২৯ আগস্ট, রোববার ১৯৭১
আজ হাফিজ ঢাকায় এসেছে তার গ্রামের বাড়ি থেকে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি হাফিজ গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল মাকে নিয়ে। ঢাকার বাসায় শুধু ওর বড় ভাই ওয়াহিদ ছিল। তা সেও তো এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চিংকুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেল।
বিকেলে হাফিজ এ বাসায় এল রুমীর কাছে, এ কয়েক মাসের সব ঘটনা শুনবে বলে। কিন্তু কোথায় রুমী? সে সকালে নাশতা খেয়ে জিম রিভসে রেকর্ডখানা হাতে করে বেরিয়েছে, বলে গেছে—দুপুরে ওদের মিটিং আছে, তারপর ও যাবে চুল্লুর বাসায়।
হাফিজকে বললাম, ‘কি জানি কোথায় গেছে। ওকি কিছু বলে আমাকে? কী যে করে বেড়ায়, আল্লাই জানে। সব গোল্লায় গেছে।’ হাফিজ কাঁচুমাচু মুখে বলার চেষ্টা করল, যা খুশি যা-তা করে বেড়ানোর মতো ছেলে রুমী নয়।
রুমী এল সন্ধ্যারও পরে। হাফিজকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরে ছাদের ঘরে চলে গেল নিরিবিলি কথা বলার জন্য।
রাত নয়টায় খেতে ডাকলাম। নেমে রুমী বলল, ‘আম্মা, হাফিজ রাতে থাকবে এখানে। আমাদের গল্প শেষ হয়নি।’
রুমী-জামীর ঘরের একপাশে একটা ক্যাম্পখাট পেতে হাফিজের জন্য বিছানা পাতল রুমী-জামী মিলে। তারপর রুমী বলল, ‘আম্মা, মাথাটা কেন জানি খুব দপ্দপ্ করছে। ভালো করে বিলি করে দাও তো।’
আমি রুমীর মাথার কাছে বসে ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। জামী, হাফিজ নিজের নিজের বিছানায় শুয়ে খুব নিচুস্বরে কথা বলতে লাগল। মাসুম পাশের ঘরে শোয়—সে উঠে এসে জামীর খাটে বসল। দুই ঘরের মাঝের দরজাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিল। কথার শব্দ যেন বাবার কানে না যায়।
সাইড টেবিলে রেডিওটাও খোলা রয়েছে। একের পর এক বাংলা গান হচ্ছে। খুব সম্ভব কলকাতা। হঠাত্ কানে এল খুদিরামের ফাঁসির সেই বিখ্যাত গানের কয়েকটা লাইন।
‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
ওমা হাসি হাসি পরব ফাঁসি
দেখবে জগত্বাসী।’
রুমী বলল, ‘কি আশ্চর্য আম্মা! আজকেই দুপুরে এই গানটা শুনেছি। রেডিওতেই, কোন স্টেশন থেকে—জানি না। আবার এখনো—রেডিওতে। একই দিনে দুবার গানটা শুনলাম, না জানি কপালে কী আছে।’
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাত্ নিচে গেটে ধমাধম শব্দ আর লোকের গলা শুনে চমকে জেগে উঠলাম। বাড়ির সামনের পুবদিকের জানালার কাছে উঁকি দিয়ে দেখি—সর্বনাশ! সামনের রাস্তায় মিলিটারি পুলিশ। রাস্তার উজ্জ্বল বাতিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দৌড়ে রুমীদের ঘরে গিয়ে দেখি, ওরা চারজনই পাথরের মূর্তির মতো ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ঘরের পশ্চিমের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলাম পেছনে বজলুর রহমান, সাত্তার ও কাসেম সাহেবদের বাড়িগুলোর সামনের রাস্তাতেও অনেক মিলিটারি পুলিশ। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখলাম ডা. এ কে খান ও হেশাম সাহেবের বাড়ির সামনের জায়গায়ও পুলিশ। উত্তর দিকের জানালা দিয়ে দেখলাম, আমার পুরো বাগান ভরে মিলিটারি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে! অর্থাত্ বাড়িটা একবারে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে।
আবার রুমীদের ঘরে গেলাম। রুমী দু-একবার অস্থিরভাবে পায়চারি করে বলল, ‘কোনো দিক দিয়েই পালানোর ফাঁক নেই। মনে হয় হাজার খানেক পুলিশ এসেছে। রাস্তার বাতিগুলোও এমন জোরালো, একেবারে দিনের মতো করে রেখেছে।’
আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরের চারদিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম, ‘কোনোখান দিয়ে কোনোভাবে রুমীকে পার করে দেওয়া যায় কি না! না, কোনো দিক দিয়েই কোনো ফাঁক নেই। পুরো বাড়িটার যত জানালা, সব কয়টাতে গ্রিল; পুরো বারান্দা কঠিন গ্রিলে আবদ্ধ। সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে পেছনের উঠানে নামবে, তারও উপায় নেই। পেছনের বাউন্ডারি ওয়াল খুব নিচু। পেছনের রাস্তার বাতি আর অসংখ্য পুলিশের চোখ এড়িয়ে উঠান দিয়েও পালানো সম্ভব নয়।
ওদিকে সামনের গেটে অসহিষ্ণু হাতের ধমাধম বাড়ি আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠের হাঁকডাক ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমি আর শরীফ পরস্পরের দিকে তাকালাম। এই মুহূর্তে আমার মনের ভেতরে কোনো অনুভূতি আমি টের পাচ্ছি না। ভয়-ভীতি-উদ্বেগ সব ফ্রিজ হয়ে আমি যেন পুতুলনাচের পুতুল হয়ে গেছি। কেউ দড়ি দিয়ে যেন আমাকে ঘোরাচ্ছে, ফেরাচ্ছে, চালাচ্ছে। শরীফের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘চলো, সামনের বারান্দায় বেরিয়ে জিজ্ঞেস করি, কী চায়।’
দুজনে পুব দিকের ছোট বারান্দায় বেরোলাম। শরীফ বলল, ‘কে ডাকেন? কী চান?’
নিচে থেকে কর্কশ গলায় উর্দুতে কেউ বলল, ‘নিচে এসে দরজা খুলুন। এত দেরি করছেন কেন?’
শরীফ আবার বলল, ‘ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। এত রাতে কী দরকার?’
এবার অন্য একজন একটু মোলায়েমভাবে উর্দুতে বলল, ‘বিশেষ কিছু নয়। দরজা খুলুন।’
আমি আর শরীফ দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলাম। দেয়ালে ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলাম ১২টা বেজে ১০ মিনিট।
সদর দরজা খুললেই পোর্চ। রাতে সামনে-পেছনে কলাপসিবল গেট টেনে নিলে ওটা গ্যারেজ হয়ে যায়। শরীফ দরজা খুলে কলাপসিবল গেটের ভেতর থেকে লাগানো তালা খুলে গেট ফাঁক করল। একজন খুব অল্পবয়সী আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে ও পেছনে তাগড়া চেহারার অনেকেই। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘হোয়াট ক্যান উই ডু ফর ইউ?’
অফিসারটি হাত তুলে সালাম দেওয়ার ভঙ্গি করে ইংরেজিতে বলল, ‘আমার নাম ক্যাপ্টেন কাইয়ুম, তোমাদের বাড়িটা একটু সার্চ করব।’
আমি বললাম, ‘কেন, কি জন্য?’
‘এমন কিছু না। এই রুটিন সার্চ আর কি। তোমাদের বাড়িতে মানুষ কয়জন? কে কে থাকে?
আমি বললাম, ‘আমি, আমার স্বামী, শ্বশুর, দুই ছেলে, ভাস্তে—’
‘ছেলেদের নাম কি?’
‘রুমী, জামী—’
ওরা এগিয়ে এল। আমি একটু পাশ কেটে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘দ্যাখো, আমার শ্বশুর বুড়ো, অন্ধ, হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী। তোমাদের প্রতি অনুরোধ, তোমরা শব্দ না করে বাড়ি সার্চ করো। উনি যেন জেগে না যান।’
ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে দেখলে মনে হয় কলেজের ছাত্র। ফর্সা, পাতলা গড়ন, খুব মৃদুস্বরে ধীরে কথা বলে। তার সঙ্গের সুবেদারটি দোহারা, মধ্যবয়সী। উর্দু উচ্চারণ শুনে বোঝা যায় বিহারি।
ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সঙ্গে ওই সুবেদার আর তিন-চারজন সশস্ত্র এমপি ঘরের ভেতরে ঢুকল। এবং মুহূর্তে কয়েকজন একতলায়, কয়েকজন দোতলায় ছড়িয়ে পড়ল। অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে ওরা প্রতিটি ঘরের আলমারি, দেরাজ চেক করে দেখল, পেছনের দরজা খুলে উঠানে উঁকি মারল, বাবার ঘরে পা টিপে টিপে হাঁটল, রুমীদের সবাইকে নাম জিজ্ঞেস করে নিচে নেমে যেতে বলল। আমি প্রায় সব সময়ই ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন, ওদের নিচে যেতে বলছ কেন?’
ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলল, ‘কিছু না, একটুখানি রুটিন ইন্টারোগেশন করব।’ শরীফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনিও নিচে আসুন।’ ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও নিচে নেমে এসে দেখলাম রুমী, জামী, মাসুম আর হাফিজ পোর্চে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম পোর্চে এসে শরীফকে বলল, ‘এটা আপনার গাড়ি? চালাতে পারেন?’ শরীফ ঘাড় নাড়লে সে বলল, ‘আপনি গাড়ি চালিয়ে আমাদের সঙ্গে আসুন।’
আমি ভয় পেয়ে বলে উঠলাম, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
ক্যাপ্টেন কাইয়ুম শান্ত মৃদুস্বরে বলল, ‘এই তো একটু রমনা থানায়। রুটিন ইন্টারোগেশন। আধঘণ্টা পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে ওরা ফিরে আসবে।’
ক্যাপ্টেনের ইঙ্গিতে কয়েকজন পুলিশ গাড়ির পেছনে উঠে বসল। আমি ব্যাকুল হয়ে বলে উঠলাম, ‘আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে।’
শরীফ এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘তুমি থাকো, বাবা একলা।’
তবু আমি বলতে লাগলাম, ‘না, না, আমি যাব।’
বিহারি সুবেদারটি ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, ‘মাইজি, আপুনি থাকেন। এনারা এক ঘোন্টার মধ্যে ওয়াপস আসে যাবেন।’ শরীফ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বোধ হয় নীরবে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। আমি হঠাত্ যেন সম্বিত্ পেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। তাকিয়ে দেখলাম কয়েকজন পুলিশ রুমী, জামী, মাসুমদের হাঁটিয়ে রওনা হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম শরীফের পাশের সিটে উঠে বসল। শরীফ গাড়ি ব্যাক করে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি খানিকক্ষণ স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম সেই শূন্য পোর্চে। তারপর বাড়ির ভেতরে ঢুকে সব ঘরের সবগুলো বাতি একে একে জ্বালিয়ে দিতে লাগলাম। সদর দরজা হাট করে খোলা রইল, আমি দোতলায় উঠে গেলাম। বাবার ঘরে ঢুকে দেখলাম, তিনি অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। যে বাতিগুলো অফ ছিল, সেগুলো সব জ্বেলে দিলাম। তারপর ছাদে গেলাম। ছাদের ঘরের ও বাইরের বাতি দুটোও জ্বেলে দিলাম। তারপর আবার একতলায় নেমে পোর্চে গিয়ে দাঁড়ালাম। একবার গলির মাঝখানে দাঁড়াই, আবার পোর্চে ফিরে আসি, মাঝেমধ্যে বারান্দায় বসি। আধঘণ্টা গেল, এক ঘণ্টা গেল, দেড় ঘণ্টা গেল। ওরা ফিরে আসে না।
আমি ঘর-বার করতে লাগলাম। আমাদের গলির বিহারি নাইটগার্ডটা মাঝেমধ্যে এসে আমাকে বলতে লাগল, ‘মাইজি, আপনি আন্দরে যান।’ আমি তার কথায় কান দিলাম না। সদর দরজা খোলা রেখে আবার দোতলায় গেলাম, ছাদে গেলাম, আবার নিচে নেমে এলাম। এবার নাইটগার্ড বলল, ‘মাইজি, আপনি দরবাজা খুলা রেখে আন্দরে যাবেন না। দরবাজা বন্দো করিয়ে দেন।’ আমি এবারও তার কথায় কান দিলাম না। গলি দিয়ে হেঁটে মেইন রোডের মুখ পর্যন্ত গেলাম, আবার ফিরে এলাম। নাইটগার্ডটা এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘মাইজি, আপনি নিন্দ যাবেন না?’
নিন্দ? ওকি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছে? ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার চোখে ঘুম কি নামবে?
সূত্র: একাত্তরের দিনগুলি, ১৯৮৬
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত