমরা প্রতিবার ছয় মাসের জন্য পরিকল্পনা করতাম। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা পুরো শীতকালজুড়ে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। প্রতিমাসেই আমাদের ত্রাণকাজের জন্য নিয়মিতভাবে বড় অঙ্কের অর্থের জোগান লাগছিল।
নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে বায়াফ্রার পর এবং কম্পুচিয়ার আগে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অক্সফাম-ইউকের এ ত্রাণ কার্যক্রমটি ছিল সবচেয়ে বড়। এ ছাড়া শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও চলমান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করার প্রচারণা কার্যক্রমেও সংস্থাটি জোরদার ভূমিকা পালন করে। তখন মনে হয়েছিল, স্থায়ী এ সমস্যা মোকাবিলায় তহবিল সংগ্রহে দীর্ঘমেয়াদি একটি কর্মকৌশল নেওয়া দরকার। নেওয়া দরকার এমন একটি প্রচারণা কৌশল, যাতে পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষ অবগত হওয়ার পাশাপাশি সাহায্যেরও হাত বাড়িয়ে দেয়। এরই মধ্যে শীতের আগমনী বার্তা আসতে লাগল। শরণার্থীদের প্রয়োজন দেখা দিল শীতবস্ত্র ও কম্বলের। অক্সফাম প্রচারণা চালাতে লাগল, ‘আপনার বিছানা থেকে বাড়তি কম্বলটি তুলে নিন’, ‘বড়দিন উপলক্ষে একটি নতুন সোয়েটার কিনে পুরোনোটি দিয়ে দিন অক্সফামকে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই সময়ে অক্সফাম ও ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কলকাতামুখী কম্বলবাহী কোনো বিমানে শীতবস্ত্রের কোনো পার্সেল পৌঁছে দিতে ব্রিটিশ পোস্ট অফিস কোনো চার্জ নিত না।
ওই সময়ে ৯০০ ত্রাণশিবিরে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর জন্য খাদ্য-বস্ত্রসহ বেঁচে থাকার উপকরণ সরবরাহ করাটা অত্যন্ত কঠিন। অথচ ওই সময়ে তা করা হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে? অসংখ্য নারী-পুরুষের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাই এ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল। এই বীরেরা কোনো কৃতিত্ব বা খ্যাতির জন্য এটা করেনি, তারা শুধু সময়ের প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে যাচ্ছিল।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় এ সংকটের চিত্র খুব সামান্যই তুলে ধরা হচ্ছিল। ২৫ মার্চের গণহত্যার সংবাদের পর শরণার্থী শিবিরগুলোতে মে-জুনে কলেরার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার খবরটি আবার আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলোর শিরোনামে ঠাঁই করে নেয়। তবে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোতে ‘মৃত্যু চলছেই’, ‘এসব শরণার্থীরা কি আর কখনো বাড়ি ফিরবে?’, ‘পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ বায়াফ্রার চেয়েও ভয়াবহ’—এজাতীয় শিরোনামে সংবাদ ছাপা হতে থাকে।
যা-ই হোক, অক্সফোর্ডে অক্সফামের প্রধান দপ্তর থেকে সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশে চলতে থাকা পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের চোখ খুলে দিতে ও তাঁদের সজাগ করতে উপায় খুঁজে বের করা হবে। এ লক্ষ্যেই স্বল্প সময়ের মধ্যে ওই ভয়াবহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানি সংগ্রহ করে দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল নামের সংকলনটি ছাপানো হয়। সেই সংকলনে মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির মতো বিখ্যাত ব্যক্তি ও জন পিলজার, নিকোলাস টোমালিন এবং ক্ল্যারি হলিংওয়ার্থের মতো স্বনামধন্য সাংবাদিকদের বক্তব্য ও লেখা প্রকাশিত হয়। ক্ল্যারি হলিংওয়ার্থ চলতি মাসে তাঁর শততম জন্মদিন উদ্যাপন করেছেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কলকাতা থেকে বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য সংগ্রহকারী। একটি দিনের কথা মনে পড়ে। সেদিন অক্সফামের সদর দপ্তরে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য পাঠাতে আমার পুরো সোয়া এক ঘণ্টা লেগেছিল। দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটির কপি বহু সরকারপ্রধানের হাতে পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়। কাকতালীয়ভাবে ওই বছর জাতিসংঘের নিরাপত্তা অধিবেশন শুরুর প্রথম দিনই সংকলনটি প্রকাশিত হয়। ওই অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী সব রাষ্ট্রদূতের মধ্যে এর একটি করে কপি বিতরণ করা হয়। সংকলনটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশনার আগের দিন ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর ব্রিটিশ পোস্ট অফিস অক্সফামকে পুরো যুক্তরাজ্যের টেলিফোন ডিরেক্টরি দিয়ে সহায়তা করে। লন্ডনের ৪৯ পার্লামেন্ট স্ট্রিটে অবস্থিত অক্সফামের দোকানে এসব ডিরেক্টরি জড়ো করা হয়। এখান থেকে বেছে নেওয়া হয় চার কোটি ৯০ লাখ নাম। বাংলাদেশে এই সমসংখ্যক মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় ওই বছর উদ্বাস্তু হয়েছিল। এর মধ্যে ভারতে শরণার্থী হয়েছিল ৯০ লাখ আর দেশের ভেতর গৃহহারা হয়েছিল বাকি চার কোটি মানুষ। যুদ্ধ সেদিন এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রচণ্ড ক্ষুধা ও অভাবের মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
এ সময় মজার একটি ঘটনা ঘটে। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু ১৯৭১ সালের আগস্টে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সফরকারী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটির প্রতি সিনেট সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যুক্তরাজ্যে অক্সফাম এটি প্রকাশের মাত্র এক সপ্তাহ পরই ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে ‘কংগ্রেশনাল রেকর্ড’-এ এটি প্রকাশিত হয়। রেকর্ডে দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটির পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে মার্কিন সিনেটর কেনেডির এ পুস্তিকাটির ওপর দেওয়া সিনেট-ভাষণটি তুলে দেওয়া হয়:
‘জনাব প্রেসিডেন্ট, পূর্ব পাকিস্তানের সংকট আধুনিক বিশ্বের মানবেতিহাসের যেকোনো দুঃখজনক পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ। এটি পদ্ধতিগত ও সামরিক শক্তি প্রয়োগে গণহত্যার একটি ইতিহাস। এর ফলে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ও গৃহহারা হয়েছে। এটি মৃত্যু আর জরার কাহিনি, এটি খাদ্যাভাব আর পানীয় জল না পাওয়ার কাহিনি, এটি আশাহীন শরণার্থী শিবির আর দুর্ভিক্ষপীড়িত মফস্বল এলাকার কাহিনি।
পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত এ নৃশংসতায় সারা বিশ্বের নির্মমতাই যেন প্রকাশিত হয়েছে।
এ ধরনের দুঃখ-কষ্ট ও অন্যায় আমরা মেনে নিচ্ছি বলেই সম্ভবত এ পরিস্থিতি চলতে পারছে। কিন্তু অনেকের কাছেই বাঙালিদের দুর্দশা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষেরই আরেকটি রূপ।
জনগণ এখনো নিশ্চুপ, কারণ তারা এখনো এ নৃশংসতার খবর জানে না।
জনসাধারণের কাছে দ্রুত এ ঘটনা তুলে ধরতে ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্সফাম সম্প্রতি দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল নামের একটি হূদয়গ্রাহী গ্রন্থ প্রকাশ করে। এ বই যার হাতে পৌঁছাবে, সে-ই বাঙালি জনগোষ্ঠীর দুর্দশায় আলোড়িত হবে। একে একে সবাই জানবে এ দুর্দশার কাহিনি।
এই মর্মস্পর্শী নথি সিনেট সদস্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমি সর্বসম্মতিক্রমে রেকর্ড হিসেবে এ সংকলনটি ছাপানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।
এরপর কোনো আপত্তি না ওঠায় সাক্ষ্যগুলো রেকর্ড আকারে ছাপা হলো।’
এই সংকলনটি কংগ্রেশনাল রেকর্ড হিসেবে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ, সেই সময়ে মার্কিন সরকার পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও মার্কিন জনগণের একটি বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি লাখ লাখ ডলারের মার্কিন চিকিত্সাসামগ্রী পাঠানো হচ্ছিল অক্সফামের কাছে। এসব ওষুধ ও চিকিত্সাসামগ্রী শরণার্থী শিবির এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংকলনটির একটি হুবহু ইংরেজি প্রতিলিপি সংস্করণ প্রকাশ করে। যে দুঃখ, ভোগান্তি ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এ জাতি গঠিত হয়েছে, তার ইতিহাস আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে অবগত করাই ছিল এ প্রকাশনার উদ্দেশ্য। এরপর ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলো প্রকাশিত এর হুবহু বাংলা প্রতিলিপি সংস্করণ এ ইতিহাসকে আরও বেশিসংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
এটাই সেই ঐতিহাসিক সংকলনটি তৈরির পেছনের কারণ ও প্রকাশনার গল্প।
julian @clp-bangladesh.org
অনুবাদ: ইসরাত জাহান
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত