বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৪৭ সালে মাঝখানে এক হাজার মাইলেরও বেশি অংশজুড়ে ভারতের বিরাটাকার ভূখণ্ড থাকার পরও কেবল ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, যা পশ্চিম ও পূর্ব দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিকতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেওয়ার পরপরই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্য চরম রূপ ধারণ করে। এর আগে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ করে বসেন খোদ রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। স্বাধীনতা লাভের পাঁচ বছরের মাথায় বাঙালিরা বুঝতে শুরু করে, পাকিস্তান নামের এই রাষ্ট্রে তারা কতখানি অপাঙেক্তয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের একটি উপনিবেশ ছাড়া আর কিছুই মনে করে না, সেটি বুঝতে বাঙালিদের আর কিছুমাত্র বাকি ছিল না।

১০ বছর ধরে পাকিস্তানে সামরিক শাসন চালান লৌহমানব আইয়ুব খান। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে পড়ে পশ্চিমের উন্নয়নের রসদদাত্রী। পূর্ব পাকিস্তানের পাটের টাকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠতে থাকল একের পর এক অবকাঠামো। শিল্পায়ন হতে থাকল পশ্চিমের। অথচ পূর্ব পড়ে রইল সেই তিমিরেই। এমনই একটি প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে বাঙালিরা হয়ে উঠল অশান্ত, নিজেদের অধিকার আদায়ে তাদের সামনে নিরন্তর সংগ্রাম ছাড়া যে আর অন্য কোনো উপায় নেই, সেটিও তারা খুব ভালোমতোই বুঝতে পারল।

১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, তাতে এক রাতেই মৃত্যুবরণ করে কয়েক লাখ মানুষ। অথচ, শাসনযন্ত্র যাদের হাতে ছিল, সেই পশ্চিম পাকিস্তানিরাই নিজেদের দেশের একটি অংশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি ছিল চরমভাবে নিস্পৃহ। পশ্চিমাদের এহেন অবহেলা এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনে অবহেলার শিকার হয়ে বাঙালিরা একই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যে গণরায় দেয়, তাতেই লুকিয়ে ছিল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিচ্ছেদের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা। সেই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় প্রমাণ করেছিল, পুরো বাঙালি জাতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনে থেকেও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে কতটা উদ্গ্রীব। নির্বাচনে বাঙালিদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের মূল ইশতেহার ছিল পাকিস্তানের পূর্বাংশে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় পশ্চিমা সামরিকতন্ত্রের মাথা খারাপ করে দেয়। তারা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে ছলচাতুরী ও বিভিন্ন ক্রিয়া-কৌশলের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে দমন করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক কর্মকর্তাদের সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের কয়েক লাখ লোককে শেষ করে দিলে, বাকিরা এমনিতেই ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ ইয়াহিয়ার এই মন্তব্যের এক মাস পর, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহর ঢাকার ঘুমন্ত, নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চরম পৈশাচিক কায়দায় শুরু করে মানবজাতির ইতিহাসের কলঙ্কময় এক গণহত্যা।

গণহত্যার লক্ষ্য

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত সেই গণহত্যার লক্ষ্য ছিল কারা? মূলত পাঁচ ধরনের মানুষকে গণহত্যার মূল লক্ষ্য বানিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তাঁরা হলেন: ক) সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক ও কর্মকর্তা, আধা সামরিক বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) বাঙালি সৈনিক, আনসার বাহিনী ও পুলিশের বাঙালি চাকুরেরা খ) হিন্দুধর্মাবলম্বী বাঙালিরা গ) ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী ও বাঙালিদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা ঘ) স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিশোর ও তরুণেরা, যারা বাঙালি জাতির ভবিষ্যত্ শিক্ষিত প্রজন্ম এবং সর্বোপরি ঙ) বাঙালি জাতির শিক্ষিত ও নেতৃত্বস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা মননে ও চিন্তায় বাঙালি জাতির পথপ্রদর্শক ও বিবেক হিসেবে সুপরিচিত। পাকিস্তানিরা জানত, এই পাঁচ শ্রেণীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলেই আগামী কয়েকটি প্রজন্মের জন্য বাঙালিকে পঙ্গু করে দেওয়া সম্ভব। (সূত্র: অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের দ্য রেপ অব বাংলাদেশ )।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে পাঁচ শ্রেণীর মানুষকে লক্ষ্য করে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছিল, সেই পাঁচ শ্রেণীকে লিঙ্গ ও সামাজিক শ্রেণীভিত্তিক গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের হত্যা করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নারী-পুরুষ ও শিশুভিত্তিক বিন্যাসের কোনো ধার ধারেনি। সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে ছিলেন বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্য, শিক্ষক, করপোরেট হাউসের ছোট-বড় কর্মচারী ও কর্মকর্তা। তরুণ, যুবক ও ছাত্র দেখলেই হত্যার পেছনে একটি উদ্দেশ্য বিদ্যমান ছিল। পাকিস্তানিরা জানত, অতীতে সামরিক স্বৈরশাসকবিরোধী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিল বাঙালি ছাত্র-যুবকেরা। সে কারণেই দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার প্রথম প্রহরেই পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী নরখাদকের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক ছাত্রাবাসগুলোতে।

তরুণ ও যুবকদের লক্ষ্য বানানোর পেছনে আরও একটি বড় উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। ১৯৭১ সালের পুরো সময়জুড়েই বাঙালির প্রতিরোধের যুদ্ধে যোগ দিচ্ছিল যুবকেরা। সে কারণে, সেনাবাহিনী বেশির ভাগ সময়ই রাস্তায় শক্ত-পোক্ত শারীরিক কাঠামোর কোনো তরুণ দেখলেই ‘মুক্তিবাহিনী’ সন্দেহে তাকে আটক করত। ভাগ্য ভালো হলে সে রেহাই পেত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চরম আক্রোশের শিকার হয়ে নিহত হতে হতো সেই তরুণটিকে।

নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ

যেকোনো যুদ্ধেই নারীরা অপরাধের শিকার হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। সুসান ব্রাউনমিলারের লেখা এগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, ওমেন অ্যান্ড রেপ-এ বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে যে অপরাধ সংঘটন করেছে, তার সঙ্গে কেবল তুলনা চলে নানজিংয়ে জাপানি সেনাদের ধর্ষণকাণ্ড ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়াতে জার্মান নািস বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ধর্ষণের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে দুই থেকে তিন লাখ নারী পাকিস্তানি সেনাদের যৌন জিঘাংসার নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। ক্ষেত্রবিশেষে এই ধর্ষিতাদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

এই গণহত্যার জন্য কে দায়ী

রবার্ট পাইন তাঁর ম্যাসাকার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, এই হত্যাকাণ্ডগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা তরুণ সেনাসদস্যদের রক্ত গরম করা ব্যাপার-স্যাপার ছিল না। এটি ছিল একেবারে পিরামিডের চূড়া থেকে পরিকল্পিত ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কেতাদুরস্ত কর্মকর্তারা, যাঁরা ১৯৭১ সালের নয় মাস কোনো না কোনো সময় বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই সেই গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রত্যেকেই জানতেন, তাঁরা আসলে কী করছেন। অশিক্ষিত সৈনিক, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত জেসিও ও এনসিওদেরও ওই অফিসাররাই ব্রিফ করতেন যে তাঁরা এখানে যা কিছু করবেন (হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ), তা সবই দেশের জন্য ও পবিত্র ইসলাম ধর্মের জন্য।

কোনো সন্দেহ নেই, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করা আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম নৃশংসতম গণহত্যা। এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পক ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাঁচজন জেনারেল—প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, পীরজাদা, উমর খান ও আকবর খান। পাইনের ম্যাসাকার গ্রন্থের পৃষ্ঠা ১০২-তে উল্লেখ আছে, পাকিস্তানি সেনাজান্তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রও এই গণহত্যায় লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। সে কারণে মার্কিন কংগ্রেস পাকিস্তানকে প্রতিশ্রুত প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের বিপুল পরিমাণ সমর-সরঞ্জামের চালান স্থগিত করেছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই বাঙালি নিধন উত্সারিত, চরম বাঙালি-বিদ্বেষ থেকে। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে যেকোনো বৈঠকেই বাঙালিদের উল্লেখ করতেন ‘ইঁদুর’ ও ‘মুরগি’ হিসেবে। একজন শিক্ষিত ও এলিট জেনারেলের মুখে এ ধরনের জাতি-বিদ্বেষমূলক মন্তব্য থেকে জুনিয়ররা স্বভাবতই বাঙালি মারার উদ্দীপনা খুঁজে নিত।

সংক্ষেপিত

ভাষান্তর: নাইর ইকবাল

সূত্র: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা বিষয়ে গবেষক অ্যাডাম জোনসের গবেষণাপত্র, জেন্ডারসাইড ওয়াচ-১৯৯৯-২০০০ / ওয়েব: http://www.gendercide.org/case_ bangladesh.html

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ইতিহাসের অন্যতম নৃশংসতম অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। গবেষকেরা সেই গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কৃত অপরাধকে বিংশ শতকের অন্যতম জঘন্য ঘটনা হিসেবে ধরে নিয়ে চালিয়েছেন বিস্তর গবেষণা। ইতিহাসবিদেরা লিখেছেন এই ঘটনার পেছনের ইতিহাস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তার পোষ্য সেনাবাহিনী যে কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, গত ৪০ বছর ধরেই তার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইহুদি হত্যাযজ্ঞ, আর্মেনীয় গণহত্যা ও ১৯৩৭ সালে নানজিং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা চলে আসছে। এর সঙ্গে তুলনীয় ১৯৯৪ সালে আফ্রিকার রুয়ান্ডায় হুতু ও তুতসি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধের জের ধরে চালানো গণহত্যাও।

১৯৯৯-২০০০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন গণহত্যার ওপর পরিচালিত জেন্ডারসাইড ওয়াচের গবেষণায় গবেষক অ্যাডাম জোনস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো হত্যাযজ্ঞের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। তিনি বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন, ১৯৭১ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেটি ছিল ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত ও চরম জাতিগত বিদ্বেষ দ্বারা পরিচালিত। বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবিও ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বৈষম্য ও ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে যে ‘পোড়ামাটি নীতি’ অবলম্বন করেছিল, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হিটলারি নািস বাহিনীর ইহুদি নিধনের চেয়ে কোনো অংশে কম ঘৃণ্য ও নৃশংস ছিল না।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত