ইতিহাস অংশত স্মৃতি, অংশত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের ঐতিহাসিক স্মৃতিকাহিনী পেয়েছে নানা মোচড়, নানা বাঁক, সেসবের অনেকটাই এ সম্পর্কে যে, কীভাবে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল, কারা ছিলেন এর প্রধান নেতৃত্বে। যাঁরা এ সম্পর্কে কিছু বলেন, তাঁদের ভাষা থেকেই বেরিয়ে আসে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান। যেমন, এটিকে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ বললে স্বাধীনতার জন্য জনগণের নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিভাত হয়। বা ১৬ ডিসেম্বর ‘বিজয়ের’ প্রতীক, নাকি ‘আত্মসমর্পণের’ সেটা নির্ভর করবে ১৯৭১ সালে কে কোন অবস্থানে ছিল তার ওপর। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের স্মৃতি নানাভাবে প্রভাবিত করেছে অনেক রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পন্থা ও পদক্ষেপকে।
তারপর রয়েছে জনগণের ইতিহাস: সেই যুদ্ধে সংঘটিত নানা অপরাধ সম্পর্কে জনগণের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি। তাদের বিবরণীতে রয়েছে রকেট লঞ্চার, অপহরণ, নির্যাতনকেন্দ্র, নারী ধর্ষণ, ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজনের গৃহত্যাগ ইত্যাদির স্মৃতি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রতিরোধের ইতিহাসের সূচনা ঘটে কালো পতাকা উত্তোলন আর সংগ্রাম পরিষদগুলো গঠনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সশস্ত্র প্রতিরোধ অনিবার্যভাবে এগিয়ে যায় একটি সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী গঠনের দিকে, যে কাজে সক্রিয় সমর্থন জোগায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের মানুষ, গঠন করা হয় অনেক ফিল্ড হসপিটাল; যেগুলো পরিচালনা করতেন নারীরা।
খুব সম্প্রতি অতীতকে অস্বীকার করার প্রয়াস শুরু হয়েছে, দাবি করা হচ্ছে ১৯৭১ সালে কিছু ঘটেনি। ‘পাকিস্তান ও ইসলাম’ রক্ষার নামে মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো অস্বীকার করার এই প্রয়াস ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক স্মৃতিবিভ্রমের লক্ষণ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে চাকরি করেছেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা মন্তব্য করেছেন, ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে তা ছিল ‘গৃহযুদ্ধ’। তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশের সংবিধানের আইনি ভিত্তিকেই নাকচ করে দেওয়া হয়, যেখানে ১০ এপ্রিলের ঘোষণা ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। সাংসদ, সরকারি কর্মকর্তা বা সাধারণ নাগরিকেরা যদি এই সংবিধান মেনে চলার শপথ নেন, তবে তার অর্থ এই যে তাঁরা এই সত্যগুলো স্বীকার করেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ভিত্তি বৈধতা লাভ করেছিল ১০ এপ্রিলের ঘোষণা ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
সাংস্কৃতিক পার্থক্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতার একাধিপত্য—এই সব বাস্তবিক কারণে পাকিস্তানের দুই অংশের বিভক্তি সম্ভবত ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য ছিল। পাকিস্তানের প্রশাসনে গভর্নর আহসানের মতো কেউ কেউ ছিলেন, যাঁরা স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যা নিরসনের ব্যাপারে তত্কালীন পাকিস্তানের সামরিক সরকারের অনীহার পরিণতিতে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা ঘটে।
৩৬ বছর পর আজ আমরা যখন সেই যুদ্ধের নৃশংসতার কথা স্মরণ করি, তখন কতগুলো স্মৃতি কোনোভাবেই মুছে ফেলা যায় না। যেমন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদকে জেনারেল ইয়াহিয়া স্বৈরাচারী ও একতরফা সিদ্ধান্তে বাতিল করে দিলে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সারা ঢাকা শহর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনা মোতায়েনের ফলে ব্যাপক গণ-অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়, যা কিনা অচিরেই যুদ্ধে রূপ নেয়। পাকিস্তান সামরিক সরকারের সামরিক কৌশলের বিপরীতে সশস্ত্র পাল্টা আঘাত ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। পাকিস্তানি বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে রাজারবাগে পুলিশ সদর দপ্তর, পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স (ইপিআর) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিরোধ-ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে। একই সঙ্গে সংবাদপত্রগুলোর দপ্তর, বস্তি ও বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক ও পেশাজীবীদের ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার করার লক্ষ্য ছিল জনসাধারণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা। এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল একটা ‘শক থেরাপি’ হিসেবে। বিরূপ বা শত্রু মনোভাবাপন্ন জনগণকে দমন করার লক্ষ্যে এই ধরনের কৌশল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগেও নেওয়া হয়েছে: নািসরা এটা করেছে তাদের অধিকৃত ইউরোপে, জাপানিরা করেছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও চীনে। বাংলাদেশে এটা করা হয়েছিল ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা’ ও ‘ইসলাম রক্ষা’র নামে।
ইয়াহিয়া তাঁর সেনাবাহিনীকে ‘পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ পরিপূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করা’র নির্দেশ দিলে সেই নির্দেশ পালনের জন্য এক নিরীহ, নিরস্ত্র জাতির ওপর শুরু করা হয় বর্বর সহিংসতা। মানবতার বিরুদ্ধে সেসব অপরাধের বিপুল পরিমাণ সাক্ষ্য-প্রমাণ শুধু যে সেই সময়ের সংবাদমাধ্যমেই রয়েছে তা নয়, পাকিস্তানি কমান্ডারদের স্মৃতিচারণাগুলোতেও রয়েছে এবং সেগুলোর সত্যতার সমর্থন মিলেছে হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে। সেই প্রতিবেদনে সেসব অপরাধ তদন্ত করার সুপারিশ ছিল, কিন্তু সে সুপারিশ কখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। তবে সহিংসতার ঘটনাগুলো সম্পর্কে সামরিক কর্মকর্তাদের অনেক সাক্ষ্য সেখানে রয়েছে।
কোনো অঞ্চল দখল করা এবং একটা জনগোষ্ঠীর ওপর দীর্ঘ সময় ধরে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ওই অঞ্চলে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বসবাসরত কিছু মানুষের সমর্থনের প্রয়োজন হয়। এর জন্য দখলদার শক্তিকে নির্ভর করতে হয় এমন কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ওপর, যারা দখলদারদের সহযোগিতা করতে আগ্রহী থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নািস বাহিনী পোল্যান্ড ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেওয়ার পর তারা সেখানে কিছু স্থানীয় সমর্থকগোষ্ঠী পেয়ে যায়, যারা তাদের তথ্যদাতা ও স্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করেছিল। এর ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে যেসব প্রতিরোধের শক্তি ছিল, সেগুলোকে দমন করায় নািসদের সুবিধা হয়েছিল।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিল এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে যেসব রক্ষণশীল সমাজপতি নিবেদিতপ্রাণে কাজ করেছিলেন, ১৯৪৭ সালের পর থেকে তাঁরা পাকিস্তানে সামরিক শাসনের সমর্থকদের সামনের সারিতে ছিলেন। অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি সেসব ব্যক্তির কোনো ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল না। আসলে ইসলামি আদর্শকে তুলে ধরতে গিয়ে তারা এত চরম অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন যে, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীকগুলোই মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন, একটা জাতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। গোলাম আযম, নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী এবং অন্যরা সে সময়ের সামরিক স্বৈরাচারের পক্ষে নিজেদের সমর্থন কখনো গোপন করেননি; তাঁরা জেনারেল টিক্কা খান ও নিয়াজির সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সংবাদমাধ্যমেও বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁদের সমর্থনকে সামরিক প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে, এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ; মুসলিম লীগ ও জামায়াতের মতো ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ দলগুলো পাকিস্তানের সংহতি ধরে রেখেছে। এসব রাজনৈতিক দল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। সামরিক ও বেসামরিক কিছু কর্মকর্তাও স্বাধীনতার অনিশ্চিত পথে পা না বাড়িয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে গেছেন।
পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসকদের পক্ষে সমর্থনের আরেকটি পর্যায় ছিল গ্রামে গ্রামে গঠিত শান্তি কমিটিগুলো, যেগুলোর সদস্যরা ছিলেন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী লোকজন। শান্তি কমিটিগুলোতে ছিলেন জামায়াত ও মুসলিম লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক, বয়স্ক গ্রামবাসীদের কেউ কেউ এবং কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ। তাঁরা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের চলাফেরা সম্পর্কে পাক-বাহিনীকে তথ্য দিতেন এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা বেড়ে যেতে থাকলে পাকিস্তান সরকারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার একটা বেসামরিক চেহারা তুলে ধরার। জাতীয় পরিষদ তো ইতিমধ্যে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁদের প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে আগস্ট মাসে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সত্তরের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যেসব ব্যক্তি পরাজিত হয়েছিলেন, তাঁরা ক্ষমতা ও প্রভাব অর্জনের এই সুযোগ গ্রহণ করেন। ড. মালিকের নেতৃত্বে গঠিত বেসামরিক সরকারের পাশাপাশি এসব লোক পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি বেসামরিক ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে কাজ করেন।
পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের পক্ষে তৃতীয় সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে তোলা হয় আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে। তাদেরকে নিয়োগ করা হয় সরাসরি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাধানে কাজ করার লক্ষ্যে। জামায়াত নেতাদের নিয়ে গঠিত এই সহযোগী বাহিনীগুলো পাক বাহিনীর নির্দেশে হত্যা ও অপহরণের মতো অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল, তারা বাঙালি নারীদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসত। আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর কিছু সদস্য ছিল সাধারণ গ্রামবাসী, যারা মাসিক ভাতার বিনিময়ে এসব বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা এসব বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল ‘ইসলাম রক্ষা’র নামে এক আদর্শিক মিশন নিয়ে। তাদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বেঁচে গিয়েছেন এমন লোকজনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা একটা তালিকা রয়েছে, যাতে তাদের অপরাধগুলোর বিবরণ রয়েছে। পাক বাহিনীর নির্দেশে তারা হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধে লিপ্ত ছিল, অনেকে পুরোনো শত্রুতার বশেও এসব অপরাধ করেছে। ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ রয়েছে। বিবিসি টেলিভিশনে প্রদর্শিত ওয়ারক্রাইম ফাইলস নামের একটি অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রে অপহরণ ও হত্যার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য রয়েছে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছে পেশ করা হয়েছিল এবং সেগুলো নব্বই দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানোর কথা ছিল। সেই দলিল এখন পাওয়া গেলে যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ মিলবে।
যুদ্ধকালে ধর্ষণকে একটা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৯৩ সালে। সাবেক যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডায় এই অপরাধের বিচার ও শাস্তি হয়েছে। বাংলাদেশের যুদ্ধের ঘটনাটি আরও আগের। এমনিতেই লজ্জা-সঙ্কোচ ও মানসম্মানের ভয়ে ধর্ষণের শিকার নারীরা নীরব থাকেন, উপরন্তু জনগণের স্মৃতি থেকে এই বিষয়টি পুরোপুরি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে সম্প্রতি। এমনও সন্দেহজনক গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল একটা ‘ভদ্রলোকের বাহিনী’, একাত্তর সালে ধর্ষণের কোনো ঘটনা যদি ঘটেও থাকে তবে তা ঘটেছে দুর্ঘটনাক্রমে, এটা দখলদার বাহিনীর কোনো নীতি ছিল না। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার যারা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের কাহিনী বলেছেন তাঁরা সত্য কথা বলেননি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে সংঘটিত ধর্ষণের অভিযোগ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের মুক্ত করার যে চেষ্টা শর্মিলা বসু তাঁর সর্বসাম্প্রতিক গবেষণায় করেছেন, তা গবেষক-পণ্ডিতমহলে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, বিশেষ করে সেসব গবেষকের কাছে, যাঁরা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে ধর্ষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। শর্মিলা বসুর গবেষণা-পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ এবং তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো সঠিক নয়। ধর্ষণের শিকার বাঙালি নারীদের দেওয়া সাক্ষ্যগুলো নাকচ করার জন্য তিনি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করেছেন পাকিস্তানি জেনারেলদের সাক্ষাত্কারের ওপর, যার মোটেই কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে পারে না। তিনি দাবি করেছেন, তিনি ‘ব্যাপক’ গবেষণা করেছেন কিন্তু ধর্ষণের কোনো তথ্যপ্রমাণ পাননি। যেকোনো সংবেদনশীল মানুষ এটা বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করেন যে, বাংলাদেশের ধর্ষিত নারীরা চিত্কার করে তাঁদের কথাগুলো বলবেন না। শর্মিলা বসু ‘ব্যাপক’ গবেষণা করেছেন, কিন্তু যুদ্ধের পর ধর্ষিত নারীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলোর দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের একজনেরও সাক্ষাত্কার নেওয়ার সময় পাননি। উপরন্তু তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মতো নারীদের দেওয়া সাক্ষ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, যে নারী সাহস করে মুখ খুলেছিলেন এবং অভিযুক্ত জেনারেলের দেওয়া সাক্ষ্যের বিপরীতে নিজের সাক্ষ্য হাজির করেছেন।
একাত্তর সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অপরাধগুলো সারা বিশ্বের জানা। এর স্বীকৃতি মিলবে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান গবেষক ও সমসাময়িক কালের সংবাদপত্রগুলো থেকে। খোদ পাকিস্তানেই প্রথম সারির মানবাধিকার সংগঠন ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধগুলো স্বীকার করেছে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বৈঠকে ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে। পাকিস্তানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য সে দেশের প্রথম সারির কিছু রাজনৈতিক নেতা, কবি ও অন্যান্য পেশাজীবীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এমনকি আজকের দিনেও যখন কোনো জবরদস্তিমূলক আচরণ করা হয়, তখন পাকিস্তানের জনগণ বলে ‘আরেকটা বাংলাদেশ তৈরি কোরো না।’
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ইতিহাসকে অস্বীকার করার চেষ্টা? ১৯৭১ সালের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো কি জনগণের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা সম্ভব? প্রতিহিংসা বা সেই ধরনের কিছুর বশে নয়, একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়মোচনের জন্য অপরাধ প্রতিবিধানের কি প্রয়োজন নেই? দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজ জাতিগত সহিংসতার নিষ্পত্তির একটা উপায় হিসেবে ট্রুথ কমিশন গঠন করেছিল, কিন্তু সেটা হয়েছিল এই জন্য যে, অপরাধীরা নিজেদের অপরাধ ও দোষ স্বীকার করতে রাজি হয়েছিল। ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর দায়ে নািস নেতাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে। টোকিও ট্রাইব্যুনালেও বিচার করা হয়েছে নেতৃস্থানীয় জেনারেলদের। রোম স্ট্যাটিউটের অধীনে যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডায় গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন দণ্ড ভোগ করছেন।
নিরস্ত্র বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনসহ মানবাধিকারসংক্রান্ত অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। তর্কের খাতিরেও যদি বলা হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তাহলেও কি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের পরিচালিত গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণসহ সব অপরাধ জায়েজ হতে পারে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতগুলো দশক পেরিয়ে গেছে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নািসদের বা জাপানে ‘কমফোর্ট উইমেন’দের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিচারের দাবি স্তিমিত হয়নি। বাংলাদেশে মাত্র ৩৬ বছর অতিবাহিত হয়েছে, এরই মধ্যে ইতিহাসকে মুছে ফেলার ও বিকৃত করার অপচেষ্টা চলছে। শান্তি ও ন্যায়বিচারের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য জনগণের কণ্ঠকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করা প্রয়োজন, একাত্তরের নৃশংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য-প্রমাণগুলো সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শুভময় হক।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত