ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক নয়, শিহাব তা বুঝতে পারছে। আর বুঝতে পারছে বলে যত তার অশান্তি। এমন যদি হতো এটা একটা গহিন জঙ্গল বা পাহাড়ের পাদদেশ বা নির্জন কোনো উপত্যকা, সেখানে নানা প্রকার অস্বাভাবিক কাণ্ড-কারখানা ঘটতে পারে এবং ঘটলে কেউ তেমন অবাক হবে না, তাহলে এতে শিহাবের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু তা নয়, মোটেই নয়, বরং ঠিক তার উল্টো। নির্জনতা পড়ে মরুক, রাস্তায় হাঁটার সময় কারো না কারো গায়ে ধাক্কা না দিয়ে পথ চলার কোনো উপায় নেই, নাম ধরে ডাকতে গেলে, গলা ফাটিয়ে না চেঁচালে মানুষজনের ভিড়ে সে কানে শুনতে পায় না। অনেক সময় চেঁচিয়ে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গায়ে খামচিও মারতে হয়-এ দুটো একসঙ্গে না করলে মনোযোগ পাওয়া মুশকিল। এতসব ডামাডোলে প্রকৃতিও এখানে যেন ক্ষিপ্ত। সকাল হতে না হতে রক্তজবার মতো এক সূর্য মাথার ওপরে উঠে গনগন করে জ্বলতে থাকে, যেন কী সব অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে বলে তার এই ধরনের ক্ষুব্ধতা। এ ক্ষুব্ধতার শিকার হয়ে মানুষজন, পশুপাখি, গাছপালা যত ঘামতে থাকে, আইঢাই করে, হাঁফায়, সূর্য তত যেন অট্টহাসি দেয়।
ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক নয়, ইদানীং যেন আরো ভালো করে বুঝতে পারছে শিহাব মণ্ডল। কিন্তু জানে না কী করে সে এর সুরাহা করবে। সুরাহা কেউ করতে পারবে কি না তাও সে জানে না, তবু কল্পনা করে হয়তো কোনো দিন, কোনো মন্ত্রবলে বা জাদুর কাঠির ছোঁয়া পেয়ে সবকিছুর সুরাহা হয়ে আসবে। অস্বাভাবিক হয়ে আসবে স্বাভাবিক, বিকৃতি হয়ে আসবে সরল, অশুভ হয়ে আসবে শুভ। কিন্তু কবে, কখন, কীভাবে এসব হবে, আদৌ হবে কি না তা শিহাব জানে না।
তবু এতসব বৈরী পরিস্থিতি উপেক্ষা করেই শিহাব মণ্ডল তার ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। মানুষ বা সূর্য, খরা বা মৃত্যু জয়নুল ডাক্তারের কাছে কোনো ফ্যাক্টর নয়। ফ্যাক্টর হলো রোগী। যত রোগী তত পয়সা। যত পয়সা তত সুখ। জয়নুল ডাক্তারের মোটরসাইকেলের পেছনে শিহাব ডাক্তারি ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে দুপাশে দু-পা আঁটো করে ধরে বসে থাকে। চেম্বারের রোগী দেখা সেরে জয়নুল ডাক্তার বাড়ি বাড়ি রোগী দেখতে যায়। ভিড়, গরম, মাছি, দুপুরের রোদ, রাস্তার খানা-খন্দ তখন কোনো ব্যাপার নয়, তখন শিহাব মণ্ডল ছাড়া কে ডাক্তারের সফরসঙ্গী হয়! শিহাব মণ্ডলই তো সঙ্গী হয়। এক ও অকৃত্রিম সঙ্গী।
কবে থেকে শিহাব মণ্ডল জয়নুল ডাক্তারের সঙ্গী হয়েছে তা সে নিজেও জানে না। কোনো রকমে টুকে-ফুকে এসএসসি পাস করার পর সে বহুদিন ফ্যা ফ্যা করে এখানে-সেখানে ঘুরেছে। কাজ না পেয়ে একবার চুল কাটার দোকানে বেশ কিছুদিন চুলও কেটেছে সে। সেখান থেকেই নিজের চুলে কীভাবে কদমছাঁট করতে হয় শিখেছে। বয়স এখন শিহাবের প্রায় চল্লিশ, রগের দু ধারে সাদার ছোপ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু দেহটা ছোট এক জাতের বক পাখির মতো হওয়ায় বয়স বোঝা যায় না। বয়সের চেয়ে অনেক ছোট দেখা যায়।
জয়নুল ডাক্তারের বয়সও প্রায় পঞ্চাশ। সকাল দশটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত জয়নুল ডাক্তার রোগী দেখে, রোগী দেখে দেখে তার বাড়ির চৌহদ্দি সে সাদ্দাদের বেহেশতের মতো বড় করেছে। কোথায় গিয়ে এই চৌহদ্দি শেষ হবে তা যেমন ডাক্তার জানে না, তেমনি শিহাব মণ্ডলও জানে না। তার জানার ক্ষমতা নেই। শুধু এটুকু শিহাব জানে যে, তার মরার সময় নেই। সকাল সাড়ে নটার ভেতরেই সে জয়নুল ডাক্তারের বাড়ির ভেতর আঙিনায় পাটি পেতে বসে উবু হয়ে কাঁসার কাঁদা উঁচু থালায় গরম ভাত, ডাল আর ইচামাছের চচ্চড়ি দিয়ে হাপুস-হুপুস করে তার নাশতা সারে। তারপর কুয়োপাড়ে গিয়ে শব্দ করে মুখ কুলকুচি করে গামছায় মুখ মুছে জয়নুল ডাক্তারের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে ঢুকে ডাক্তারি ব্যাগটা বের করে হাতে ঝুলিয়ে সে বাজারের দিকে রওনা হয়। ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছে চেম্বার ঝাড়ামোছা শুরু করে। রোজই মাশাল্লা চেম্বারের ঘর ও বারান্দায় ইয়া পুরু হয়ে ধুলো জমে। কারণ বাজারের মাঝখানে চেম্বার স্থাপিত হলে এর আর কোনো বিকল্প নেই, ধুলো জমতেই হয় এবং শিহাব মণ্ডলকে ডাক্তার চেম্বারে পা দেওয়ার আগেই সে ধুলো ঝেড়ে-মুছে সাফ করতে হয়। তবে এতে ফাঁকি দেওয়ারও সুযোগ আছে। জয়নুল ডাক্তারের চোখের আড়ালে তার বই ও খাতাপত্র এবং ওষুধের বান্ডিলের ভেতরে অনেক ধুলো আসর জাঁকিয়ে বসেছে আজ বহুদিন ধরে, কিন্তু সেদিকে নজর দেওয়ার মতো সময় যেমন জয়নুল ডাক্তারের নেই, তেমনি নেই শিহাব মণ্ডলের।
চেম্বার খোলার পরপরই রোগীরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে। এসে তারা বারান্দায় আশ্রয় নেয়। কেউ আসে হাসিমুখে, কেউ আসে বিলাপ করতে করতে। কোনো কোনো রোগী শরীরের অসুখের চাপ সহ্য করতে না পেরে মেঝেয় পা মেলে দিয়ে বসে পড়ে, বেঞ্চিতে বসার মতো সময় বা ক্ষমতা তাদের থাকে না। কোনো কোনো রোগী আবার রোগ-যন্ত্রণায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ে মাটিতে, গড়াগড়ি দিয়ে কাতরায়। মোট কথা, জয়নুল ডাক্তার চেম্বারে পা রাখার আগেই তার ডাক্তারখানার অপেক্ষা-ঘর রোগীর সংখ্যায় ভরে যায়।
শিহাবের তখন কাজ বেড়ে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা আকিজ বিড়ি ফুঁকে (যেহেতু চেম্বারে ধূমপান নিষেধ) সে চেম্বারে ফিরে যেন আর ঢোকার পথই পায় না। ডিঙি মেরে, লাফিয়ে, শরীর কুঁকড়ে সে চেম্বারের ঘরে ঢুকে পাতলা ফিনফিনে কাগজে এক, দুই, তিন ইত্যাদি নম্বর লিখে সিরিয়াল তৈরি করে। এরপর সিরিয়াল বিলি করা শুরু হয়। হুড়োহুড়ি পড়ে যায় তখন। কে কত তাড়াতাড়ি সিরিয়ালের নম্বর এগিয়ে নিতে পারে সেই ব্যস্ততা দেখে শিহাব মণ্ডলের মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু রাগ করে না। জয়নুল ডাক্তারের হুকুম, রাগ করা চলবে না, রোগীর সঙ্গে রাগ করা চলবে না। তবু হুড়োহুড়ির ভেতরে যে আগে আসে তাকে পরে আর যে পরে আসে তাকে আগে সিরিয়াল বিলি করে বসে। এতে রোগীরা কেউ কেউ আপত্তি করে বটে, তবে সব সময় নয়। সেই হিসেবে এই মফস্বল শহরের রোগীদের আল্লাহ অসম্ভব ধৈর্য দিয়েছেন বললে ভুল বলা হবে না। এই একটি মাত্র পাস করা ডাক্তার তাদের এই এলাকায় যে বহু বছর ধরে একনাগাড়ে প্র্যাকটিস করে চলেছে, রাত-বিরাতে রোগীর বাড়িতে ডাকলে এখনো কাছে পাওয়া যায়। আর মফস্বলের রোগীরা তাড়াহুড়ো করে ডাক্তার দেখিয়ে যাবেই বা কোথায়। ডাক্তারের অপেক্ষা-ঘরই তাদের অনেকের জন্য সময় কাটানোর জায়গা। অনেক পুরনো ছেঁড়া ম্যাগাজিন এবং খবরের কাগজ আছে। সেগুলো নাড়াচাড়া করে অনেকে। তবে অধিকাংশের কিছু পড়ার দিকে ঝোঁক কম, তারা গল্প করতে এবং নিজের অসুখের বর্ণনা দিতে বেশি আনন্দ উপভোগ করে।
সিরিয়াল দেওয়ার সময়ই রোগীদের ফিসগুলো শিহাব মণ্ডল আদায় করে নেয়। এ ব্যাপারে জয়নুল ডাক্তারের কড়া হুঁশিয়ারি আছে। নো ফিস তো নো সিরিয়াল। সিরিয়ালের কাগজই ফিসের রসিদ। থাবা মেরে মেরে রোগীদের কাছ থেকে ফিস আদায় করে শিহাব মণ্ডল। যে রোগী মাটিতে শুয়ে ককাচ্ছে, তার কাছ থেকেও আগে সে ফিস আদায় করে নেয়। কোমরে বাঁধা লুঙ্গির গিঁট খুলে ময়লা এক টাকার নোট একটা একটা করে গুনে শিহাব মণ্ডলের হাতে তুলে দেওয়ার সময় কোনো কোনো রোগী বলে, ‘ও ভাই, ডাক্তাররে এট্টু বইলে আমারে এট্টু আগে দেখায়ে দেন দিনি, আমি যে আর থাকতি পারতিছি নে, দমডা বেরোয় যাবার মতন হইলো।’
তার হাতে একচল্লিশ নম্বর সিরিয়াল গুঁজে দিয়ে শিহাব মণ্ডল আশ্বাস দেয়, ‘এট্টু ধৈর্য্য ধরেন ভাই, ডাক্তারখানায় আলি পরে সবারই আপনার মতন দম বেরোয় যায়। ধৈর্য্য না ধরলি কি চলে?’
তা লি আমার ছিরিয়ালডা উনার পরে কেন দিলেন ভাই, আমি তো আগে আইলাম।
রোগীর কথা শুনে শিহাব মণ্ডল হেসে ওঠে। বলে, কিডা কখুন আসে তা আপনি ক্যামন কইরে জানবেন চাচা। বাজারে ঢুকারমুখী উনার সাথে আমার দেখা। তখুনি তো ছিরিয়াল দিছি।
তবে এই ফাঁকে রোগীর কাছ থেকে বিড়ি খাবার জন্য দুটো টাকাও সে আদায় করে নিয়েছে যে এ খবরটা চেপে যায় শিহাব মণ্ডল। তা না হলে আগে সিরিয়াল পাওয়ার ভাগ্য রোগীর হয়ে উঠত না।
মূলত শিহাব মণ্ডল কম কথার লোক। জয়নুল ডাক্তার যত কথা বলে তার রোগীর সঙ্গে, শিহাব মণ্ডল তার ছিটেফোঁটা বলে কি না সন্দেহ। সিরিয়াল আর টাকা নেওয়া শেষ হলেই শিহাব মণ্ডলের কাজ মোটামুটি সারা হয়। এরপর রোগীর নাম ধরে ধরে ডেকে চেম্বারে ঢোকানো। বাতাসের মতো দ্রুত রোগী দেখে সারে জয়নুল ডাক্তার। যে রোগী বারান্দায় শুয়ে ককাচ্ছে, চেম্বারে ঢোকার মতো ক্ষমতা নেই, ফিস দেওয়া না সারলে নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে তার গায়ে হাত রাখে না ডাক্তার। তখন তার অনেক সময় নষ্ট হয়। সময় নষ্টের তুলনায় রোগীর ফিস যথেষ্ট মনে হয় না।
একটার পর একটা রোগী দেখে জয়নুল ডাক্তার আর একটার পর একটা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে থাকে শিহাব মণ্ডল। কখন শেষ হবে রোগী দেখা, আদৌ শেষ হবে কি না, এদিকে দুপুর গড়িয়ে চলল।
ঠিক দুটোর দিকে জয়নুল ডাক্তার ব্রেক নেয় কিছুক্ষণ। তখন তার মোটরসাইকেলের গায়ে শক্ত একটা ব্যাগে ঝুলিয়ে রাখা টিফিনক্যারি বের করে ডাক্তারখানার টেবিল পরিষ্কার করে সেখানে একটা একটা করে টিফিনক্যারির বাটি খুলে পেতে রাখা হয়। সে বাটিতে থাকে শুকনো রুটি, তরকারি আর হালুয়া। দুটো মাত্র শুকনো রুটি তরকারি বা ভাজি দিয়ে খেয়ে, চার চামচ হালুয়া মুখে পুরে টিফিনক্যারির অন্য খাবারগুলো সে শিহাব মণ্ডলের জন্য রেখে দেয়। বারান্দায় বসে সেগুলো খায় শিহাব মণ্ডল। রোগীরা ধৈর্য ধরে বসে শিহাবের খাওয়া দেখে। অপেক্ষা করে কখন তাদের ডাক পড়বে আবার।
খাওয়ার আগে অবশ্য জোহরের নামাজ পড়ে নেয় জয়নুল ডাক্তার। এ তার নিয়ম। কোনো নামাজই সে পারতপক্ষে বাদ দেয় না। তবে শিহাব মণ্ডলের এসব বালাই নেই। নামাজ-টামাজের ধার ধারে না সে। এতে করে জয়নুল ডাক্তার তার ওপর যে না-খুশি, তা নয়। বরং বলা যায় গোপনে সে একটু স্বস্তিবোধই করে। নইলে ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে তার অ্যাসিসট্যান্টও যদি এভাবে নামাজ পড়তে থাকে তাহলে ওদিকে রোগী সামলানো একটু ঝামেলার হয়ে যায়। ধর্মও কখনো কখনো কোনো কোনো মানুষের জন্য বিলাসিতা বৈকি, এ কথাও জয়নুল ডাক্তার ভাবে। তবে ভাবনাটা হয় গোপনে। শিহাব মণ্ডল থাকতে কোনো রোগী জয়নুল ডাক্তারকে ফিস না দিয়ে পালাবে এমন রোগী ভূ-ভারতে জন্মায়নি, সেটাও জয়নুল ডাক্তার জানে। সেই কোন কালে সে শিহাবকে একবার টাইট দিয়েছিল, তারপর থেকে সবকিছু বিলকুল ঠিকঠাক। একবার এক রোগী শিহাবকে ফিস না দিয়ে পালিয়েছিল, সে মাসে শিহাবের মাইনে থেকে সে ফিসের টাকাটা কেটে রেখেছিল। কবেকার কথা, কিন্তু তারপর থেকে একবারের জন্যও আর ফিসের টাকা মার যায়নি।
তবে সবকিছু ঠিকঠাক করলেও শিহাবের ভেতরে কেমন যেন এক রহস্যের সন্ধান পায় জয়নুল ডাক্তার। এ রকম চুপচাপ থাকা, বেশি কথা না বলা, সারা জীবন বিয়ে না করা-এ সবকিছু একটু কেমন যেন মনে হয় তার। তবে ভাবনাটা যত দ্রুত মনে আসে, তত দ্রুতই আবার মিলিয়ে যায়। বিয়ে না করাটা বরং ভালো, বিয়ে করে শিহাব করবেটা কী, একমাত্র বাচ্চা পয়দা করা ছাড়া? আর তখন শুরু হবে নানা বাহানা, কাজে না আসার ফন্দিফিকির। সে হিসেবে শিহাবের নামাজ না পড়া এবং বিয়ে না করাটা জয়নুল ডাক্তারের ডাক্তারির জন্য বেশ সাহায্যকর, এ কথাও ভাবে সে।
জয়নুল ডাক্তার যেমন শিহাব মণ্ডলকে ঠিকমতো বোঝে না, তেমনি শিহাব মণ্ডলও জয়নুল ডাক্তারকে বুঝতে ব্যর্থ হয়। রাত দশটা বাজার পর শিহাব মণ্ডল যখন বাড়ি ফিরে ঘুমের জন্য উসখুস করতে থাকে; তখন জয়নুল ডাক্তার যেন হয়ে ওঠে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। আর ঠিক সেই সময় শহরের মাস্তানগুলো এসে ঢোকে। ততক্ষণে চেম্বার ফাঁকা, রোগীরা সব ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বাজারের ভেতর দিয়ে রওনা হয়ে গেছে। বাজারও ততক্ষণে পাতলা হতে শুরু করেছে। জয়নুল ডাক্তার মাস্তানদের দেখে বিগলিত হাসি দিয়ে আপ্যায়ন করে। সে হাসি দেখে মাস্তানদের ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হয় শিহাব মণ্ডল জানে না, তবে তার নিজের ভেতরে অচেনা সব জীবজন্তু যেন চিত্কার দিয়ে ওঠে। কে যেন নিড়ানি দিয়ে তার ভেতরে আঁচড়ায়। কালীপুজোর অন্ধকারের ভেতরে পতঙ্গেরা উড়তে থাকে। কাছের কবরস্থান থেকে কঙ্কালেরা উঠে এসে একে অপরের শরীরে আঘাত করে ঠা ঠা শব্দ করে হাসে। বিশ্রী সব ঘটনা ঘটে যায় শিহাব মণ্ডলের ভেতরে। কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো সে তার বাইরেটা রাখে নির্বিকার। বরং জয়নুল ডাক্তারের নির্দেশে সে মনু মিয়ার দোকান থেকে গরম রসগোল্লা কিনে আনে, দোকানে অর্ডার দিয়ে পুরি ভাজা হয় কখনো কখনো গরম রসগোল্লার রসে চুবিয়ে খাবার জন্য, চা আসে, আসে সিগারেট পাঁচ পাঁচ পাঁচ। খাওয়ার সময় গল্প হয়। খাওয়া শেষে মাস্তানদের সার্টিফিকেট দিতে বসে জয়নুল ডাক্তার। কেউ অমুক তারিখে প্রচণ্ড পেটব্যথায় বাড়ির বাইরে যেতে পারেনি, কেউ পেট খারাপ হওয়ার জন্য স্যালাইন হাতে নিয়ে ওমুখ তারিখে বিছানায় পড়ে ছিল, কেউ বা জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে প্রলাপ বকছিল অমুখ একটা দিনে। এই দিনগুলো এ শহরের বাছাবাছা দিন-যেদিন কেউ খুন হয়েছিল বা ছিনতাই হয়েছিল বা ধর্ষিতা হয়েছিল।
সার্টিফিকেট দেওয়া শেষ হলে মাস্তানরা তাড়াহুড়ো করে বিদায় নেয়। জয়নুল ডাক্তারও এরপর তাড়াহুড়ো শুরু করে। চেম্বারের বারান্দায় টেনে তোলা হোন্ডা মাটিতে নামিয়ে আনে শিহাব মণ্ডল। জয়নুল ডাক্তার হোন্ডায় উঠে হোন্ডা স্টার্ট দেয়, ভুরু কুঁচকে শিহাব মণ্ডল ডাক্তারের পেছনে ব্যাগ আঁকড়ে ধরে বসে। খুব শক্ত করে ব্যাগ ধরে থাকে সে। সারা দিনের রোজগার এই ব্যাগে থাকে। ময়লা এবং চকচকে টাকায় ভর্তি রোজগার, সব সাধারণ রোগীদের কাছ থেকে ফিস হিসেবে পাওয়া। সেঙ্শাল রোগী অর্থাত্ মাস্তানরা জয়নুল ডাক্তারকে কোনো ফিস দেয় না, বরং ফিস নেওয়ার ব্যাপারে তারা পারদর্শী। তাদের কাছ থেকে ফিস আদায় করার কথা ভাবেও না জয়নুল ডাক্তার। গুয়ের নাদায় লাঠির বাড়ি মারবে এমন বোকা জয়নুল ডাক্তার নয়। শিহাব এ ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারলেও পুরোটা বোঝে না। যদি মাস্তানদের কাছ থেকে ফিস না নিলে জয়নুল ডাক্তারের দিব্যি চলে যায়, তাহলে গরিব জেলে এবং কৃষকদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে ফিস না নিলে কী এসে যায় ডাক্তারের। এসব ফিস না নিলে তো জয়নুল ডাক্তারের ব্যাগ এত ময়লা টাকায় ভর্তি থাকত না। যতটুকু টাকা পেত সে, সবটুকু হতো তখন চকচকে টাকা। যে টাকার গায়ে ময়লার গন্ধ নেই, চোখের পানি নেই, যন্ত্রণার ছাপ নেই। শিহাব মণ্ডল খেয়াল করে দেখেছে এ শহরে যত মাস্তানের উপদ্রব বাড়ছে, তত জয়নুল ডাক্তারের ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ রোগীর ওপর। আজকাল সে রোগীদের তুই-তোকারিও করতে শুরু করেছে। ফিসের একটা টাকা কম পড়লেও সে রোগী না দেখে তাড়িয়ে দিতে শিখেছে। এসব কিসের আলামত শিহাব মণ্ডল জানে না। নিরীহ রোগীরা কেন মাস্তানদের জায়গায় জয়নুল ডাক্তারের ক্ষোভের শিকার হবে এটা বোঝার ক্ষমতা শিহাব মণ্ডলের আওতার বাইরে।
আজ রোববার। জয়নুল ডাক্তারের চেম্বার আজ সকাল দশটার আগেই বসে গেছে। শহরে রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে ইদানীং। শুক্রবারের জুম্মার নামাজের আগ পর্যন্ত চেম্বার খোলা রাখতে হয়। নইলে শনিবারে চাপ পড়ে যায় বেশি। শিহাব আজ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে রোগী সামলাতে। একটার পর একটা। শিশু, পঙ্গু, ভরপুরো পোয়াতি, বুড়ো-একটার পর একটা। আজ বারান্দায় সব রোগীর জায়গা হয়নি, অনেকে বারান্দা ছাড়িয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। ওদের জন্য রাস্তার মানুষদের চলাচলের অসুবিধে হচ্ছে, গাড়ির হর্ন বাজছে একভাবে, রিকশাঅলা মুখে ফেনা তুলে গালি দিচ্ছে। গরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, গুড় বহনকারী রিকশা-ভ্যান গুঁতোগুঁতি করছে নিজেদের সঙ্গে। তবু এর ভেতরেও মানুষের চলাচলের বিরাম নেই। রাস্তা না পেয়ে মানুষ যেন জড়াজড়ি করে পথ পার হচ্ছে। ক্ষেতের শস্যের সংখ্যা গণনা করলেও এ দেশের মানুষের সংখ্যার চেয়ে তারা কম হবে-এ বিশ্বাস শিহাব মণ্ডলের। তবু এটা ভেবে তার এখন সময়ক্ষেপণ করার সময় নেই। সকাল থেকে দু হাতে রোগী সামলাতে হচ্ছে তাকে। আর আজই প্রথম এ অবস্থা দেখে জয়নুল ডাক্তার বলে উঠেছে-‘সামনের মাস থেইকে চেম্বারে আরেকজন মানষির দরকার হবেনে শিহাব, খোঁজ রেইখো।’
দুপুরে ঠিকমতো আজ খাওয়াও হলো না শিহাবের।
রুটির টুকরো মুখের মধ্যে পুরে একবার সে এদিক, একবার ওদিক করতে লাগল। আর আল্লাহর কী খেয়াল, আজ যেন আকাশ ফেটে পড়ছে সূর্যকিরণে। যেন আর একচুল নিচে নেমে এলে দুনিয়া পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ফ্যান ঘুরছে বনবন করে। বারান্দায় টেনে আনা হয়েছে লম্বা ডাঁটিঅলা টেবিলফ্যান। তার মাথা অনবরত ঘুরছে এদিক-ওদিক। পাগলের মতো যেন সেও চেষ্টা করছে এই দাবানলের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে। শিহাব মণ্ডল নিজের রক্তের ভেতরে দুপদাপ শব্দ শুনতে পেল। রাস্তার লোকজন মাথায় ছাতা মেলে হাঁটছে। মাটি যেন কালো হয়ে তেতে উঠেছে। চেম্বারের দেয়ালে হাত দিয়ে দেখল দেয়ালগুলোও যেন ঘামছে। একটা ঘোরের ভেতরে পড়ে গেল যেন শিহাব মণ্ডল। রোগী, সিরিয়াল, টাকা, চেম্বার, জয়নুল ডাক্তার-সব চোখের সামনে নাগরদোলার মতো ঘুরতে লাগল।
ওদিকে জয়নুল ডাক্তার আজ ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। একভাবে রোগীর সঙ্গে কথা বলছে, প্রেসক্রিপশন লিখছে, উপদেশ দিচ্ছে, আবার রোগী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্র বেল টিপে নতুন রোগী ঘরে পাঠাতে বলছে। সেই ফাঁকে একবার শিহাব মণ্ডলের দিকেও সে তাকাল। তারপর কী ভেবে বলল, গায়ের জামা খুইলে ফ্যালো শিহাব, মনু মিয়ার দোকান থে ঠাণ্ডা পানি এইনে মাথা ভিজাও। তো উপদেশ মতো তা-ই করল শিহাব। কিন্তু তাতে আর শান্তি কতক্ষণ। হাজার পানি দিয়ে মাথা ভেজালেও তো সূর্য মাথার ওপর থেকে সহজে নড়ছে না।
সেদিনও বাড়ি ফিরতে রাত হলো তাদের।
মাস্তান পার্টি বিদায় নেওয়ার পর ঘড়িতে বাজল সাড়ে এগারোটা। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত জয়নুল ডাক্তার টিফিনক্যারি ব্যাগে ভরে হোন্ডার পাশে ঝুলিয়ে শিহাবকে পেছনে বসিয়ে আল্লা বলে রওনা হলো। যাওয়ার আগে অবশ্য বাড়িতে ফোন করে জানাল তারা রওনা হচ্ছে। চেম্বার থেকে বাড়ি এক মাইল। পথে একটা পাগাড়, একটা কালভার্ট আর কতকগুলো আম-কাঁঠালের বাগান পেরোতে হয়। একবার হোন্ডার স্টার্ট দিলে চোখের নিমেষে বাড়ি পৌঁছে যায় তারা। আগে রিকশা বা তারও আগে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরত জয়নুল ডাক্তার। সেসব দিন শেষ। এখন সমৃদ্ধির দিন, সামনে তাকানোর দিন, বড় ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর দিন।
শিহাব শক্ত হাতে ডাক্তারি ব্যাগ ধরে বসে থাকল পেছনে। আজ এই ব্যাগ খুব ভারী। এর ভেতরে ডাক্তারি যন্ত্রপাতি ছাড়াও আছে সারা দিনের রোজগার। ময়লা আর চকচকে টাকায় ভর্তি। শিহাব এত দিনে বুঝে গেছে, ময়লা আর চকচকের মিশেল ছাড়া এ দুনিয়াতে জয়নুল ডাক্তারের মতো মানুষেরা বাঁচতে পারে না। তবু, এতসবের পরও কোথায় যেন একটা ভালো না থাকার অনুভব শিহাব তার শরীরের ভেতরে ঢেউ তুলে ভেসে যেতে দেখে। তার কেন এ রকম অনুভূতি হয় সে জানে না। আজ ষোলটা বছর সে এই জয়নুল ডাক্তারের সঙ্গে থেকে চুলদাড়ি পাকিয়ে ফেলল, তারপরও তাকে বুঝতে পারল না বলে মনে যেন একটা ক্ষোভ থেকে যায়। আরো ক্ষোভ হয় যখন তার মনে হয় নিজের অজান্তেই সে তার ভাগ্যকে এই ডাক্তারের জীবনের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। অথচ এটা হওয়ার কথা না। অন্তত এতে শিহাবের কোনো লাভ নেই। হোন্ডা চালু করার আগে রোজকার নিয়মমতো মুখ একপাশে ফিরিয়ে জয়নুল ডাক্তার বলে উঠল, কী, ঠিক আছো তো মিয়া?
জে। উত্তরে মাথা নেড়ে পেছন থেকে বলে উঠল শিহাব মণ্ডল। এরপর সামান্যটুকু সময় পেরিয়েই বিদ্যুতের মতো ছুটে চলল ডাক্তার জয়নুলের হোন্ডা। দোকানের ভেতরে ঘুমোনোর জোগাড় করতে করতে বাজারের লোকেরা আপন মনে বলে উঠল, এই জয়নুল ডাক্তার বাড়িতি যায়। রাতের অন্ধকার এবং নিস্তব্ধতার নিরেট দেয়াল ভেদ করে দুজনে তারা ছুটে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে।
কালভার্ট পেরোনোর সময় কী যেন একটা গণ্ডগোল বেধে গেল। ছট করে একটা গুলি এসে লাগল হোন্ডার পেছনের চাকায়। মুহূর্তের ভেতরে ঠিক করে কিছু বোঝার আগেই কাত হয়ে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল দুজনে।
হলো কী, এ্যাঁ কী হলো, বলতে বলতে মাটি ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জয়নুল ডাক্তার। তখুনি আরেকটা গুলি এসে বিঁধল তার পিঠে। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল ডাক্তার। সেই মুহূর্তে যেন এক স্বপ্ন ও আচ্ছন্নতার গর্তের ভেতরে নিক্ষিপ্ত হলো শিহাব মণ্ডলের বোধ। রাত্রির অন্ধকার বিকট এক চিত্কারের বুলেট দিয়ে ফুঁড়ে সে গড়াতে লাগল রাস্তায়। গড়াতে গড়াতে কালভার্ট পেরিয়ে ঢুকে গেল সে কাঁঠালের বনভূমিতে। সেখানে ঝালুম ঝুলুম পাতার আড়ালে আঁকাবাঁকা হয়ে পায়ে চলার পথ। শিহাবের শরীরে এসে ভর করল এখন ক্ষিপ্ত ও মসৃণ এক সরীসৃপ গতি। সে অন্ধকার হাতড়েই এপথ-ওপথ, এপাশ-ওপাশ, এদিক-ওদিক হয়ে চলতে লাগল সমুখে। তারপর এল সেই জঙ্গল। কাঁঠালের বনভূমির পেছনে এ জঙ্গল কীভাবে এত দিন লুকিয়ে ছিল আল্লাহ মালুম। ব্যাগ শক্ত হাতে বগলে আঁকড়ে ধরে শিহাব এবার সেই জঙ্গলে ঢুকল।
তখন আর তার ভেদজ্ঞান নেই। কোনটা আগে কোনটা পরে নেই। থামাথামি নেই। সে চলতে লাগল, দৌড়াতে লাগল, ছুটতে লাগল। কখনো শুধু হাঁটা, কখনো দৌড়ানো, কখনো ছোটা, আবার কোনো কোনো সময় তিনটেই একসঙ্গে। এতসব হাঁটাহাঁটির ভেতরেও তার শরীর থেকে বিযুক্ত হলো না ব্যাগ। এর ভেতরে আছে সেই ময়লা ও চকচকে টাকার মিশেল-এ দুয়ের মিশেলে তৈরি জয়নুল ডাক্তারের জীবন, যে জীবনের সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের জীবনকে মিশিয়েছে শিহাব মণ্ডল। যার হাত থেকে শিহাবের পরিত্রাণ নেই।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটতে লাগল এবার শিহাব মণ্ডল। এখন শুধুই ছোটা। এখন তার সামনে যেন অনাদিকালের জন্য বিস্তারিত হয়েছে অনন্ত ও কালিমাময় এক রাত। এ রাতের ভেতরে ছুটতে গিয়ে শিহাব যেন পতিত হলো আরো এক গভীর জঙ্গলে, তারপর আরো গভীর, গভীর, গভীর; অনন্ত ও গভীর; গভীর ও অনন্ত। ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক নয় মোটেই, শিহাব মণ্ডল বুঝতে পারছে। কিন্তু তার করণীয় কিছু নেই, সে জানে না কীভাবে এটাকে সে স্বাভাবিক করবে। সে শুধু এটুকু জানে, এ রকম পরিস্থিতিতে মানুষের জন্য ভালো কিছু নেই।
লন্ডন, ২৭.৯.০৩
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত