বিজ্ঞাপন
default-image

বাঙালি ও বালুচ : অভিন্ন ধারা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বছরখানেক পরেই পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ বালুচিস্তানে এক রক্তক্ষয়ী গণযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো সে গণযুদ্ধেরও মূলকথা ছিল স্বাধিকার। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি গোড়ায় তারা করেনি, কিন্তু সেনাবাহিনীর আগ্রাসী অভিযানের ফলে সে দাবি ক্রমশ সঙ্ষ্ট হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের থাবা থেকে বালুচিদের স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা সেটাই প্রথম নয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন ইংরেজের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে, কালাতের খান নবগঠিত সেই ইসলামি রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ না দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেছিলেন। কিন্তু বালুচিদের স্বাধিকারের সে চেষ্টা নির্মমভাবে দমন করা হয়। পরবর্তী দু দশক প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে টিকে থাকে বালুচিস্তান। ১৯৭৩-এ, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দেড় বছরের মাথায়, মার্চ-এপ্রিল মাসে, সেখানে নতুন করে রক্তাক্ত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে যে নারকীয় বর্বরতায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাঙালিদের স্বাধিকারের আন্দোলন ঠেকাতে চেয়েছিল, ঠিক সেই হিংস্রতা ও নগ্নতায় বালুচিস্তানের মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে আক্রমণ হানা হয়। একাত্তরে সেনা হামলার নেতৃত্বে ছিল দেশের সামরিক সরকার। বালুচিদের বিরুদ্ধে এবারের আন্দোলনে সেনাপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন পাকিস্তানের বেসামরিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। হাজার হাজার বালুচির মৃত্যুর ভেতর দিয়ে সে রক্তাক্ত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে প্রায় এক বছর পর।

অধিকারহীন জাতি হিসেবে বাঙালি ও বালুচিদের মধ্যে একটি অলিখিত মৈত্রী দীর্ঘদিন থেকেই কাজ করেছে। একে অপরের বেদনার ভাগীদার হয়েছে, একে অপরকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর বালুচিস্তান থেকে নির্বাচিত আইন পরিষদ সদস্যরা ঢাকায় সে পরিষদের অধিবেশনে আসতে সম্মত বলে জানিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিনন্দনও জানিয়েছিলেন। সে বছর জুলাই মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের ‘ওয়ান ইউনিট’ ব্যবস্থা ভেঙে বালুচিস্তানকে স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় সেখানে যে আনন্দ-উত্সব হয়, তাতে ঢাকা থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু যোগ দিয়েছিলেন। ’৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে, বালুচিস্তানের বিখ্যাত ন্যাপ নেতা আকবর বুগতি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে ঢাকা সফর করে যান। সে সময় আকবর বুগতি পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে আওয়ামী লীগের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি এ কথাও বলেন, বালুচিস্তানের মানুষ ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হোক, তা-ই চায়।

একাত্তরের যুদ্ধের সময় বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন কোন খাতে বয় তা দেখার জন্য বালুচিরা যে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিখ্যাত বালুচ জাতীয়তাবাদী নেতা শেরবাজ খান মাজারি তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ এ জার্নি টু ডিসইলুশনমেন্ট (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি, ১৯৯৯)-এ তাদের সে আগ্রহ ও উদ্বেগের খানিকটা বিবরণ দিয়েছেন। পাকিস্তান ভেঙে দু টুকরো হোক, মাজারি বা অন্য কোনো বালুচ নেতা তা চাননি, কিন্তু পাঞ্জাবি আধিপত্যের অবসান হোক, তা তারা নিশ্চিতভাবেই চেয়েছেন। কেন্দ্রে যদি আওয়ামী নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি অবিচল থাকেন, তাহলে বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সুফল তারাও ভোগ করবে, বাঙালিদের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি তাদের আগ্রহের সেটা একটি প্রধান কারণ। ঠিক সে কারণেই বালুচ ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান রাজনীতিকরা ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর তার ফলাফল মেনেই সরকার গঠিত হোক-অর্থাত্ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোন-এবং ঢাকায় নির্ধারিত সময়ে নতুন আইন পরিষদের সভা বসুক-তা-ই চেয়েছিলেন। মাজারি, যিনি সে পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনিও সে মতই পোষণ করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কোনোটা না হয়ে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হলো। সেজন্য অবশ্য বাঙালিদের রাজনৈতিক একাগ্রতার চেয়েও জুলফিকার আলী ভুট্টোর কূটচাল ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অযোগ্যতাকে অধিক দোষারোপ করেছেন মাজারি।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেরবাজ খান মাজারি একদম অপরিচিত কোনো ব্যক্তিত্ত্ব নন। বালুচিস্তানের রাজনীতি বরাবরই ট্রাইবাল আনুগত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত। পারিবারিকভাবে শেরবাজ অন্যতম প্রধান বালুচি গোত্র মাজারিদের গোষ্ঠীপতি হওয়ার সুবাদে যুবা বয়স থেকেই বালুচি রাজনীতির কেন্দ্রে থেকেছেন। ১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলকে তিনি সমর্থন করেননি। ১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রচারণায় জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যে মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় শেরবাজ খান তাতে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর জুলফিকার ভুট্টো সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান মনোনীত হলে মাজারিকে ভুট্টোর পিপলস পার্টিতে যোগ দিতে আহ্বান জানানো হয়, কিন্তু তিনি সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে ভুট্টোর নির্দেশে বালুচিস্তানে বিদ্রোহ দমনে যে সামরিক অভিযান শুরু হয়, মাজারি তার প্রধান সমালোচক হয়ে ওঠেন। এ সময় ভুট্টো ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) নিষিদ্ধ করলে মাজারি প্রধানত বামপন্থি রাজনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের প্রধান নির্বাচিত হন। ভুট্টোবিরোধী আন্দোলনে এনডিএফের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তীকালে জিয়াউল হকের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গঠিত বহুদলীয় মুভমেন্ট ফর রেস্টোরেশন অব ডেমোক্রেসি আন্দোলনেও মাজারি নেতৃত্ব দেন। তার সরকারবিরোধী রাজনীতির কারণে তিনি নানাভাবে নিগৃহীত হন, তাকে একাধিকবার কারাগারেও যেতে হয়। ১৯৮৮-তে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতে গভীরভাবে সন্দিহান মাজারি সরাসরি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।

পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বাঙালিদের মতো বালুচিরাও বরাবরই ক্ষমতাচক্রের বাইরে। অর্থনৈতিকভাবেও তারা অনগ্রসর। পূর্ব পাকিস্তানের মতো প্রতিবাদী রাজনীতি বালুচিস্তানেরও ঐতিহ্যিক ধারা। পাকিস্তানি শাসন, বিশেষ করে সামরিক শাসনের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে প্রবল বিরোধী মনোভাব পোষণ করেন, মাজারি সে কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। ১৯৬২-তে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্রে’র খাঁচায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পরপরই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয় কনভেনশন মুসলিম লীগ। সে বছর নভেম্বরে পার্লামেন্ট বসলে দেখা গেল কনভেনশন মুসলিম লীগের সঙ্গে রয়েছেন ৭৮ জন সদস্য, আর বিরোধী পক্ষে ৬০। এই ৬০ জনের ৫৫ জনই পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য। সে কথা স্মরণ করে মাজারি লিখেছেন, এই (হিসাব) থেকেই সঙ্ষ্ট বোঝা যায় তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা কেমন ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত ‘সৈনিক জাতি’র তুলনায় বাঙালিদের মধ্যে চামচাগিরি ছিল অনেক কম (পৃ. ১৬)।

পাকিস্তানের দুই অঙ্গের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই যে বেশি, মাজারি ১৯৬৯ সালে ঢাকায় প্রথমবার বেড়াতে এসে সঙ্ষ্ট টের পান। সেবার তিনি প্রাক্তন বিমানবাহিনী প্রধান আসগর খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। তার নিজের স্বীকারোক্তিতে, ঢাকায় এসে অঞ্চলটির ‘বিদেশী’ চেহারা দেখে তিনি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন। সেটি যে পাকিস্তানের অন্তর্গত একটি প্রদেশ, দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তিনি লিখেছেন :

‘প্রথমেই চোখে পড়ে আরবি হরফের বদলে বাংলা ও ইংরেজি হরফের আধিপত্য। দেশের মানুষের পোশাকও ভিন্ন। পশ্চিমাঞ্চলের পরিচিত সালওয়ার-কামিজ কোথাও চোখে পড়ে না। যে পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা পরিচিত, তারও কোনো ছাপ নেই। এমনকি সে অঞ্চলের ফুল-ফল ও প্রাণী, তাও ট্রপিকাল, আমাদের চেয়ে আলাদা। এই বৈসাদৃশ্যের আদত অর্থ আমি যে বুঝিনি, তা নয়। পূর্ব পাকিস্তান যদি আমার কাছে বিদেশ মনে হয়, পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছেও পশ্চিম পাকিস্তান ভিন্ন লাগার কথা। এই ভিন্নতার সঙ্গে যুক্ত ছিল আরো একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা। পূর্ব পাকিস্তানকে দু দশক ধরে আমরা কার্যত একটি উপনিবেশের মতো শাসন করে এসেছি। আমাদের প্রতি তাদের তিক্ততা তাই অবোধ্য কিছু নয়। এই নদীবিধৌত বদ্বীপটিতে আমরা সঙ্ষ্টতই সমঙ্ূর্ণ বহিরাগত ছিলাম। বালুচিদের অধিকারের নিষেঙ্ষণ আমি সচক্ষে দেখেছি। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের আচরণ ছিল একই রকম। প্রদেশটি সফরের পর অবদমিত বাঙালিদের প্রতি আমার সহানুভূতি বহুলাংশেই বেড়ে যায় (পৃ. ১৬৩)।’

স্বায়ত্তশাসন বা এমনকি স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের যে সংগ্রাম, তার প্রতি মাজারির সমর্থন সঙ্ষ্ট। সেনাবাহিনীর তত্পরতা, ভুট্টোর চক্রান্ত ও ইয়াহিয়া খানের অযোগ্যতার ফলে পাকিস্তান ভেঙে দু টুকরো হচ্ছে, তা দেখে তিনি উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত, কিন্তু বাঙালিদের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তার নিজের কথায় :

‘গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমার দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ বেশি আসন নিয়ে জয়ী হয়েছে, তাদের ওপর কোনো শর্ত আরোপের অধিকার কারোর ছিল না। এমনকি, সমালোচকরা যেমন দাবি করে থাকেন, আওয়ামী লীগ দেশ ভেঙে আলাদা একটা দেশ গড়তে যাচ্ছিল, সে অধিকারও তাদের ছিল। সে চেষ্টাকে ‘সিসেশন’ বলা যায় না, কারণ সিসেশন বা দেশ বিভক্তি হলো যখন দেশের বৃহত্তম অংশ থেকে (ক্ষুদ্র কোনো অংশ) বিচ্ছিন্ন হবার চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙালিরা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। আমার মতে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বারবার অবদমিত করা হয়েছে। এমনকি ১৯৫০-এর দশকেই পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছে (পৃ. ১৯৯)।’

default-image

ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও শেখ মুজিব

মাজারি একাত্তরের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পেছনে প্রধান চরিত্র হিসেবে নির্ধারণ করেছেন তিনজনকে : সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ইয়াহিয়াকে তিনি মদ্যপ এবং লমঙ্ট হিসেবে দেখালেও তাকে সর্বাংশে অথর্ব-এমন একজন সামরিক শাসক হিসেবে পরিচিত করাননি। তার বক্তব্য থেকে এ কথা মনে হয় যে, তিনি ইয়াহিয়ার প্রতি কিঞ্চিত্ সদাশয়। জেনারেল গুল হাসানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, সামরিক অফিসার হিসেবে তিনি দক্ষ ছিলেন। মানুষ হিসেবেও হালকা মেজাজের। কিন্তু তার সর্বনাশ হলো প্রেসিডেন্ট হয়েই। ক্ষমতা দখলের পর তিনি সর্বাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন সেনা অফিসারদের ওপর। হামিদ, পিরজাদা ও ওমর, এই তিন জেনারেল, যাদের সে সময় ‘মাফিয়াচক্র’ বলে ডাকা হতো-তাদের বাইরে পরামর্শের মতো আর কেউ তার ছিল না। ভুট্টোকে ঠেকানোর মতো যোগ্যতা বা বুদ্ধি, কোনোটাই তার নেই। মুজিবকেও হাতের মুঠোয় রাখতে পারেন, এমন সাধ্য তার ছিল না। মাজারির বক্তব্য অনুসারে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। মুজিব তাকে কথা দিয়েছিলেন, ছয় দফা নিয়ে সমঝোতায় তার আপত্তি থাকবে না। কিন্তু নির্বাচনের পর এ প্রশ্নে তার অবস্থান বদলে গেল, তিনি একচুলও হঠতে প্রস্তুত ছিলেন না। মুজিব তাকে ঠকিয়েছেন, এরকম একটি ধারণা তার বদ্ধমূল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া রাজনীতির ওপর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এই পর্যায়ে ইয়াহিয়া যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তার অধিকাংশই ছিল পূর্ণ মদ্যপ ও চামচা পরিবেষ্টিত অবস্থায়। তত্কালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান তার স্মৃতিকথা মেমোয়ার্স-এ সে কথাই বলেছেন। সেনাপ্রধান (চিফ অব আর্মি স্টাফ) হামিদ ও প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পিরজাদার মধ্যে এ সময় সমর্ঙ্ক ছিল আদায়-কাঁচকলায়। মাজারির নিজের ধারণা, ইয়াহিয়া তার সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে এই তুমুল বৈরিতার কারণে দ্বিধাহীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও রাখতেন না।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি মাজারির দৃষ্টিভঙ্গি মিশ্র। বাঙালিদের তিনি অবিসংবাদিত নেতা, তাদের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক তিনি। সে বিষয়ে তিনি সচেতন। কিন্তু পাকিস্তান যে ভেঙে গেল, তার অন্যতম কারণও তিনি। মজার ব্যাপার হলো, মাজারি বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং নিজ গ্রন্থে তার ব্যবহার করেছেন, তাতে এমন একটি ধারণা তিনি দিতে চেয়েছেন যে, পাকিস্তান ভেঙে যাক মুজিব তা কখনো চাননি। তাকে যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব দেওয়া হতো, নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে যা তার প্রাপ্য ছিল, তাহলে হয়তো ঘটনা ভিন্ন খাতে বইত। তার সে ন্যায্য দাবি মেনে নিলে দেশ ভাঙার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। মাজারির ধারণা ইয়াহিয়া নিজে সম্ভবত তার সে দাবি মানতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু ভুট্টো ও তার সমর্থক জেনারেলরা ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে বাগে নিয়ে আসবে। মাজারি স্মরণ করেছেন যে, পরবর্তী সময়ে, অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ইয়াহিয়া নাকি মন্তব্য করেছিলেন, ‘এমনকি একদম শেষ পর্যায়েও ভুট্টোর তুলনায় মুজিব অনেক বেশি দেশপ্রেমিক (‘মহিব-এ-ওয়াতান’) হিসেবে প্রমাণ রাখেন’।

default-image

অনেক বিশ্লেষকই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতিত্ব দিয়েছেন ‘পলিটিক্যাল এজিটেটর’ হিসেবে। মাজারিও মুজিবের ব্যাপারে একই মত পোষণ করেন। ‘রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনায় তার দক্ষতা ছিল, যে দক্ষতাকে সোহরাওয়ার্দী খুবই উপযোগী হিসেবে বিবেচনা করতেন। কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তাবিদ বা কৌশলবিদ বলে তার কোনো পরিচিত ছিল না’ (পৃ. ১৭৮)। অথচ এসব গুণ না থেকেও ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তার ওপরই সকল আস্থা কেন সমর্পণ করেছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা মাজারি দেননি। এই ব্যাপারে দেশী-বিদেশী অনেকেই যে সরলীকরণের আশ্রয় নেয়, মাজারি তা থেকে ভিন্ন নন।

মুজিবের সঙ্গে তার মুখোমুখি সাক্ষাত্ হয় দু বার। মাজারির কথায়, কোনোবারই মুজিবকে দেখে আহামরি কিছু মনে হয়নি তার। ছয় দফা তার নিজের উদ্ভাবিত প্রস্তাবনা নয়, সে কথা দাবি করে মাজারি জানিয়েছেন, এই ছয় দফাকে সম্বল করেই মুজিব বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯-এ আইয়ুব খান তার রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যখন গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন, সে সময় ছয় দফা প্রশ্নে কোনোরকম আপস করতে মুজিব রাজি না হওয়ায় সে বৈঠক শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। মুজিব কেন আপস করলেন না, তার দুটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাজারি, দুটিই-তার স্বীকারোক্তি অনুসারে-অনুমানভিত্তিক। এক. গোলটেবিল বৈঠকের শেষ পর্যায়ে আইয়ুব মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু বাঙালিদের কাছে তার ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে ভেবে তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। দুই. কোনো কোনো পাকিস্তানি জেনারেল তাকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণে সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। আইয়ুবের পতনের পর ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া। মাজারির বক্তব্য অনুসারে ইয়াহিয়া গোড়া থেকেই মুজিবের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তাকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন। তিনি যে ‘এক লোক-এক ভোট’ নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাতে এ কথার সঙ্ষ্ট স্বীকারোক্তি মেলে যে, পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে, ইয়াহিয়া সে কথা মেনে নিয়েছিলেন।

মাজারি অবশ্য স্বীকার করেছেন, মুজিবের আওয়ামী লীগ যে ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করবে, তা সেনাকর্তাদের কেউই বুঝে উঠতে পারেনি। বাঙালিদের বিভক্ত করা যাবে, এ কথা বিশ্বাস করে তারা মুসলিম লীগ ও নূরুল আমিনের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর একটি চেষ্টা চালায়। ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য জেনারেল শের আলী খানকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনের তিন দিন আগে যখন ব্যাপারটা সঙ্ষ্ট হয়ে আসে যে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে, শের আলী খানকে তখন পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। সর্দার শওকাত হায়াত খানের উদ্ধৃতিতে মাজারি একটি স্বল্পপরিচিত তথ্য দিয়েছেন। মুজিব নিজে শওকাত হায়াতকে নাকি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগকে তার দল ২৯ বা ৩০টির মতো আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু সামরিক জান্তার পরামর্শে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। জান্তার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, দেশের পূর্বাঞ্চলে তারা আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে পারবে (পৃ. ২১৯)।

default-image

মাজারির কথায়, ইয়াহিয়া বিশ্বাস করেছিলেন মুজিবকে তিনি বাগে আনতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ পেলে মুজিব ছয় দফা নিয়ে একগুঁয়েমি করবেন না, এ ব্যাপারে তিনি স্থিরনিশ্চিত ছিলেন। মুজিব নিজেই ইয়াহিয়াকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ছয় দফা প্রশ্নে আপস করতে তিনি রাজি, তবে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তিনি যে চাপের মুখে রয়েছেন তা এড়ানোর জন্য এ ব্যাপারে খোলামেলা কোনো সমঝোতা তার পক্ষে সম্ভব নয় (পৃ. ১৭৯)। কিন্তু সে কথা মুজিব রাখেননি। ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভার বাঙালি সদস্য অধাপক জি ডব্লিউ চৌধুরীর উদ্ধৃতি দিয়ে মাজারি জানিয়েছেন, জানুয়ারি ১৯৭১-এ ঢাকায় ইয়াহিয়া-মুজিব ব্যর্থ বৈঠক শেষে ইয়াহিয়া জানান, ছয় দফার ব্যাপারে কোনোরকম ছাড় দিতে রাজি না হয়ে মুজিব তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। অধ্যাপক চৌধুরী তার লাস্ট ডেইজ অব পাকিস্তান গ্রন্থে লিখেছেন, মুজিব ছয় দফা প্রশ্নে নির্বাচনের পর আপস করতে উদ্যোগ নেবেন, শুধু মুখে নয়, ইয়াহিয়া ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আহসানের সঙ্গে বার্তা বিনিময়েও নানা সময়ে একাধিকবার তা বলেছেন। ১২ জানুয়ারি ইয়াহিয়া-মুজিব প্রথম বৈঠকের পর ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে অধ্যাপক চৌধুরী লিখেছেন :

‘সে বৈঠকের পরপরই আমাকে প্রেসিডেন্ট ভবনে ডেকে পাঠানো হয়। আমি গিয়ে দেখি ইয়াহিয়া তিক্ত ও হতাশভাবে বসে আছেন। আমাকে তিনি বললেন, মুজিব আমাকে ডুবিয়েছে। এরপর তিনি আমাকে বিস্তৃতভাবে তার আলোচনার বিবরণ দেন। নির্বাচনের আগে মুজিব তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া তিনি তাকে দেখতে দেবেন। মুজিব জানিয়ে দেন, আইন পরিষদের বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে শুধু তিনিই সে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত। ইয়াহিয়ার একমাত্র কাজ হলো বিলম্ব না করে আইন পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা। সে কাজে ব্যর্থ হলে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি ইয়াহিয়াকে হুমকি দেন। ইয়াহিয়ার জন্য সেটা ছিল এক নিদারুণ আঘাত। মুজিবের কথায় বিশ্বাস করে বড় ধরনের ঝুঁকি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এখন মুজিবের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে না পারায় জেনারেলদের কাছে তার মুখরক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে।’ (দি লাস্ট ডেইজ অব পাকিস্তান, জি ডব্লিউ চৌধুরী, পৃ. ১৪৯-১৫০)

মাজারির নিজের কথায়, ইয়াহিয়ার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল শুধু সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশের সংবিধান সংস্কারের ক্ষমতা প্রদানের সিদ্ধান্ত। তার ঘোষিত লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের ভিত্তিতে গৃহীত সে নীতির ফলে নতুন পার্লামেন্টে তাদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ একাই তাদের পছন্দমতো শাসনতন্ত্র বদলে নেবার ক্ষমতা অর্জন করে। পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী সাফদার মাহমুদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ইয়াহিয়া তাকে খুশি করতে যেভাবে তত্পর ছিলেন, তা দেখে মুজিব নিশ্চিত হন, যেকোনো প্রশ্নেই তাকে ‘না’ বলার ক্ষমতা পাকিস্তানি সামরিক শাসকের নেই।

একটা জিনিস সঙ্ষ্ট। ইয়াহিয়া বা বিভিন্ন পাকিস্তানি লেখক-ভাষ্যকাররা যাকে মুজিবের একগুঁয়েমি ও বিশ্বাসঘাতকতা বলছেন, বাঙালিদের চোখে তা ছিল তাদের অবিংসবাদিত নেতার আপসহীনতা। ইয়াহিয়া খান বা পাক জেনারেলদের সঙ্গে গোপন চুক্তিতে রাজি হলে সে সময় মুজিব যে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব পেতে পারেন, অধ্যাপক চৌধুরীর ভাষ্য থেকেই তা সঙ্ষ্ট হয়ে ওঠে। মুজিবের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া তার ছয় দফার দুটি দফা ছাড়া অন্য সব দফা মানতে রাজি হন বলেও চৌধুরী জানিয়েছেন। দফা দুটি হলো : প্রদেশগুলো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে কেন্দ্রীয় সরকারকে কর প্রদান করবে, এবং প্রদেশসমূহ জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কোনো বৈদেশিক বাণিজ্যচুক্তি করতে পারবে না। কিন্তু মুজিব এমন কোনো শর্ত মানতে রাজি হলেন না। ছয় দফা থেকে এক পা পিছনে হঠতেও তিনি রাজি ছিলেন না।

অধিকাংশ পাকিস্তানি লেখক-ভাষ্যকারই এ কথাটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, মুজিব নিজে হয়তো কোনো রকম আপসে রাজি হলে হতেও পারতেন, কিন্তু তার পক্ষে কোনো রকম সমঝোতায় আসা সম্ভব হয়নি প্রধানত তার দলের বামপন্থি নেতা-কর্মীদের চাপে। মাজারিরও এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ৭ মার্চ রেসকোর্সে তার সেই বিখ্যাত ভাষণ (‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’) দেওয়ার পর থেকে মুজিব কার্যত এই বামপন্থিদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন। নিজের সিদ্ধান্তমতো কাজ করার ক্ষমতা তার আর ছিল না। মুজিব-ইয়াহিয়া ব্যর্থ আলোচনার কথা উল্লেখ করে মাজারি সরদার শওকাত হায়াতের স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে মুজিবের এই জিম্মি অবস্থা বোঝাতে চেয়েছেন। শওকাত হায়াত ও মিঞা মুমতাজ দৌলতানা সে সময় ঢাকায় অবস্থান করছিলেন এবং মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমর্ঙ্ক বজায় রাখছিলেন। ১৯ মার্চ তারা দুজন মুজিবের সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাসভবনে একান্তে সাক্ষাতের জন্যে আসেন। সে কথা স্মরণ করে শওকাত হায়াত লিখেছেন, সাক্ষাতের সময় ঘরে ছিলেন তাজউদ্দীন ও নজরুল ইসলাম। তারা দুজনেই চেষ্টায় ছিলেন যাতে মুজিব একা পাকিস্তানি দুই নেতার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পান। মুজিব তাদের দুজনকে চায়ের ব্যবস্থা করতে বললে দুজন একসঙ্গে সেখান থেকে সরে না গিয়ে একজন ঘরে রয়ে গেলেন। এমনকি যেতে বললেও সে কথায় কর্ণপাত করেননি। সেদিনই সন্ধ্যায় শওকাত হায়াতের সঙ্গে গোপনে দেখা করতে এলেন খন্দকার মুশতাক। শওকাত হায়াত লিখেছেন :

‘মুশতাক জানালেন ৭ মার্চ চাপের মুখে থাকা সত্ত্বেও মুজিব তার রেসকোর্সের ভাষণে কীভাবে সব সামলে নিয়েছেন। তার দলের ১৯ জন নেতাই তার মতের বিরুদ্ধে ভোট দেয়, তার পক্ষে ভোট দেয় মাত্র তিনজন। অশ্রুসিক্ত চোখে মুশতাক জানালেন তখন থেকেই তিনিও মুজিব দলের সবার কাছে সন্দেহভাজন হয়ে উঠেছেন। দলের চরমপন্থিদের হাতে মুজিব কার্যত বন্দি হয়ে আছেন। তিনি আমাকে করজোড়ে অনুরোধ করলেন যাতে জেনারেলকে (ইয়াহিয়া) আমরা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি যে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে অবস্থা মুজিবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’ (দি নেশন দ্যাট লস্ট ইটস সোল, পৃ. ৩১১)

এর আগে ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় মুজিবের সঙ্গে আরেক দফা সাক্ষাতের বিবরণও শওকাত হায়াত তার গ্রন্থে দিয়েছেন। সে সময় মুজিব শাসনতন্ত্র প্রশ্নে আপসের ইঙ্গিত করেছিলেন, বলেছিলেন এ ব্যাপারে একমাত্র ভুট্টো ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতার সঙ্গে তিনি কথা বলতে আগ্রহী। সময়মতো যাতে আইন পরিষদের সভা ডাকা হয় সে কথা ইয়াহিয়াকে বোঝানোর অনুরোধ করে মুজিব তাকে বলেছিলেন, ইয়াহিয়া তার লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার অনুসারে কাজ না করলে নকশাল ও কমুনিস্টপন্থিদের চাপে পড়ে তাকে এককভাবে শাসনতন্ত্র ঘোষণা করতে হতে পারে।

বামপন্থিদের, বিশেষত দলের সাধারণ সমঙ্াদক তাজউদ্দীনকে ‘দোষী’ বানানোর চেষ্টা জেনারেল রাও ফরমান আলীও করেছেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এডমিরাল আহসানের সঙ্গে মুজিবের এক সাক্ষাতের বিবরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন, ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পিছিয়ে দিতে পারে এ কথা জানানোয় তাজউদ্দীন মন্তব্য করেন, তিনি আগে থেকেই জানতেন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতায় আসতে দেবে না। তাজউদ্দীনকে মুজিব সে সময় শান্ত হতে বলেন, ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলতে পরামর্শ দেন। পরে সবাইকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে মুজিব গভর্নর আহসানকে জানান, আইন পরিষদের নতুন তারিখ এখনই ঘোষণা করা না হলে তিনি দলের কট্টরপন্থিদের সামলাতে পারবেন না।

৪ মার্চ মুজিবের সঙ্গে তার আরেকটি সাক্ষাতের বিবরণ দিয়েছেন রাও ফারমান আলী। ঢাকায় সে সাক্ষাতের সময় মুজিবকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, এর পরেও পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব কিনা। মুজিব বলেছিলেন, অবশ্যই সম্ভব। একই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন। তিনি সে প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, যদি আইন পরিষদের দুটি ভিন্ন অধিবেশন হয়-একটি পূর্ব পাকিস্তান, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানে-একমাত্র তাহলেই পাকিস্তান টিকে থাকবে। কিন্তু তার অর্থ দাঁড়াবে দুটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের সৃষ্টি, সে কথা বলায় তাজউদ্দীন জবাব দিয়েছিলেন, আমরা বাঙালিদের এক নম্বর হত্যাকারীর সঙ্গে (অর্থাত্ ভুট্টোর সঙ্গে) একই ছাদের নিচে বসতে পারি না।

মাজারি তার স্মৃতিচারণায় মুজিবের প্রতি যদিও সহানুভূতিশীল, ভুট্টোর প্রশ্নে তিনি সমালোচনায় মুখর, তিক্ত-বিরক্ত। পাকিস্তান ভাঙার পেছনে তিনিই যে প্রধান ভিলেন এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে, মাজারি তার সাড়ে ৬০০ পাতার বইতে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছেন ভুট্টোর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত চরিত্র বিশ্লেষণে। মোটের ওপর ভুট্টোর যে ছবিটি এখানে তিনি এঁকেছেন, তাতে তিনি প্রবলভাবে উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিবাজ ও ধূর্ত একজন মানুষ হিসেবে ধরা পড়েছেন। তাদের দুজনের ব্যক্তিগত পরিচয় দীর্ঘদিনের। ভুট্টোর পিতা শাহনেওয়াজ ভুট্টো করাচি বিমানবন্দরে মাজারির নাম ধরে কেউ ডাকছে শুনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজ পুত্র জুলফিকারের সঙ্গে শেরবাজের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তারা দুজনেই সদস্যযুবা। এই পরিচয় পরে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হলেও বন্ধুত্বে দাঁড়ায়নি কখনো। তবু সেই পরিচয়ের সুবাদেই ভুট্টো শেরবাজ মাজারিকে নিজের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা কম করেননি। কিন্তু এই সিন্ধি রাজনীতিকের প্রতি তার সন্দেহ ও অবিশ্বাস দীর্ঘদিনের। ভুট্টোর আসল লক্ষ্য ক্ষমতা। সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে এমন কোনো পথ নেই যা অনুসরণে তার আপত্তি রয়েছে। অন্য অনেক পাকিস্তানি ভাষ্যকারের মতো মাজারিও মনে করেন, নিম্নবংশীয় হিন্দু মাতার ঘরে জন্ম হওয়ায় ভুট্টো বরাবরই এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। এই মানসিকতা থেকেই ক্ষমতার শীর্ষে যাওয়ার জন্য তার এমন উদগ্র আগ্রহ।

জাতে উঠতে ভুট্টো কতটা উদগ্রীব, তা বোঝানোর জন্য অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন মাজারি। তার সঙ্গে মাত্র পরিচয় হয়েছে, এমন এক সময়ে মাজারিকে তিনি ধরেছিলেন ফিরোজ খান নুনের জামাতার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে। বিদেশী রাষ্ট্রদূতের ভোজসভার প্রধান টেবিলে রাষ্ট্রদূতের পাশে বসার জন্য অনুরোধ-উপরোধে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না। করাচিতে মার্কিন কনসাল-জেনারেলকে প্রায় হাত কচলাতে কচলাতে তিনি জানান, মার্কিনবিরোধী যেসব কথা তিনি মিটিং-মিছিলে বলেন, তা কেবলই রাজনীতি। কন্যা বেনজিরকে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানোর জন্য সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করতেও তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হন না। ‘কিন্তু আপনার মেয়ের পরীক্ষার ফল কেমন?’-সে প্রশ্ন করাতে ভুট্টোর জবাব, ভালো নয়, সেজন্যই তো নিয়মের ব্যতিক্রম যাতে হয় সেজন্য আপনাকে অনুরোধ করছি’ (পৃ. ১৬৫)।

‘হাম ইধার তুম উধার’

ঢাকা ছাড়ার আগে ইয়াহিয়া ‘মুজিব পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ প্রধানমন্ত্রী’, এ কথা ঘোষণা করে গেলেন বটে, কিন্তু তিনি ততক্ষণে বুঝে ফেলেছেন মুজিব ভাঙবেন কিন্তু মচকাবেন না। জানুয়ারিতে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত ভুট্টোর সঙ্গে ইয়াহিয়া কোনো আঁতাত গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখেননি। কিন্তু ১৭ জানুয়ারি ঢাকা থেকে ফিরেই লারকানায় তার তিন প্রধান জেনারেলকে নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বসেন ইয়াহিয়া। ততদিনে সেনাকর্তারা ধরে নিয়েছেন যে, মুজিবকে ঠেকাতে হলে তাদের দরকার ভুট্টোকে। ভুট্টো নিজেও বুঝে ফেলেন ক্ষমতা দখলের যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন তা পূরণ হতে পারে একমাত্র সেনাবাহিনীর ঘাড়ে বন্দুক রেখে। স্বার্থের অভিন্নতার কারণে পাকিস্তানি জেনারেলরা ও জুলফিকার ভুট্টো হাতে হাত মেলালেন। সামরিক হামলার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান তারা করে ফেলবেন, এমন বিশ্বাস জেনারেলদের আগে থেকেই ছিল। এখন ভুট্টো তাদের সঙ্গে হাত মেলানায় ট্রিগার টিপে ধরতে তাদের আর কোনো বাধা থাকল না।

পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক জান্তার নগ্ন আক্রমণ একটি মারাত্মক ভুল ছিল, যে কজন পাকিস্তানি রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী এ কথা প্রকাশ্যে বলেছেন, মাজারি তাদের একজন। আওয়ামী লীগের ছয় দফা যে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবল বিরুদ্ধ মনোভাবের সৃষ্টি করে তা স্বীকার করে মাজারি বলেছেন, সে বিরুদ্ধতা বোধগম্য হলেও পূর্ব পাকিস্তানিরা আসলে কী চায় ও কেন চায় তা বুঝে উঠতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পাঞ্জাবি শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের মনে যে ঘৃণাবোধের জন্ম হয় তা সামরিক অভিযান দিয়ে কখনো হত্যা করা যাবে না, সে কথা উল্লেখ করে মাজারি বলেছেন, সেনা হামলার অর্থই ছিল একটা বড় ধরনের দুর্যোগ নিজ থেকে ডেকে আনা। সে হামলার বদলে রাজনৈতিক সমঝোতার পথে এগোলে পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব হতো।

‘ছয় দফার ভিত্তিতে শক্তিশালী কেন্দ্রের বদলে প্রদেশের হাতে অধিক ক্ষমতা প্রদানের মানেই যে সার্বভৌম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের নিশ্চিত বিভক্তি তা মোটেই ঠিক নয়। কিন্তু যারা রাষ্ট্রের ব্যাপারে অগণতান্ত্রিকভাবে (বিগত ২৩ বছর) তাদের কর্তৃত্ব খাটিয়ে এসেছে, তাদের কাছে এ ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। জিন্নাহর মৃত্যুর পর দেশের সর্বময় ক্ষমতা চলে যায় আমলাতন্ত্র ও সামরিক কর্তাদের এক আঁতাতের নিয়ন্ত্রণে। স্বনিয়োজিত এসব ব্যক্তি দেশের ভূত-ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়ে, দেশের মানুষের কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তা ঠিক করার দায়িত্ব তারা নিজেরাই নিয়ে নেয়। সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের হাতে পাকিস্তানের মানুষ বারবারই ঠকেছে। আমার বিশ্বাস ছিল, (৭০-এর নির্বাচনের পর) সময় এসেছে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো নতুন করে পরীক্ষা করে দেখা এবং দেশের বৃহদাংশ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা যাতে পূরণ হয় তার জন্য সে কাঠামোয় প্রয়োজনমতো সংস্কার করা। আমি এ-ও জানতাম যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হলে তা দেশের জন্য ভয়াবহ দুর্যোগের সূত্রপাত করবে’ (পৃ. ১৯৯)।

মাজারি এ ব্যাপারে সচেতন যে, যদি ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পরবর্তী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়, বিশেষত করব্যবস্থা ও বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে প্রদেশসমূহের অধিকার সংবলিত প্রস্তাব কার্যকর করে, তাহলে পাকিস্তানকে তার বর্তমান চেহারায় টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হবে। ছয় দফার পূর্ণ বাস্তবায়নের মানেই ছিল কেন্দ্রকে দুর্বল করে আনা, প্রদেশকে শক্তিশালী করা। কিন্তু মুজিব তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছিলেন। পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালাতে গেলে মুজিবকে হয় তার ছয় দফা প্রস্তাব সংশোধন করতে হতো, নয়তো অন্য পথ ধরতে হতো। আর মুজিব যদি শুধু পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন, পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না দেখাতেন, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান নিজে থেকেই তার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুজিবের শাসন পছন্দ না হলে পশ্চিম পাকিস্তানও কেটে পড়তে পারত। আর সত্যি সত্যি তেমন অবস্থার উদ্ভব হলে মুজিব যে সামরিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানকে ধরে রাখতে চাইতেন না তা নিশ্চিত। ফলে, মাজারির ভাষ্যে, মুজিব ক্ষমতায় এলে শান্তিপূর্ণভাবেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব হতো।

মাজারির চোখে এই শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে সবচেয়ে প্রধান বাধা ছিলেন ভুট্টো ও তার সহযোগী জেনারেলরা।

১৯৭০-এর নির্বাচনের একটি আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো আওয়ামী লীগ তাতে কেন্দ্রীয় পরিষদের জন্য নির্ধারিত আসনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তারা একটি আসনও পায়নি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮১টি আসন দখল করে প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হলেও পূর্ব পাকিস্তানে তারা একটি সিটও পেলেন না। এই দুই প্রদেশের রাজনৈতিক বিভক্তি এই ফলাফল থেকে খুবই সঙ্ষ্ট। গণতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন মেনে চললে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবেরই অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এবং তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো প্রতিনিধিত্ব না থাকলে সে প্রদেশের স্বার্থরক্ষা হবে না। বৃহত্তম দল হিসেবে ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের ত্রাতা হিসেবে নিজেকে দাবি করে বসলেন। বাহ্যত ভুট্টোর প্রধান আপত্তি ছিল ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ শাসনতন্ত্র প্রণয়নে মুজিবের দৃঢ় সিদ্ধান্ত। ১২০ দিনের মধ্যে সে শাসনতন্ত্র গৃহীত হতে হবে, ইয়াহিয়া তার লিগাল ফ্রেমওয়ার্কে সে শর্ত বেঁধে দিয়েছিলেন। এই সময়সীমার মধ্যে তা সম্ভব না হলে আবার নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভুট্টো নিশ্চিত ছিলেন ১২০ দিনের মধ্যে একাজ সম্ভব হবে না। সে অবস্থায় যদি ফের নির্বাচন ডাকা হয়, তাতে পিপলস পার্টির পক্ষে অতগুলো আসন পুনরায় দখল অসম্ভব হবে। নির্বাচনের আগে ভুট্টো অধ্যাপক চৌধুরীকে বলেছিলেন তার দল ৩০ থেকে ৪০টি আসন লাভ করবে। ৮১-টি আসন তার দল পাবে, সে কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি তিনি। ফের নির্বাচন হলে পশ্চিম পাকিস্তানি দলগুলো একাট্টা হয়ে পিপলস পার্টিকে হারাতে চাইবে। সে অবস্থায় ভুট্টো যে পশ্চিম পাকিস্তানে আবারো প্রধান দল বলে প্রমাণিত হবেন, তার কোনোই নিশ্চয়তা ছিল না।

পাকিস্তান ভেঙে দু টুকরো হোক, ভুট্টো তা চাননি, কিন্তু কেন্দ্রে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে বাধ্য করতে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণেও তার আপত্তি ছিল না, তাতে যদি পাকিস্তান ভেঙে যায় তো যাক। জানুয়ারির শেষাশেষি ঢাকায় মুজিব-ভুট্টো বৈঠক বসল। ছয় দফা নিয়ে দরাদরি তার লক্ষ্য হলেও সেখানে ভুট্টো সরাসরি ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব চাইলেন। এ প্রসঙ্গে মাজারি তার গ্রন্থে জেনারেল গুল হাসানের স্মৃতিচারণ উদ্ধৃত করেছেন :

‘ভুট্টোকে যে মিশন দেওয়া হয়েছিল (অর্থাত্ শাসনতন্ত্র প্রশ্নে অচলাবস্থার অবসান) তা সমালানোর বদলে তিনি (মুজিবকে) তার ব্যক্তিগত ভূমিকার কথা তুললেন, বললেন, সহকারী প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ পেলেই তিনি খুশি থাকবেন। মুজিব সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাান করে জানালেন তার দলে যথেষ্ঠ প্রতিভাধর ব্যক্তি রয়েছেন যারা সে দায়িত্ব পালনে সক্ষম। এরপর ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন। সেখানে তিনি তার সঙ্গে সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হলে ভয়াবহ পরিণতির জন্যে মুজিবকে সাবধান করে দিলেন। কিন্তু সে হুমকির ফলে মুজিব তার দৃষ্টিভঙ্গি আরো কঠোর করে ফেলেন’। (মেমোয়ার্স, লে. জে. গুল হাসান, পৃ. ২৫৮)

মুজিব-ভুট্টো আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার আগেই ভুট্টো তার সেই বিখ্যাত ফর্মুলা ‘ইধার হাম-উধার তুম’ তুলে ধরেন। কথাটার সহজ অর্থ দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব নেবেন মুজিব, আর পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি। ‘ইধার হাম-’ কথাটা ঠিক এভাবেই তিনি বলেছিলেন কিনা তা নিয়ে অবশ্য খানিকটা সন্দেহ রয়েছে। মাজারি জানিয়েছেন, লাহোরের আজাদ পত্রিকার বার্তা সমঙ্াদক আব্বাস আখতার সংবাদ শিরোনাম দিতে গিয়ে ভুট্টোর একটি ভাষণের এই বাখ্যা করেছিলেন। ভুট্টোর জীবনীকার স্টানলি ওয়ালপার্ট তার জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক, ১৯৯৩) গ্রন্থে অবশ্য জানিয়েছেন, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক উর্দু ভাষণে ভুট্টো ঠিক ওই ফর্মুলাই ব্যবহার করেছিলেন (পৃ. ১৪৬)।

ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ৩ মার্চ। সে তারিখে যাতে অধিবেশন না বসতে পারে তার জন্য যা কিছু করার, সবই করেছিলেন ভুট্টো। মাজারি স্মরণ করেছেন যে, ঢাকায় যদি তার দলের কোনো নির্বাচিত সদস্য সে অধিবেশনে যোগ দেয় তাহলে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে দেবেন’ বলে তিনি শাসিয়ে ছিলেন। একই উদ্দেশ্যে তিনি ২০-২১ ফেব্রুয়ারি তার দলের এক সভায় পিপিপির সব সদস্যের কাছ থেকে আগাম পদত্যাগপত্র নিয়ে রাখেন। মাজারিকেও ঢাকায় না যেতে অনুরোধ করেছিলেন ভুট্টো, কিন্তু মাজারি তার সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। ঢাকায় অধিবেশনে যোগ দেওয়া দেশের মঙ্গলের জন্যই প্রয়োজন বলে মাজারি যুক্তি দেখিয়েছিলেন। মাজারির ধারণা, ইয়াহিয়া যে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখেন তার কারণ ভুট্টোর সে দাবির সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর অধিকাংশ জেনারেল।

অধিবেশন শুরুর মাত্র তিন দিন আগে তা স্থগিত রাখায় পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। ঢাকায় ও পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে রাজনৈতিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসার নতুন তারিখ দেন ২৫ মার্চ। কিন্তু সে ঘোষণার একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল কালক্ষেপণ। ২৫ মার্চ আইন পরিষদের অধিবেশন বসবে না, সেদিন থেকে সামরিক অভিযান শুরু হবে, জেনারেলরা তা আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। যে সময়টুকু পাওয়া যাবে তাতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাড়তি সৈন্য এনে সমর প্রস্তুতি বাড়ানো ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। ভুট্টো এই চক্রান্তের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িত ছিলেন বলে মাজারি জানিয়েছেন। মুজিবের সঙ্গে আরেক দফা আলাপ-আলোচনার জন্য ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন ১৫ মার্চ। মাজারি জানাচ্ছেন, আলোচনার এই পর্যায়ে দু পক্ষ অধিকাংশ প্রশ্নে সমঝোতায় প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। গেড়ো বেঁধেছিল আইন পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই সামরিক আইন তুলে নেওয়ার দাবি নিয়ে। ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলরা মুজিবের সে দাবিতে সম্মতি দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ন্যাপ নেতা গাউস বকশ বেজেঞ্জোর উদ্ধৃতি দিয়ে মাজারি জানাচ্ছেন, তাদের অনুরোধের ফলে মুজিব শেষ পর্যন্ত তার সে দাবি পরিত্যাগেও সম্মত হয়েছিলেন। এই তথ্যটির দ্বিতীয় কোনো সূত্র তিনি উল্লেখ করেননি, ফলে তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ অমূলক নয়। মাজারি অবশ্য লিখেছেন, এতবড় একটা সমস্যা মিটিয়ে ফেলা গেলেও সেনা প্রশাসন সত্যি সত্যি কোনো রকম সমঝোতায় আগ্রহী কি না তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না বেজেঞ্জো। ক্ষমতার সাধ পেয়ে অভ্যস্ত জেনারেলরা কেন্দ্রে ক্ষমতা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। অন্যদিকে ভুট্টো কিছুতেই মুজিবের হাতে কেন্দ্রের ক্ষমতা ছাড়তে রাজি ছিলেন না। এ অবস্থায় সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য।

মাজারির দাবি, ২৫ তারিখেও যে আইন পরিষদের অধিবেশন বসবে না, ভুট্টো তা আগেভাগেই জানতেন। ২ মার্চ ভুট্টোর অনুরোধে তার করাচি বাসভবনে আসেন মাজারি। সেখানেই ভুট্টো তাকে ঢাকা না যেতে অনুরোধ করেন ও পিপিপিতে যোগ দিতে পীড়াপীড়ি করেন। উভয় অনুরোধই প্রত্যাখ্যান করেন মাজারি। তাদের আলোচনার একপর্যায়ে জেনারেল ওমর ভুট্টোকে ফোন করেন। ফোন সেরে ভুট্টো সোল্লাসে মাজারিকে জানান, ঢাকায় আইন পরিষদের কোনো অধিবেশনে যাওয়ার কথা তিনি ভুলে যেতে পারেন। সে অধিবেশন কখনোই বসবে না। মাজারির বক্তব্য, পূর্ব পাকিস্তানে যে সেনা অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে, ভুট্টোর এ কথা থেকেই তা সঙ্ষ্ট। এর ২০ দিন পর তিনি যে ঢাকায় আসেন মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে, তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, আর তা হলো যাতে মুজিব ও ইয়াহিয়া কিছুতেই কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারেন।

মাজারি লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে যে তথাকথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয় তার সপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে একমাত্র যে রাজনীতিক বক্তব্য রাখেন তিনি হলেন ভুট্টো। ঢাকা থেকে ফিরে করাচি নেমেই ভুট্টো ঘোষণা করেন, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে’। তিনিই একমাত্র রাজনীতিক যিনি তার নিজের স্বীকারোক্তি অনুসারে সেনাবাহিনীকে দেশের পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহ দমনে ‘হালকা সেনা অভিযান’ চালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। মাজারির কথায় পাকিস্তানের স্বার্থ নয়, একমাত্র নিজের রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করাই ছিল ভুট্টোর উদ্দেশ্য।

শেষ কথা

শেরবাজ খান মাজারি রাজনীতিবিদ, ঐতিহাসিক নন। যে সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস তিনি বর্ণনা করেছেন, মোটের ওপর তার সবটাই কাছ থেকে দেখেছেন তিনি, নিজে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে তার বিবৃতির একটি প্রামাণিক গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে যে ঐতিহাসিক আবশ্যসম্ভাবিকতা ছিল, তা বোঝা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি, কিন্তু বাঙালিদের স্বাধিকার চেতনার প্রেক্ষাপটটি তিনি ঠিক ধরতে পেরেছেন। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংযুক্তি যে একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনা, সমঙ্ূর্ণ বিজাতীয় দুটি মানবগোষ্ঠীকে এক রাখার এক অর্থহীন ও কৃত্রিম প্রচেষ্টা, যে গুটিকয় পাকিস্তানি রাজনীতিক-লেখক তা ধরতে পেরেছেন, তিনি তাদের একজন।

জাতিগতভাবে অভিন্ন একটি মানবগোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেকোনো আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। নিমকণ্ঠে হলেও এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে মাজারি বাঙালি ও বালুচিদের অধিকার আন্দোলনের অভিন্নতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তার গ্রন্থের একটি বৃহত্ অধ্যায়ে তিনি ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে বালুচিস্তানে যে গণবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে তার বিবরণ দিয়েছেন। নিজে সে বিদ্রোহে অস্ত্র হাতে লড়াই করেননি বটে, কিন্তু তার পেছনে যে রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় ছিল, মাজারি তার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সেজন্য তাকে নিগৃহীত হতে হয়েছে, হাজতবাস মেনে নিতে হয়েছে। ইতিহাসের ফুটনোট হিসেবে এ কথা স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৭৭-এ মিঞানওয়ালিতে যে জেলখানায় তাকে রাখা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তার গ্রন্থে সে কথাটি পরিহাসচ্ছলে হলেও জানাতে ভোলেননি মাজারি।

১৯৭১-এর গণযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু বালুচিস্তানের পরিস্থিতি অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র আসে, গণতন্ত্র যায় সেখানকার সেনাবাহিনীর মর্জিমাফিক। সামরিক বুটের নিচে বালুচিস্তানকে সে বাস্তবতা মেনে নিতে হয়েছে। ২০০৩ সালের মাঝামাঝি পাকিস্তানে সেনা তদারকিতে নির্বাচন হওয়ার পর সেখানকার প্রদেশসমূহে বেসামরিক প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয়েছে। কেন্দ্রেও একজন বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় সমাসীন হয়েছেন। এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে সেনা গোয়েন্দা বিভাগের ভূমিকা এখন আর কোনো গোপন ব্যাপার নয়। তারা যা যা চেয়েছে, ফলাফল ঠিক সে মোতাবেকই হয়েছে। ফলে, পাকিস্তানের আসল ক্ষমতা যে সেনাবাহিনীর হাতে ছিল, তার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

১৯৭১-এ বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী মনোযোগ দেয় বালুচিস্তানের মুক্তি আন্দোলন দমন করতে। ১৯৮৩তে সিন্ধুর গ্রামাঞ্চলে বিদ্রোহ দানা বাঁধলে, আবারও একই কাজে নেমে পড়ে পাকবাহিনী। গত এক দশক ধরে করাচিতে মোহাজির কওমি মুভমেন্টকে দমনের নামে যে সমর অভিযান চলছে, অনেকে তাকে ১৯৭২-৭৩-এর বালুচ অভিযানের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

প্যারিস থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় সমঙ্রতি পাকিস্তানে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জি পার্থসারথি মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে তার নিজের দেশের মানুষ যত মারা গেছে, অন্য কোনো সেনাবাহিনীর হাতে তা ঘটেনি। পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হলো এই সেনাবাহিনী। তা সত্ত্বেও তারা যে এখনো বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় টিকে আছে তার প্রধান কারণ হলো আমেরিকার সমর্থন।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৭১-এ আমেরিকার রিপাবলিকান সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনের বদলে ইয়াহিয়ার খুনে বাহিনীকে মদদ দিয়েছিল প্রধানত এই যুক্তিতে-পাকিস্তান বিভক্ত হলে তার ফায়দা পাবে ভারত। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ ভারত আরো বৃহত্তর আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক, যুক্তরাষ্ট্র (বা চীন) তা চায়নি। সে কারণে তারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, যদিও আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ ও তার আইন পরিষদ বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সঙ্ষ্ট সমর্থন জানায়। এখন সে মুক্তিযুদ্ধের ৩২ বছর পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যামেঙ্ বিভক্ত নয়, তারা কৌশলগত আঁতাতে আবদ্ধ। কম্যুনিজমও আর প্রধান হুমকি নয়, প্রধান হুমকি হলো মৌলবাদ। যে কয়েকটি দেশে মৌলবাদ প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন পাচ্ছে, পাকিস্তান তাদের অন্যতম। আফগানিস্তানে তালিবান সরকারকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য যারা করেছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের অন্যতম। সম্ভবত আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন এখনো পাকিস্তানে সেখানকার গোয়েন্দা দপ্তরের নজরে লুকিয়ে আছেন।

মৌলবাদভিত্তিক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকে যদি ঠেকাতে হয় তাহলে তার অন্যতম ভিত্তি পাকিস্তান ও তার সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন আছে। হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় স্টানলি ওয়াইস সমঙ্রতি প্রস্তাব করেছেন, পাকিস্তান ও তার অপরাধী সেনাবাহিনীর সমস্যা মেটানোর একটা পথ হতে পারে দেশটিকে চার ভাগে ভাগ করে ফেলা। পূর্ব পাকিস্তান সে দেশ থেকে বেরিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু শুধু বাঙালি নয়, স্বাধীনতার দাবি সে দেশের বালুচিদের মধ্যে রয়েছে, রয়েছে সিন্ধি ও পাখতুনদের মধ্যে। এরা কেউই পাঞ্জাবিদের আধিপত্য মেনে নেয়নি, কখনো নেবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে এক পাঞ্জাবকে পাকিস্তানের ভেতর রেখে বাকি চারটি প্রদেশকে স্বাধীনতা দিলে আমরা একসঙ্গে চারটি গণতান্ত্রিক দেশ পেতে পারি। পাশাপাশি পাঞ্জাবি-নির্ভর পাকিস্তান ও তার সেনাবাহিনীর তার নিজের দেশের মানুষের ও তার প্রতিবেশীদের ক্ষতি করার ক্ষমতাও কমে আসে।

প্রস্তাবটি অভিনব মনে হলেও তা মোটেই অবাস্তব নয়। পাঞ্জাবের বাইরে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দীর্ঘদিন থেকেই সোচ্চার। বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যেমন এক ধর্মে মিল ছাড়া আর কিছুতে কোনো মিল ছিল না, যার কথা মাজারি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তানের অবশিষ্ট চার প্রদেশের মানুষের একে অপরের মধ্যেও এক ধর্ম ছাড়া কোনো মিল নেই। জাতিগত সম্মিলনের ভিত্তিতে সেখানকার প্রদেশসমূহে গণমুক্তি আন্দোলন মাথাচাড়া দেবে, এখন বা দু-দশ বছর পরে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? সেটাই কি ঐতিহাসিক আবশ্যম্ভাবিকতা নয়?

আর তাই যদি ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ বালুচ, সিন্ধি বা পাঠানদের পাশে এসে দাঁড়াবে, সেটাই স্বাভাবিক।

৬ ডিসেম্বর ২০০৩, নিউইয়র্ক

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত