বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মকাণ্ডের বড় লক্ষ্য দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের বাস্তবতা ও সত্য মেলে ধরা। এ লক্ষ্যে ২০০৪ সাল থেকে জাদুঘর এক বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ঢাকা মহানগরের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিতভাবে নিয়ে আসা হয় জাদুঘর পরিদর্শনে অথবা খুদে জাদুঘর হিসেবে সজ্জিত জাদুঘরের যে বাস পৌঁছে যায় দূর-দূরান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সেখানে সবাই প্রত্যক্ষ করে প্রদর্শনী, পরিচিত হয় দেশের ইতিহাসের গৌরবময় পর্বের সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীদের এই পরিদর্শন তাদের মধ্যে যে উত্সাহ ও প্রেরণা সঞ্চার করে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করার যে তাগিদ তাদের মধ্যে লক্ষ্যগোচর হয়, সেই নবীন শক্তির সদ্ব্যবহার ঘটানোর লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গ্রহণ করেছে বিশেষ প্রয়াস।

ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন অথবা দূরপ্রান্তের নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উপস্থাপনায় যেসব নবীন-নবীনা সম্পৃক্ত হয়, তাদের প্রতি জাদুঘরের পক্ষ থেকে জানানো হয় বিশেষ আহ্বান। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এমনই আবেদনসংবলিত লিফলেট, জাদুঘরের স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে যোগ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক শিক্ষকও তাদের কাছে পৌঁছে দেন সেই আবেদন। ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়, তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একঝলক উপস্থাপনা দেখে বুকের মধ্যে যে প্রেরণা অনুভব করে, সেটা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্যও প্রেরণাদায়ক। এই প্রেরণার শক্তিতে শিক্ষার্থীরা একটি বড় কর্তব্য পালন করতে পারে। তাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক অনেক পরে। মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ তাদের নেই, কিন্তু তাদের পরিবারে অথবা পাড়া-প্রতিবেশী নিকটজনের মধ্যে এমন মানুষ অনেক রয়েছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। বলা হয়, এই মানুষজন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন, তোমার দাদি-নানিও হতে পারেন অথবা সে সময় তোমাদের বয়সী কোনো বালক-বালিকাও হতে পারেন, তিনি যে-ই হোন না কেন, একাত্তরের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করা প্রত্যেক মানুষের অভিজ্ঞতার রয়েছে বিশেষ মূল্য।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করে তেমন একজন কাছের মানুষকে বেছে নিয়ে তাঁর একাত্তরের অভিজ্ঞতা শোনার জন্য। তাঁদের বলা হয় এই অভিজ্ঞতার বিবরণ লিখে ফেলতে। আবেদনপত্রে বলা হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা যেন তাদের হাতের লেখা, বানান বা ব্যাকরণগত অসংগতি নিয়ে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভোগে। সেসব ঠিক করে দেওয়ার জন্য নেটওয়ার্ক শিক্ষকেরা রয়েছেন, জাদুঘরের কর্মীরা আছেন, শিক্ষার্থীরা মূলত মনোযোগ দেবে অভিজ্ঞতার বয়ান সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করার দিকে। এই প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্য সংগ্রহের পর নেটওয়ার্ক শিক্ষকের মাধ্যমে তারা তা প্রেরণ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। ভাষ্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা লিখে পাঠায় তাদের নাম, শ্রেণী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম, সেই সঙ্গে যাঁর ভাষ্য নেওয়া হলো তাঁর নাম, বয়স ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্য সংগ্রহের প্রকল্পটি যথাসম্ভব সহজসাধ্য কাজ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করে। সেই সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতিও জানিয়ে রাখে, প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্য পাওয়ার পর প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগত ধন্যবাদপত্র দেওয়া হবে। যারা ভাষ্য সংগ্রহ করে পাঠাবে, তাদের নাম, শ্রেণী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম, সাক্ষাত্কারদাতার নাম ও বয়সের উল্লেখসংবলিত ত্রৈমাসিক তালিকা প্রকাশ করে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। এতে ওই শিক্ষার্থী তার নাম যেমন ছাপার হরফে দেখতে পাবে, তেমনি তার কাজের এক ধরনের স্বীকৃতিও লাভ করবে। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে যে ছাত্রছাত্রীদের পাঠানো প্রতিটি লেখা বা ভাষ্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আর্কাইভসে সংরক্ষিত হবে এবং কোনো ছাত্র যদি ১০ বছর পর এসেও তার পাঠানো লেখা দেখতে চায়, তবে জাদুঘরের ভান্ডারে তা দেখতে পাবে।

ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্য সংগ্রহের এই কর্মকাণ্ড দ্বারা সম্ভব হচ্ছে বহুমাত্রিক অর্জন। প্রথমত, উল্লেখ করা যায় এর শিক্ষণীয় দিকগুলো। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের একটি শিক্ষণপ্রক্রিয়া ঘটছে, তারা স্বাধীনভাবে সাক্ষাত্কার গ্রহণ করে তা লিপিবদ্ধ করছে। কাজটি তাদের জন্য সৃজনমূলকও বটে। কেননা, এখানে পূর্ববর্তী কোনো সাক্ষাত্কার অনুকরণ বা কোনো মুখস্থবিদ্যা প্রয়োগের অবকাশ নেই। প্রতিটি সাক্ষাত্কারই অনন্য। এতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই উপলব্ধি কিছুটা হলেও সঞ্চারিত হয় যে ইতিহাস কেবল বইয়ে লেখা উপাদান নয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, যেখান থেকে কেউ চাইলে ইতিহাসের উপাদান আহরণ করতে পারেন। এই সাক্ষাত্কারের ঘটনার আরেক বৈশিষ্ট্য হলো, পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের এক নবীন সদস্য অভিজ্ঞতা জানতে চাইছে আরও পূর্ববর্তী প্রজন্মের প্রবীণ সদস্য বা সদস্যার কাছে। অনেক ক্ষেত্রে সেই মানুষটির একাত্তরের অভিজ্ঞতা হয়তো এই প্রথম কেউ জানতে চাইল এমন বিশিষ্টভাবে। ফলে এসব অভিজ্ঞতার বয়ানে একটি আন্তরিক ঘরোয়া ভঙ্গির প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়, যা কোনো আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত্কার গ্রহণে পাওয়া সম্ভব নয়। এমন আরও নানা উপাদান এসব সাক্ষাত্কারে বিম্বিত হয়েছে। যেহেতু ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পৌঁছে যায় বাংলার প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মসূচির আওতায় আসে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান, ফলে বড়ভাবে এখানে মেলে প্রান্তিকজন বা আধুনিক ইতিহাসের পরিভাষায় সাব-অলটার্ন শ্রেণীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এখানে অবশ্য স্মরণ রাখা দরকার, এসব প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্য সরাসরিভাবে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়তো প্রশ্নসাপেক্ষ হবে, কিন্তু ইতিহাসের গভীরে প্রবেশের জন্য এসব ভাষ্য সৃষ্টি করছে বিশাল সুযোগ। প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্য সংগ্রহের এই প্রক্রিয়া রয়েছে চলমান এবং এরই মধ্যে ১৬ হাজারের বেশি লেখা জমা হয়েছে জাদুঘরের আর্কাইভসে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যেমন ইতিহাস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আজকের প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের কাছে, তেমনি তারাও আবার ইতিহাসের উপাদান আহরণ করে জমা দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। দেওয়া-নেওয়া ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে এভাবে বিকশিত হচ্ছে উভয়ের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের শক্তি।

মফিদুল হক: পরিচালক, শিক্ষার্থী প্রকল্প, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর