বিজ্ঞাপন
default-image

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমেই মূলত বিশ্বপরিসরে পূর্ব পাকিস্তানের সংকট পৌঁছে যায়। এ কনসার্টের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তাঁর জন্ম ভারতের পশ্চিম বাংলায়। তিনি তখন বসবাস করতেন ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে। ভারতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে আসার খবর শুনে তিনি বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মী হয়ে ওঠেন। উদ্বাস্তুদের মধ্যে তাঁর অনেক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়-পরিজনও ছিল। তিনি তাদের, বিশেষ করে শিশুদের সাহায্য করতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। রবিশঙ্কর বাংলায় ‘জয় বাংলা’সহ বেশ কিছু গান বাঁধেন। এমনকি তিনি অ্যাপেল রেকর্ড থেকে একটি গানের অ্যালবামও বের করেন। কিন্তু সংকটের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে এই রেকর্ড বিক্রি থেকে যে যত্সামান্য লাভ হয়, তা ছিল নিতান্তই নগণ্য। ১৯৭১ সালের মে মাসে তিনি অনুধাবন করেন, বড় একটা কিছু করা দরকার। বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের কাছে তিনি একটি চ্যারিটি কনসার্টের পরিকল্পনার কথা জানান।

হ্যারিসন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। যদিও বছর খানেক হয় বিটলস ভেঙে গেছে; তিনি জানতেন, তার পরও বিটলসের ভাবমূর্তিকে কাজে লাগানো যাবে। হ্যারিসন স্মৃতিচারণা করে বলেন, জন লেননই তাঁকে বিটলসের ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর কথা জোর দিয়ে বলেন...। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে হ্যারিসন কাটিয়ে দেন সংগীতজ্ঞদের তালিকা বানাতে। তিনি সবার সহানুভূতিও পেয়ে যান। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট কনসার্টের দিন নির্ধারিত হয়। দিনটি ছাড়া আর কোনো খালি দিন ছিল না। কনসার্টের মহড়ার জন্য তাঁরা খুব একটা সময়ও পাননি।

তবে তার চেয়ে বেশি মাথাব্যথা ছিল শিল্পীদের একসঙ্গে পাওয়া। জন লেনন, রিংগো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, বিলি প্যাটারসন, ও লেওন রাসেলসহ সে সময়কার রক গানের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একত্র করতে চেয়েছিলেন হ্যারিসন। কনসার্টের এক সপ্তাহ আগে লেনন এতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন, ক্ল্যাপটনের গলায়ও ছিল সংশয়ের সুর। যদিও কনসার্টের আগের সপ্তাহে লন্ডন থেকে নিউইয়র্কের প্রতিটি বিমানে তার জন্য টিকিট বুক করা ছিল, তিনি এলেন ঠিক আগের দিন। তাও শেষ মহড়ায় অংশ নিতে পারলেন না। তিনি হাজির হন কনসার্টের শব্দযন্ত্রগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময়। ক্ল্যাপটন সে সময় নেশার শিখরে অবস্থান করছেন। কনসার্টের এক ঘণ্টা আগে হ্যারিসন দেখলেন, ক্ল্যাপটন অত্যন্ত বাজে অবস্থায় রয়েছেন। তিনি আসার পর কেউ তাঁর জন্য হেরোইন খুঁজতে গেছেন। কনসার্টের পুরোটা সময় তিনি চোখই খুলতে পারেননি, কিন্তু তাঁর গিটারে একবারও ছন্দপতন হয়নি। তিনি সত্যিই এক অমিত প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন।

আরেকজন বড় তারকা ছিলেন বব ডিলান। সংগত কারণেই হ্যারিসন তাঁকে মঞ্চে আনতে চেয়েছিলেন। বিটলস ও বব ডিলানের মধ্যকার সাংগীতিক সম্পর্কের সূচনা ১৯৬০-এর দশকের মধ্যপর্যায় থেকেই। আসলে বিটলস ডিলানের মধ্যে ‘রিদম অ্যান্ড ব্লু’র প্রতি পুনরায় আগ্রহ সৃষ্টি করে। এই ধারা তিনি বিকশিত করে পরে তা লোকগানের জন্য ছেড়ে দেন। ডিলানের গানে ১৯৬০-এর দশকের যুদ্ধবিরোধী চেতনার স্পর্শ পাওয়া যায়। তাঁর গানগুলো বিটলসকে তাঁদের গানে কাব্যের মিশ্রণ ঘটানোর অনুপ্রেরণা দেয় এবং রক এন রোলকে ফর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে উত্সাহিত করে। এই আঙ্গিক তাঁদের প্রজন্মের গভীরতম অনুভূতিকে ভাষা দিয়েছিল। ডিলান কনসার্টে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কথা দিলেও হ্যারিসন ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। প্রখ্যাত উডস্টক অনুষ্ঠানে তিনি যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কনসার্টের এক দিন আগে ডিলান এসে উদয় হলেন। কিন্তু এই জনসমুদ্র ও শত শত ভিডিও ক্যামেরার সামনে গান করার ব্যাপারে তিনি কিছুটা ভীত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ছোটখাটো ডিলান যখন তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক অ্যাকুইস্টিক গিটার ও হারমোনিকা র্যাক নিয়ে মঞ্চে উঠলেন, হ্যারিসন তখনই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

কনসার্টের ঘোষণা সারা দুনিয়ায় ভক্তদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কারণ, এই তারকাখচিত কনসার্টের ঘোষণা আসে এমন এক সময়, যখন রক এন রোলের জনপ্রিয়তা খাদের কিনারে। শীর্ষস্থানীয় রক দলগুলো তখন থমকে গেছে, বিটলস ভেঙে গেছে, এমনকি তাঁরা ব্যক্তিগতভাবেও অনুষ্ঠান করছিলেন না। ডিলান ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে ন্যাশবিল স্কাইলাইন অ্যালবামটি বের করার পর আর কোনো মৌলিক রেকর্ড বের করেননি। আরও কিছু চিন্তার বিষয় ছিল। এ সময় ১৯৬০-এর দশকের সংস্কৃতির অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচিত হতে শুরু করেছে। সংগীতজগতে ড্রাগের বিস্তার কতটুকু ঘটেছে, জিমি হেনড্রিক্স ও জেনিস জ্যাপলিনের মৃত্যু সে সম্পর্কে জানান দেয়। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে রোলিং স্টোন অ্যালটামন্ট স্পিডওয়ে ফ্রি ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করে। এতে যে ভাঙচুর ও মারামারি হয়, তাতে রক এন রোল জগতের কদর্য দিকগুলো বেরিয়ে আসে। তার মানে, দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শুধু একদল প্রতিভাবান শিল্পীকেই জড়ো করেনি, এটা একটি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে এগোয়, যা ১৯৬০-এর দশকের সবচেয়ে সেরা চেতনাকে জাগ্রত করে।

কনসার্টের বার্তা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করে রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করেন। এটি লক্ষণীয়, তাঁরা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা ‘পূর্ব বাংলা’র মতো নিরাপদ শব্দ ব্যবহার করেননি। সংবাদ সম্মেলনে হ্যারিসন বলেন, অর্থের চেয়ে সচেতনতা অনেক জরুরি। পরবর্তীকালে তিনি লেখেন, ‘আপনি আজ কাউকে খেতে দিতে পারেন, আগামীকাল সে ক্ষুধার্ত হবে; কিন্তু যদি গণহারে মানুষ মারা পড়ে, তাহলে প্রথমে সেটা বন্ধ করা উচিত।’ সংবাদ সম্মেলনের আগে তথ্যমাধ্যমে এর যে প্রচার দেওয়া হয়, তাতে কনসার্টের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কনসার্টের টিকিট বিক্রির সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা একজন টিভি প্রতিবেদক বলেন, এই কনসার্ট পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার কারণে যে বিপুলসংখ্যক শিশু উদ্বাস্তু হয়েছে, তাদের ত্রাণের জন্য। আবার অনেক ভক্ত বলেন, তাঁরা প্রকৃত অর্থেই পূর্ব পাকিস্তানের দাবির প্রতি একাত্মতা জানাতে এখানে এসেছেন।

দর্শকদের উত্সাহ-উদ্দীপনার কারণে ১ আগস্ট দুপুর ও বিকেলে হ্যারিসন পর পর দুটি কনসার্ট আয়োজন করতে বাধ্য হন। কনসার্টে দুটি বিশেষ কম্পোজিশন ছিল। রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খাঁ সেতার ও সরোদের যুগলবন্দী দিয়ে শুরু করেন। এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলা ধুন’। শুরুর আগে রবিশঙ্কর বলেন, ‘এই কনসার্ট কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, এর এক বার্তা রয়েছে। আমরা রাজনীতি করার চেষ্টা করছি না। আমরা শিল্পী। তবে বাংলাদেশে আজ যে তীব্র যন্ত্রণা, বেদনা ও দুঃখের ঘটনা ঘটছে, আমাদের সংগীত দিয়ে আমরা তা আপনাদের উপলব্ধি করাতে চাই। আমরা তাদের কথাও উপলব্ধি করাতে চাই, যারা বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে এসেছে।’ হ্যারিসন শেষ করেন ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ দিয়ে। ওই গানটিই ছিল যথেষ্ট। যদিও হ্যারিসনের গানের ‘বাংলাদেশকে রেহাই দাও’ অন্তরাটি কয়েকবার ছিল, হ্যারিসন গানটি শুরু করেন তাঁর বন্ধুর প্রতিবেশী দেশকে উদ্দেশ্য করে, ‘যেখানে বহু মানুষ মারা পড়ছে তো পড়ছেই’। এতে দর্শকেরা চট করে বুঝে যান যে বাংলাদেশের সমস্যা শুধু রাজনৈতিক নয়, এটা মানবিক বিয়োগান্তক ব্যঞ্জনায়ও গভীর।

কনসার্টের সফলতা ছিল রবিশঙ্কর ও হ্যারিসনের কল্পনারও বাইরে। তাঁরা ভেবেছিলেন, এ থেকে ২০ হাজার ডলারের মতো উঠবে। কিন্তু কনসার্ট শেষে আয় দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখ ডলার। ইউনিসেফের মাধ্যমে এ অর্থ ত্রাণের কাজে ব্যয় করা হয়। এই কনসার্টের বাণী এর ভেন্যুকে ছাড়িয়েও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সংবাদপত্রে তো ছবি ছাপা হয়ই, বিশ্বের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সেটা সম্প্রচারিত হয়। এরপর তিনটি ক্যাসেটের একটি বাক্সবন্দী অ্যালবাম বেরোয়, শিগগিরই তা সারা দুনিয়ায় তালিকার শীর্ষে চলে আসে। অ্যালবামের মূল প্রচ্ছদে একটি রোগা শিশুর শূন্য থালা সামনে নিয়ে বসে থাকার ছবি ছিল। ছবিটি মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে। অ্যালবামে যে নোট ছিল, তাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে একটি ‘পরিকল্পিত সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম’ ও হিটলার কর্তৃক ইহুদি নিধনের পর সবচেয়ে জঘন্য ও নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়।

বার্তা ও এর মাধ্যম একদম খাপে খাপে মিলে যায়। চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরবর্তীকালে ইউনিসেফের প্রধান ডেভিড প্যাটম্যান সেই বিকেলে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ছিলেন। এক দশক পরে তিনি বলেন, কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে ‘১৯৬০-এর দশকের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নযোগ্য’ ছিল। তা হোক বা না হোক, এ কথা সত্য যে এই কনসার্ট সেই প্রজন্মের অনুভূতিকে নাড়া দিতে পেরেছিল। জনগণের ওপর এর প্রভাব কত গভীর ছিল, তা পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়। পাকিস্তান সরকার তার সব দূতাবাসকে এই বলে সতর্ক করে দেয় যে এতে ‘পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা রয়েছে’। সঙ্গে সঙ্গে এও বলে দেয় যে তাদের সব রকম যোগাযোগের মাধ্যমে এর ‘সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে হবে’। সংগত কারণেই এর রেকর্ড পাকিস্তানে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।

শুধু এই কনসার্টের মাধ্যমেই নয়, অনুসাংস্কৃতিক তত্পরতা আরও নানা উপায়ে বাংলাদেশ সংকটে ঢুকে পড়ে। অন্য বড় তারকারাও নিজে থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জোয়ান বায়েজ। এমনকি তাঁর বন্ধু বব ডিলান দৃশ্যপটে আসার আগেই তাঁর গান তাঁর সময়ের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছিল। তিনি ছিলেন একজন উত্সর্গীকৃত গান্ধীবাদী। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কদমের সঙ্গে তিনি কদম ফেলেছেন। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে রাজনৈতিক সচেতন ও নৈতিকভাবে সংবেদনশীল শিল্পী। তাঁর গান বিভিন্ন সময় উত্তর ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, কম্বোডিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার নিপীড়িত মানুষ ও তাদের রাজনৈতিক দাবির পক্ষে কথা বলেছে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বায়েজ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ হাজার দর্শকের সামনে গান করেন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি বিশাল কনসার্টে তিনি ‘সং ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে গান করেন। বায়েজের এই গানের দুটি উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের সংকটসহ বিশ্বের সব মানবিক সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততা ও পাকিস্তানি বাহিনীর জঘন্য কার্যক্রম তুলে ধরা। তাই তিনি গানে গানে বলেন, ‘পরিবারগুলো ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরে’ অথচ পৃথিবী নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে, তাও আবার যেসব পুরোনো কারণে জাতির উদ্বোধন হয়েছিল, সেসব কারণে ‘ভূখণ্ডের জন্য মানুষের বিসর্জন’। এ গানে ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের গণহত্যার কথা রয়েছে: সেনারা ঠান্ডা মাথায় ছাত্রদের গুলি করে মারছে এবং বালিশগুলো রক্তে লাল হয়ে উঠছে। বায়েজের কনসার্ট হয়তো শ্রোতাদের হ্যারিসন ও রবিশঙ্করের মতো চালিত করেনি, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিকভাবে উদ্দীপ্ত গান দুনিয়াজুড়ে অসংখ্য মানুষের হূদয়ে ছাপ ফেলে যায়।

একই সময়ে বব ডিলানের বন্ধু বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ভারত সফরে আসেন। ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিমা বয়ঃপ্রাপ্তদের কাছে তিনি ভারতকে তুলে ধরেন। গিন্সবার্গ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একদল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন, যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৭১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর গিন্সবার্গ সুনীলকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে শরণার্থীশিবিরগুলো দেখতে যশোর রোডে যান। সীমান্তবর্তী শহর বনগাঁতে এসে গিন্সবার্গ এ কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান যে শরণার্থীশিবিরগুলোয় নাকি সপ্তাহে কেবল বৃহস্পতিবার খাবার দেওয়া হয়...সপ্তাহে শুধু এই একবারই রেশন দেওয়া হয়। যেতে যেতে গিন্সবার্গ তাঁর অনুভূতির কথা টেপ রেকর্ডারে বন্দী করেন: ‘খড়ের মতো দোকানগুলো সারা দিন খাদ্যের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাতাসে মলমূত্র, খাদ্য ও বিড়ির গন্ধ মিলেমিশে একাকার। ভারী বৃষ্টি, মহামারি, কলেরা। অনেক সুচওয়ালা বর্শা হাতে এক লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। গরিব অধিবাসী ও উদ্বাস্তুদের মধ্যে স্নায়ুচাপ। ‘তোমরা জমিদারের মতো আচরণ করছ,’ উদ্বাস্তুরা গরিব গ্রামবাসীর প্রতি অভিযোগ করে। গ্রামবাসীর পাল্টা অভিযোগ, ‘উদ্বাস্তুরা আমাদের ঘরের সামনে মলমূত্র ত্যাগ করছে।’

দেশে ফিরে গিন্সবার্গ একটি কবিতা লেখেন: ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর কবিতাটি নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হয়। গিন্সবার্গ নিজস্ব ওজস্বিতা ও খাপছাড়া ঢঙে তাঁর যশোর রোড ভ্রমণের কাহিনি বয়ান করেন: কলকাতা অভিমুখে উদ্বাস্তুদের মিছিল, শরণার্থীশিবিরের নোংরা পরিবেশ, পেট-ফোলা বাচ্চাদের খাবারের জন্য লাইন ধরা ও নবজাত শিশুদের ডায়রিয়া আক্রান্ত শীর্ণ হাত-পা। এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা ও এশিয়াতে তার অন্যান্য ক্ষেত্রে আগ্রহের মধ্যকার তুলনা টানেন তিনি। মার্কিন বিমানসেনা ও নৌবাহিনী সেখানে ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে না কেন? তারা ব্যস্ত ‘উত্তর লাওসে বোমা বর্ষণ’ আর নাপাম বোমায় ‘উত্তর ভিয়েতনামকে বরবাদ করায়’। কবিতাটি বিশ্ববাসীর স্বরযন্ত্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেষ হয়, একই সঙ্গে ‘চিন্তাশীল মার্কিনদের মস্তিষ্কে’ ‘ভালোবাসার সুর’ ধ্বনিত হওয়ার আহ্বান জানায়।

হ্যারিসন ও বায়েজের গানের মতো গিন্সবার্গের কবিতা বিশ্ববিবেকের তন্ত্রীতে, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বে সুরের মূর্ছনা তোলে। তাঁর কবিতা বাংলাদেশের সংকটকে সারা দুনিয়ার তরুণ প্রতিবাদীদের চিত্কারের সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে দেয়। ১৯৭১ সালের কয়েক মাসে মনে হয়েছিল, বাংলাদেশ যেন ১৯৬০-এর দশকের সব দোদুল্যমানতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে আশা ও আশঙ্কাকে পরিশুদ্ধ রূপ দিচ্ছে।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত