বিজ্ঞাপন
default-image

পঁচাত্তর বছর আগে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে পৃথিবীর ৭২ শতাংশ ছিল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের করায়ত্ত। পৃথিবীর মোট জনসমষ্টির ৭০ শতাংশ ছিল পরাধীন। ১৯৩৬ সালের মধ্যে এ অবস্থার সামান্য পরিবর্তন হয়। পৃথিবীর ৬০ শতাংশ মানুষ ঔপনিবেশিক নিগড়েই আবদ্ধ রইল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যখন ভারত স্বাধীনতা আইন পাস করে তখন জাতিসংঘের মোট সদস্য ছিল ৫১। এখন সারা বিশ্বে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৪।

রাষ্ট্রের জন্ম ও উত্থান-পতনের ইতিহাস বড় বিচিত্র। কখনো যুদ্ধ করে আবার কখনো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আপসে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সুইডেন থেকে নরওয়ে (১৯০৫), যুক্তরাজ্য থেকে আয়ারল্যান্ড (১৯২১), যুগো্পাভিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া, ্পোভেনিয়া, ম্যাসিডোনিয়া, বসনিয়া-হার্জিগোভিনা ও সার্বিয়া (১৯৯১), সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ১৪টি প্রজাতন্ত্র (১৯৯১), চেকো্পোভাকিয়া থেকে ্পোভাকিয়া (১৯৯৩) ও ইথিওপিয়া থেকে ইরিত্রিয়া আলাদা হয়ে যায়। ১৯৬০ সালে আফ্রিকায় ১৭টি এবং ১৯৯১ সালে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে ও মধ্য এশিয়ায়ও ১৭টি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক চমকপ্রদ ঘটনা।

যে-ভূখণ্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি অবস্থিত, সেখানে আগে ওই নামে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। ১৪ অক্টোবর ১৯৫৫ পর্যন্ত সেই ভূখণ্ডে পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ ছিল। তার আগে ১৯১১ সাল থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ পর্যন্ত সেই প্রদেশের নাম ছিল বঙ্গ প্রদেশ। আরো আগে ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ থেকে ১২ ডিসেম্বর ১৯১১ সাল পর্যন্ত এ দেশের কিছু অংশ পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং বৃহদাংশ ছিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের অন্তর্গত। ব্রিটিশ-ভারতে এক সময় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কর্তৃত্ব ছিল দিল্লি পর্যন্ত। রাজনৈতিক শিকস্তি ও পয়স্তিতে বাংলার সীমানা পরিবর্তিত হয়েছে বহুবার। বাংলাদেশের বেশ কিছু অংশ খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে অঙ্কিত টলেমির মানচিত্রে শোভা পায় গঙ্গাঋদ্ধি নামে।

বাংলাদেশ একটি অতিপুরাতন দেশ এবং এখনকার মানববস্তি প্রাগৈতিহাসিক কালের।

৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসে এক আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই...। আমি ঘোষণা করেতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বকালীন প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।”

১ জুলাই ১৯৭০ থেকে তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিটের অবসান ঘটে। পশ্চিম পঞ্জাবের নতুন নাম হয় পঞ্জাব। পূর্ব পাকিস্তান বাংলা, এমনকি পূর্ববাংলাও হলো না। পাকিস্তানিদের কাছে ‘বাংলা’ ও ‘দেশ’ দুটো শব্দই ছিল বড় অবাঞ্ছিত। ‘বাংলা’ শব্দের মধ্যে এক বিজাতীয় ও অনৈসলামিক অনুষঙ্গের রেশ লক্ষ করা হতো। আর ‘দেশ’ শব্দের মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার দ্যোতনা রয়েছে তাও বড় অপছন্দ ছিল ইসলামপসন্দ গোষ্ঠীর।

আবার অন্যদিকে বাংলাদেশকে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ ও ‘মুসলমানদের বাংলাদেশ’ বলে অ্যাখ্যায়িত করেন। ১৯৭২ সালে আমাদের দেশের ‘বাংলাদেশ’ নামকরণে পশ্চিম বঙ্গের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বড় অসন্তুষ্ট হন। এ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কূটনৈতিক প্রতিবাদ করা সমীচীন মনে করে তারা ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন।

‘বঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে বাংলাদেশের নাড়ির সমর্ঙ্ক। আমি অন্যত্র বলেছি, “ইতিহাস-ভূগোলে পরিচিত ‘বাংলাদেশ’-এর উত্সভূমি, হূেকন্দ্র ও চারণভূমির বৃহদাংশ তো বর্তমান বাংলাদেশের পরিধির মধ্যে বিরাজ করছে।”

কত ভাগ্যে আমরা সেই বাংলাদেশ পেয়েছি, যে দেশের নাম তার ভাষার নামে। এমন যৌগপত্য সৌভাগ্যের কথা। এই দেশের স্বাধীনতার বীজ নাকি এর ভাষার মণিকোঠায় সঙ্গোপনে রক্ষিত ছিল।

বাঙালিদের সমের্ক বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ইংরেজ এক জাতি, বাঙ্গালীরা বহু জাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি, তাহাদিগের মধ্যে চারি প্রকার বাঙ্গালী পাই। এক আর্য, দ্বিতীয় অনার্য হিন্দু, তৃতীয় আর্যানার্য হিন্দু, আর তিনের পর এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারি ভাগ পরসঙ্র হইতে পৃথক থাকে।’

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অপরিণত অবস্থা সমের্ক রবীন্দ্রনাথের মনে বরাবরই একটা দুর্ভাবনা ছিল। ১৩১৫ সনে ‘সমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, “এ কথা বলাই বাহুল্য যে, যে দেশে একটি মহাজাতি গড়িয়া উঠে নাই, সে দেশ স্বাধীন হইতেই পারে না। কারণ স্বাধীনতার ‘স্ব’ জিনিসটা কোথায়? স্বাধীনতা কাহার স্বাধীনতা? ভারতবর্ষে বাঙালি যদি স্বাধীন হয় তবে দাক্ষিণাত্যের নায়র জাতি নিজেকে স্বাধীন বলিয়া গণ্য করিবে না এবং পশ্চিমের জাঠ জাতি যদি স্বাধীনতা লাভ করে তবে পূর্ব প্রান্তের আসামি তাহার সঙ্গে একই ফল পাইল বলিয়া গৌরব করিবে না। এক বাংলাদেশেই হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান যে নিজের ভাগ্য মিলাইবার জন্য প্রস্তুত এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। তবে স্বাধীন হইবে কে।’

১৯২৩ সালের ৩ মার্চ কাশীতে অনুষ্ঠিত উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বাঙালি জাতীয়তা সমের্ক রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বাঙালিকে নেশন বলা যায় না। কেননা, বাঙালি এখনো আপন রাষ্ট্রীয় ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠেনি।’

নিজেদেরকে ‘বাংলা জাতি’ বলে উল্লেখ করলেও রবীন্দ্রনাথ কখনো ভারত হতে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা জাতির কথা চিন্তা করেননি। ‘মহাজাতি সদনে’ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বাংলার যে জাগ্রত হূদয়-মন আপন বুদ্ধির ও বিদ্যার সমস্ত সমঙ্দ ভারতবর্ষের মহাবেদিতলে উত্সর্গ করবে বলেই ইতিহাসবিধাতার কাছে দীক্ষিত হয়েছে, তার সেই মনীষিতাকে এখানে আমরা অভ্যর্থনা করি। আত্মগৌরবে সমস্ত ভারতের সঙ্গে বাংলার সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য থাকুক, আত্মাভিমানের সর্বনাশা ভেদবুদ্ধি তাকে পৃথক না করুক-এই কল্যাণ-ইচ্ছা এখানে সংকীর্ণচিত্ততার ঊর্ধ্বে আপন জয়ধ্বজা যেন উড্ডীন রাখে।’

‘জয় বাংলা’ বললেও নজরুলের ‘ভারত-লক্ষ্মী’ বা ‘ভারত জননী’র প্রতি আনুগত্য ছিল অান। তাঁর স্বপ্ন ‘ভারত মহাভারত হবে’ এবং যেদিন পীড়িত মানুষের প্রতিকারে প্রাণে সাড়া জাগবে, ‘মহা-মানুষের সেদিন সৃষ্টি হবে’।

প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বাঙালির পেট্রিয়টিজম’-এ বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে বৃহত্ ভারতের ভূমিকাকে সাম্রাজ্যবাদী বলে চিহ্নিত করে উল্লেখ করেন যে, ‘ইউরোপের কোনো জাতির সঙ্গে অপর জাতির সে-প্রভেদ নেই, আমাদের এক জাতির সঙ্গে অপর জাতির যে-প্রভেদ আছে।’

১৯২৭ সালে সরাসরি স্বতন্ত্র বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের কথা না বলে এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রশ্ন করেন, ‘ভৌগোলিক সীমা, ভাষা, আবহাওয়া ও আহার-পরিচ্ছদের বিভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রমণ্ডল গড়িয়া উঠিয়াছে।...সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও রাজ্য গঠনের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কি শুধু ভারতবর্ষে বিফল বলিয়া প্রমাণিত হইবে?’

এস. ওয়াজেদ আলী-শেখ ওয়াজেদ আলী-তাঁর ভবিষ্যতের বাঙালি (১৯৪২) গ্রন্থে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন বাংলার ধারণার সবচেয়ে কাছাকাছি কিছু বক্তব্য রাখেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরত্চন্দ্র বসুর অবিভক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাব প্রথম থেকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কলকাতা, বিহার ও নোয়াখালীর দাঙ্গার পরিবেশে সার্বভৌম অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনা হিন্দু ও মুসলমান কেউ-ই স্বীকার করে নেয়নি। ১৯৪৭ সালের আগেই বঙ্গপ্রদেশের হূদয় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। বৃহত্তর বঙ্গের প্রতি বাঙালিদের তেমন দরদ ও টান ছিল না। বঙ্গপ্রদেশের উল্লেখযোগ্য হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও সমাজপতিরা বঙ্গপ্রদেশের বিভক্তির জন্য ব্রিটেনের সেক্রেটারি অব স্টেটের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের জনগণ সমের্ক পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিদের অবজ্ঞা, অবহেলা ও অসম্মানজনক ব্যবহার এ দেশের তরুণদের মনে প্রথমে হতাশা, পরে বিক্ষোভ ও প্রতিরোধের বীজ বপন করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ভৌগোলিক ব্যবধানের জন্য রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব যেমন অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, তেমনি তার বিদ্যমানতা সমের্ক উভয় অংশের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের দুই দশকের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভাব্যতা আলোচিত হতে থাকে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। কালক্রমে বাংলাদেশের তরুণরা তাদের স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের জন্য তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণোদিত করতে সফল হয়।

৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ লাহোরে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ১০ মার্চ ১৯৬৬ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান হুমকি দিয়ে বলেন, ‘ছয় দফার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ চাপাচাপি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া হবে এবং দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিব ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দেওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা অব্যাহত থাকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। ইতিমধ্যে ২৩ মার্চ থেকে দেশের সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হতে শুরু করে। ২৫ মার্চ ভুট্টো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যে ধরনের স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে, তাকে আর প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন বলা চলে না। ওদের দাবি তো স্বায়ত্তশাসনের চেয়েও বেশি, প্রায় সার্বভৌমত্বের কাছাকাছি।’

ইতিমধ্যে পদ্মা-মেঘনা-যমুনাপাড়ের ছেলেরা ছয় দফা নয়, এক দফা ্পোগান দিতে শুরু করেছে। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে দুই পাকিস্তানের কথা বলা হয়েছিল কি না সে সমের্ক বৃথা তর্ক করে সময় নষ্ট করতে তারা চায়নি। তাদের আহ্বানে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’-দেশের মানুষ সোল্লাসে সাড়া দিল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান ছন্নছাড়া মতিভ্রমের কথা ভেবে মার্কিন মুলুকের রাজনীতিশাস্তবিদদের উদ্ভাবিত তত্ত্ব, ব্যর্থ বা অকার্যকর রাষ্ট্রের কথা উঠেছে। দেশের অনেক কলাম লেখক এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ প্রতিনিধি রয়েসয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যর্থ বা অকার্যকর রাষ্ট্র নয়, তবে ভঙ্গুর বটে।’

১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ১৪ কোটি মানুষের আহার যোগাচ্ছে। মৌসুমের মঙ্গার কয়েক সপ্তাহের অনটনের কথা বাদ দিলে দেশে দুর্ভিক্ষ নেই বলতে হবে। ১৯৭৩-৭৪ সালে দারিদ্র্যের প্রথম জরিপ করা হয়। সেই সময় শতকরা ৭০ জন মানুষকে দুবেলা পেট পুরে খেতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হতো। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের সর্বশেষ জরিপে বাংলাদেশের দারিদ্র্যরেখা নেমে এসেছে শতকরা ৪০ ভাগে। এই অবস্থা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অধিকতর উজ্জ্বল। পাকিস্তানের সঙ্গে সমর্ঙ্কছেদ হওয়ার জন্য যারা মাতম করেন তাদের খেয়ালে নেই যে, ১৯৫০-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল মাত্র ৯ শতাংশ। পাকিস্তান আমলের শেষ ২০ বছরের তুলনায় বাংলাদেশে প্রথম ২০ বছরে মাথাপিছু আয় বাড়ে ১৭.৯ শতাংশ অর্থাত্ প্রায় দ্বিগুণ।

২০০১ সালে ইউএনডিপির মানব-উন্নয়নের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১৩৯তম। ২০০৪ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ আর এক ধাপ এগিয়ে গেছে। ১৭৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৩৮-এ। এখন আমাদের দেশ একটা মাঝারি উন্নয়নের দেশ। পাকিস্তানের সূচকসংখ্যা ১৪২-এর ওপরে বাংলাদেশের স্থান।

দ্য ইকোনমিস্ট গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ১১১টি জরিপকৃত দেশের মধ্যে জীবনের গুণমানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থান ৭৭-এ এবং পাকিস্তানের স্থান ৯৩-এ। মাথাপিছু জিডিপি, জন্মকালে জীবনপ্রত্যাশা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা, বিবাহবিচ্ছেদের হার, সমাজজীবন, জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থা, চাকরির নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং লিঙ্গ-সমতার বিষয় পর্যালোচনা করে জীবনের গুণগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের স্থান নির্ণয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তি নয়, ১৯৭২ সালে সম্ভাব্য পারমাণবিক শক্তি অর্জনকারী দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের নাম যদিও ছিল। পারমাণবিক শক্তি অর্জন করার চেয়ে জীবনের গুণগত মান অর্জন করা আমার মতে অধিকতর গুরুত্বের কথা। বড় ভাগ্যে যে বাংলাদেশের জন্ম, সে নিয়ে মাতম করার কিছু নেই।

বাংলাদেশের একটানা ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার অর্থনীতিবিদদের কাছে এক কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার। যেখানে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা মোটেই ভালো নয়, সেখানে এই হারে প্রবৃদ্ধি কেমন করে ঘটে? কালো টাকা, চোরাচালান, মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা ইত্যাদির প্রভাব ওই ৫ শতাংশ শ্রীবৃদ্ধির হয়তো এক উল্লেখযোগ্য কারণ-উপকরণ। আসলে দেশের কৃষক-শ্রমিক যারা এক সময় যুদ্ধ করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছিল তারা তাদের কাজে কোনো গাফিলতি করেনি। কৃষি এমনই পেশা, যেখানে ধর্মঘট সম্ভব নয়। ঠিক সময়ে বীজ বপন, জলসেচ এবং ফসল না তুললে সব বিফলে যায়। শিল্পের ক্ষেত্রে দিনে হরতাল থাকলেও শ্রমিকরা বিনিদ্র পরিশ্রম করে রপ্তানির জন্য তৈরি পোশাকের যোগান ঠিকই দিয়েছে। কৃষক-শ্রমিকদের শ্রমের গুণেই আমাদের শ্রীবৃদ্ধি। তাদের কাছে আমাদের ঋণ বেড়েই চলেছে। ঋণখেলাপি সংস্কৃতি আমাদের এমনই মজ্জাগত যে, আমরা তাদের ঋণ পরিশোধের কথা বড় অল্পই ভাবি, ভাবি না বললেই হয়।

কত ভাগ্যে যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পায়! তার বড় দুর্ভাগ্য, উত্থানের কালে প্রথম ২০ বছরের মধ্যে প্রায় ১৫ বছর দেশটি সামরিক শাসনে রাহুগ্রস্ত ছিল। গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও পুনর্নির্মাণে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে। প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ কাটিয়ে বাংলাদেশ যে গতিময়তা ও প্রাণবানতা অর্জন করেছে, সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের সম্মিলিত শক্তি যত প্রবলই হোক না কেন, তা বিনষ্ট করতে পারবে না।

কত বড় ভাগ্যে যে বাংলাদেশের জন্ম তা আমরা অনেক সময় খেয়াল করতে পারি না। সর্বসাধারণের কল্যাণে বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ আমরা পেয়েছি, তা কি আমরা হেলায় হারাচ্ছি? সেই বাংলাদেশের প্রতি আমাদের আনুগত্য ও অকৃত্রিম বিশ্বাস আমাদের কী সৌভাগ্যের পথে যথার্থ দিকনির্দেশনা দেবে?

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত