বিজ্ঞাপন
default-image

পাঁচ বছরের ইমন কেন জানি ‘পতাকা’ শব্দটি ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। সে পতাকাকে বলে পকাতা। ওর অবস্থা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের সেই বিড়ালছানার মতো-

আমি যত বলি চ ছ জ ঝ ঞ-; সে বলে মিঞো মিঞো মিঞো। পকাতা পকাতা পকাতা।

ওই পতাকা-পাগল ছেলেকে নিয়ে বড় মুশকিলে পড়েছি। বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে ও বায়না ধরল, তাকে দুটো পকাতা কিনে দিতে হবে-একটি আর্জেন্টিনা (ওর ভাষায় আটেনটিনা), আর একটি ব্রাজিলের (ওর ভাষায় ফাজিল)। দিলাম কিনে। শুধু কিনে দিয়েই লেটা চুকল না, বাঁশ কিনে আটেনটিনাকে ওড়াতে হলো আকাশে আর ফাজিলকে বাড়ির ছাদে। পাড়ার উন্মাদ ফুটবলভক্তকুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, পতাকাযুদ্ধে জয়ী হয়ে, তবেই শান্ত হলো সে।

বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে আমি ওর একটা বিশেষ গুণের সঙ্গে পরিচিত হয়ে চমকে উঠি। এমনটি আমি আমার জীবনে দেখিনি। যে যে দলের সমর্থক, সে তারই জয় কামনা করে। প্রতিদ্বন্দ্বীর বিনাশই তার কাম্য হয়। কিন্তু ইমন সে রকম নয়। আর্জেন্টিনা গোল করার সময় সে যেমন আনন্দ করে উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠেছে, পকাতা নিয়ে মিছিল করেছে, ঠিক তেমনি ওর প্রিয় দল যখন গোল খেয়েছে, পরাজিত হয়েছে, তখনো দেখেছি তার সমান আনন্দ। সমান উত্তেজনা। তখনো আমি তাকে তার পরাজিত প্রিয় দলের পতাকা নিয়ে আনন্দ-মিছিল করতে দেখেছি। সে গোল দেওয়া আর গোল খাওয়ার মধ্যে পার্থক্য করেনি।

জয় আর পরাজয় তার কাছে যেন সমার্থক। উভয়ের মধ্যেই সে আনন্দকে দেখে। প্রতিটি গোলের মধ্যেই তো সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। আমরা শুধু নিজ দলের দেওয়া গোলটির মধ্যেই সুন্দর আর আনন্দকে দেখি,-ইমন সেরকমভাবে বিষয়টাকে দেখে না। সে নিজ দলের বিরুদ্ধে প্রদত্ত গোলটির মধ্যেও সৌন্দর্য ও পারদর্শিতার সন্ধান পায়।

ইংল্যান্ডের কাছে গোল খেয়ে বিশ্বকাপের আসর থেকে ছিটকে পড়া আর্জেন্টিনার জন্য আমার নিজেরই যখন খুব মন খারাপ, খুব কষ্ট পাচ্ছি মনে, তখন ইমনকে দেখলাম, আর্জেন্টিনার মিনি-পতাকাটি কাঁধে নিয়ে সে তার সমবয়সীদের সঙ্গে নিয়ে পাড়ার ভেতরে আনন্দ মিছিল শুরু করে দিয়েছে।

একজন তো পরাজিত হবেই, তা না হলে আরেকজন জয়ী হবে কীভাবে? সে যেন আমাকে বলতে চাইল, শুধু জয়ের মধ্যেই আনন্দকে খোঁজো না। পরাজয়ের মধ্যেও আনন্দ আছে। বেদনা আনন্দের বিপরীত শব্দ বটে, কিন্তু শব্দের সীমাবদ্ধতার কাছে জীবনের অসীমতাকে লুটিয়ে দিও না। বেদনা ও আনন্দের মাঝখানেও অনেকটা ফাঁকা জায়গা আছে। অন্যের পরাজয়কে কিছুটা হলেও নিজ জীবনের সত্য বলে মানো। তবেই না প্রসারিত হবে তোমার আনন্দজগত্। তোমার ভালোবাসাই যদি সর্বদা জয়ী হবে, তাহলে অন্যের ভালোবাসার কী হবে? ঘুরেফিরে সবাইকেই তো জয়ী হতে হবে। নইলে চলবে কেন? শুধু আমিই জয়ী হব, এই চিন্তাটাই স্বৈরাচারী-আগ্রাসনের চিন্তাকে জাগ্রত করে। হিংসাকে খুঁচিয়ে তোলে। অপরকে দাবিয়ে রাখার হিংস্রতাকে প্রশ্রয় দেয়।

আমার মনে হলো, ইমনের কাছ থেকে আমার কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে। তাই ওই ঘটনার পর থেকে আমি ইমনকে খুব সমীহ করে চলি। নানা বিষয়ে আমি তার পরামর্শ নিই।

এখন ডিসেম্বর মাস চলছে। আসছে বিজয় দিবস। ১৬ ডিসেম্বর। রাস্তায় রাস্তায় ফেরিওলারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিক্রি করছে। ইমন হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে আমাকে সে-খবর জানাল। আমাকে ভয় দেখিয়ে বলল, ‘বাংলাদেশ বিক্রি হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি ট্যাকা দেন।’

ও যখন দোকান থেকে কিছু একটা পছন্দ-হওয়া খেলনা কিনতে চায়, তখন এভাবেই সে আমাকে বোকা বানায়, বিক্রি হয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। সে জানে বিক্রি হয়ে যাবে কথাটা শুনলে আমি খুব ভয় পাই।

বাংলাদেশ বিক্রি হয়ে যাবে মানে? আমি আকাশ থেকে পড়লাম ওর কথা শুনে। মানে জিজ্ঞেস করার আগেই সে আমাকে দুই হাত মেলে দেখাল, আটেনটিনা বা ফাজিলের পকাতার চেয়ে বড় একটা পকাতা পাওয়া গেছে। ফেরিওয়ালা বলেছে, তাড়াতাড়ি টাকা নিয়া না গেলে ওই পকাতা বিক্রি হয়ে যাবে। মানে অন্যে কিনে নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, যাও, দেরি কোরো না। ফেরিওয়ালাকে তাড়াতাড়ি বাসার ভেতরে নিয়ে আসো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরিওয়ালাকে নিয়ে ইমন বাসায় ফিরে এল। ওর হাতে সবুজের ভেতরে টকটকে লাল সূর্যখচিত বাংলাদেশের আনেকগুলো পতাকা। ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের। বিভিন্ন মূল্যের কাপড়ে তৈরি। বিভিন্ন রকমের দাম সেগুলোর।

আমি স্থির করলাম, ইমনের ইচ্ছে অনুযায়ী সবচেয়ে বড় পতাকাটাই কিনব। তা যত দামই হোক। আমার ধারণা ছিল, সবচেয়ে বড় পতাকাটির দাম কম করেও এক শ টাকা তো হবেই। তা হোক।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ফেরিওয়ালা সবচেয়ে বড় পতাকাটির দাম চাইল মাত্র ৬০ টাকা।

আমি খুব অবাক হলাম। মাত্র ৬০ টাকা?

আমার মনে পড়ে গেল এই পতাকার জন্মস্মৃতি। এই পতাকার জন্য কী চড়া মূল্যই না দিতে হয়েছে আমাদের! কত রক্ত, কত প্রাণ!

আমারই অজ্ঞাতসারে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল দুটো শব্দ-‘এত কম?’

ফেরিওয়ালা আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না-ভাবল, আমি বুঝি বিদ্রূপ করছি। তাই বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, ৫০ টাকা দেন।’

আমি বললাম, ‘না না, তুমি ৬০ টাকাই নাও।’ বলে আমি ওকে টাকাটা দিতে চাইলাম।

কিন্তু ফেরিওয়ালা কিছুতেই পঞ্চাশের বেশি নেবে না।

বলল, ‘স্যার, আপনে কি রাগ করলেন?’

মাথা নাড়িয়ে আমি বললাম, ‘না না, রাগ করব কেন? তুমি তো বেশি দাম চাওনি ভাই।’

সত্যিকারের সরল মানুষের সান্নিধ্যে এলে, আমার মনটা এমনিতেই নরম হয়ে যায়।

তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যুক্ত হলে তো চোখে একটু পানি এসে যেতেই পারে।

তাই দেখে ফেরিওয়ালা বলল, ‘স্যার, আপনের চোখে পানি কেন?’

আমি ফেরিওয়ালাকে আমার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম।

বললাম, ‘ওটা পানি নয় রে, ওটাই আনন্দ।’

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত