বিজ্ঞাপন
default-image

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ, ‘ডাকসু’র সদস্য ও রোকেয়া হলের ছাত্রী ইউনিয়নের দায়িত্বও শেষ, শুরু করেছি শ্রদ্ধেয় সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের কাজ। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় থেকেই এ দেশের নারীসমাজ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের সঙ্গে পা মিলিয়ে মিছিল করেছে, স্লোগানে মুখর করেছে রাজপথ-জনপথ। আমার স্মৃতিতে সেই সব দিন অম্লান আজও। স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে পথ চলতে চলতে মুক্তিযুদ্ধের পর্বে এসে পৌঁছেছিলাম।

‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ তখন শহরে শহরে গড়ে উঠছিল। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ সভানেত্রী সুফিয়া কামালের সঙ্গে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে। চট্টগ্রাম মহিলা পরিষদের সভানেত্রী উমরতুল ফজল, মুশতারী শফী, কুন্দপ্রভাসেন, হান্নানা বেগম এবং অগুনতি নারীর সঙ্গে ১৮, ২১ ও ২২ মার্চ নানা সভা-মিছিল করে আমরা ঢাকায় ফিরেছিলাম ২৩ মার্চ।

সেই সময়টা সবারই ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত যুদ্ধ-প্রস্তুতির, যুদ্ধ মোকাবিলার এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে বাঁচার সংগ্রাম চলছিল। সেই দুঃসহ সময়ে সুফিয়া খালাম্মা এবং অন্য সংগ্রামের সাথি নারীদের, সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার, তাঁদের পাশে থাকতে না পারার বেদনা আজও তীব্রভাবে বাজে। ১৯৭২ সালে আবার আমরা একত্র হই, সংগঠিত হই, স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ গড়ে তুলি সভানেত্রী সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছিলাম অনেক সহযাত্রীকে, পেয়েছিলাম যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় শাণিত সহকর্মীদের।

২৫ মার্চ আমি ছিলাম শ্বশুরবাড়ি, বংশালে। দৈনিক সংবাদ অফিসের কাছে ছিল আমাদের ২৪০ নম্বর বাসা। ২৫ মার্চ রাত ১২টায় গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে আশপাশের বাড়ি থেকে মানুষের চিত্কার শুনে আমরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।

বাড়িতে পাঁচ ননদকে নিয়ে শাশুড়ির ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা। আমার মায়ের বাড়ি ওয়ারীতে, ভাইবোনদের সঙ্গে ননদদের রেখে এলাম। এরই মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা চলছিল। মুজিবনগরে ‘বাংলাদেশ সরকার’ গঠনের প্রস্তুতি চলছিল। আমরা ঢাকা থেকে নানাশ্বশুরের বাড়ি কাপাসিয়ায় যাই। মা রয়ে গেলেন বাড়িতে। ভাইবোনেরাও থাকলেন কয়েকজন। ছোট ভাই আব্দুল কাইয়ুম পার্টির মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে গেল। কাপাসিয়ায় আমাদের সঙ্গে মতিয়া চৌধুরী (বর্তমানে কৃষিমন্ত্রী), বজলুর রহমান, আয়শা খানম, মনিরা খান, রোকেয়া কবীর প্রমুখ থেকেছিলেন কয়েক দিন। পরে পার্টির সিদ্ধান্তে আমরা (আয়শা খানম ও মতিউর রহমানসহ) অনেক ভয়-ভীতির মধ্যে আগরতলায় গেলাম।

তত্কালীন ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ও আমাকে ভারতের নারী আন্দোলন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার এবং তাদের সমর্থন আদায়ের কাজে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভারতের নারী সংগঠনের সহায়তায় আমরা আগরতলা-কলকাতা-দিল্লি-পাঞ্জাব-হরিয়ানায় প্রচার আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। বিশ্ব আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের (ডব্লিউআইডিএফ) নেত্রী ফ্রিডা ব্রাউনের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসের কর্মীদের সহযোগে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ওই দূতাবাসের সামনে অনশনে আমরা অংশ নিই। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, দার্জিলিংয়ে ভারতের নারী সমিতির সঙ্গে সভা করেছিলাম আমি। কলকাতায় আকাশবাণীতে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম।

default-image

দেশের তরুণ মেয়েরা ‘গোবরা ক্যাম্পে’ সংগঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেত্রী সাজেদা চৌধুরীর দায়িত্বে। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তারা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছে। মহিলা পরিষদের অনেক সদস্যও আগরতলা ক্যাম্পে শরণার্থীদের সহায়তা করেছেন। বিভিন্ন ক্যাম্পে শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের সমস্যা শোনা, আশ্বস্ত করা ও উদ্দীপ্ত করার কাজ করতে গিয়ে আমরা বড়ই অসহায় বোধ করেছি। অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে, অসুখ-যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করেও তাদের মুখে যখন হাসি দেখেছি, তখন মুক্ত মাতৃভূমিতে বিজয়ীর বেশে ফিরে যাওয়ার আশায় দীপ্ত হয়েছি।

‘বিশ্ববিবেকের প্রতি’ শিরোনামে একটি বুকলেট ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে তৈরি করে প্রচারকাজে সহায়তা পেয়েছিলাম ভারতের নারী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন ‘ভারতীয় নারী ফেডারেশন’-এর। ওই সংগঠনের তত্কালীন সভানেত্রী অরুণা আসফ আলী, সহসভানেত্রী রেণু চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদিকা বিমলা ফারুকী, কল্পনা যোশী, বাণী দাসগুপ্ত প্রমুখ নেত্রীর সঙ্গে পরিচয় ও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এই যোগসূত্রের ফলে ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ আন্তর্জাতিক নারী সংগঠনের (ডব্লিউ-আইডিএফ) সদস্য হয়েছিল ১৯৭২ সালে।

তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের সঙ্গে কলকাতায় পরিচয় হয়েছিল ১৯৭১-এর জুন মাসে। তাঁদের বাড়িটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক কেন্দ্র। রমেণ মিত্র ও ইলা মিত্র দম্পতি ছিলেন সেই কেন্দ্রের মূল পরিচালক। তাঁদের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের অবস্থানকে কিছুটা দৃশ্যমান করার কাজে নিয়োজিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দেশের অভ্যন্তরে লাখো-কোটি নারী চরম প্রতিকূলতার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রেখেছেন, এর তুলনায় আমাদের কাজ অতি সামান্য বলেই মনে করি।

মুক্ত দেশে ফিরে এলাম ১৯৭২-এর জানুয়ারি মাসে। পথে পথে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জনগণের হাসি-কান্নার সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল আমাদের হাসি-কান্না।

মালেকা বেগম: নারীনেত্রী, খণ্ডকালীন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আজকের অনুভূতি

স্বপ্ন ভেঙে গেলেও চেতনা লুপ্ত হয়নি

মুক্তিযুদ্ধের সময় অফুরন্ত স্বপ্নভরা মন নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য উদ্গ্রীব ছিলাম। বীরকন্যা প্রীতিলতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর হবে স্বাধীন বাংলাদেশের। বাল্যকাল থেকে মুক্ত-উদার পারিবারিক প্রগতিশীল আদর্শের মধ্যে জীবনযাপন করেছি। কমিউনিস্ট আদর্শের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে জীবনে-মননে। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য, আদর্শ, চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম স্বাধীন দেশে অন্ন-বস্ত্র-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাবে সব মানুষ।

স্বপ্ন দেখেছিলাম পাকিস্তানের ‘পারিবারিক আইন, ১৯৬১’ সংশোধিত হবে, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হবে, নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা বন্ধ হবে, সামাজিক-পারিবারিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য থেকে নারীসমাজ মুক্তি পাবে। দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলে নারীর স্বাধীনতা ও সব সম-অধিকার অর্জিত হবে—এই স্বপ্ন দেখেছিলাম।

চল্লিশ বছর পার হয়েছে। স্বাধীনতার পর সংবিধানে যে মূলনীতি ও আদর্শ পেয়েছিলাম, তা বারবার অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপে বদলে গেছে। এখনো নারীকে মুক্তি ও সম-অধিকারের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ চেয়েছিলাম। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ সেই লক্ষ্যে কাজ করেছে, এখনো করছে। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির কারণে গরিষ্ঠসংখক মানুষ খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারীদের উত্ত্যক্তকরণসহ নানা মাত্রায় অপরাধ বাড়ছে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আজও কাজ করার প্রেরণা পাচ্ছি।