What we call the beginning is often the end
And to make an end is to make a beginning.
The end is where we start from...
—T. S. Eliot
চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ নাট্যপরিচালক সাদেক নবী ও তাঁর স্ত্রী মাসুদা নবীর কাছে আমি হয়ে উঠেছিলাম পরিবারেরই একজন। এ বাড়িতেই বেলাল ভাইকে প্রথম দেখি। সাদা ধপধপে পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি পরনে। মাসুদা নবী (মিনু) ছিলেন বেগম মুশতারী শফী প্রতিষ্ঠিত বান্ধবী সংঘের সক্রিয় সদস্য। বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন বান্ধবী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। এনায়েত বাজারে ‘মুশতারী লজ’ ছিল আমার জন্য অবারিত দ্বার। মুশতারী শফী হয়ে ওঠেন আমার ডলি খালা। গৃহকর্তা চট্টগ্রামের বিশিষ্ট দন্তচিকিত্সক এম শফী উদারমনা এক মানুষ। স্নেহবর্ষণে তিনিও ছিলেন কুণ্ঠাহীন। বেলাল ভাইকে মুশতারী লজেই পেয়ে গেলাম। ২৬ মার্চের পর সেখানে তখন আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ, যাঁরা আমারও পরিচিত। রেডিও সেটে আকাশবাণী কলকাতা ধরা পড়ল। ঘোষণা শোনা গেল, ‘পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।’ সেই সঙ্গে গান, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আমাদের সবার চোখ অশ্রুসিক্ত।
বেলাল ভাইয়ের খোঁজে এনায়েত বাজারে এলেন আবুল কাসেম সন্দ্বীপ। দুজনেই সন্দ্বীপের মানুষ। সেই সুবাদে ঘনিষ্ঠতা। সন্দ্বীপ তখন ফটিকছড়ি কলেজের সহ-অধ্যক্ষ। মনে মনে ভাবছি, রেডিওকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়। স্বাধীনতার এই সংগ্রাম সশস্ত্র হবেই। অস্ত্র পাব কোথায়? এসব ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। বেলাল ভাই বেতার চালু করার বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছিলেন বেগম মুশতারী শফীর সঙ্গে। বেলাল ভাই, সন্দ্বীপ আর আমি—তিনজনই বেরিয়ে যাই বেলা ১১টার দিকে। স্টেশন রোডের কাছে আওয়ামী লীগের দপ্তর। সেখানে তিনি ঢুকলেন নেতাদের কাউকে পান কি না। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু অনেকক্ষণ তাঁর আর কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করে আবার ফিরে গেলাম এনায়েত বাজারে। বাইরে তখন তুমুল অস্থিরতা। নানা জায়গায় জনতার ব্যারিকেড। বিচ্ছিন্ন গোলাগুলির আওয়াজ।
এমন এক পরিবেশে বেলাল ভাইকে ছেড়ে এসেছি আমরা, ডলি খালা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। সন্দ্বীপ আর আমি আবার বেরিয়ে পড়লাম বেলাল মোহাম্মদের খোঁজে। আগ্রাবাদে বেতারকেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমে তাঁর দেখা পেয়ে গেলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে রেডিও চালু করার সংকল্পটা এখানে আরও দৃঢ় হলো। বেলাল ভাই সেখান থেকেই কথা বলেছিলেন আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে। তিনিই জানান যে তাঁর ও বেতার প্রকৌশলী আবদুস সোবহান, দেলওয়ার হোসেন ও মোসলেম খানের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান ট্রান্সমিটার চালু করান। এবং নিজের নাম-পরিচয় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন সেদিন ২৬ মার্চ দুপুরে। আগ্রাবাদ বেতার থেকে বেলাল মোহাম্মদ কথা বলেন সিনিয়র সহ-আঞ্চলিক পরিচালক সৈয়দ আবদুল কাহ্হারের সঙ্গে। তিনিই এই অমূল্য উপদেশটি দেন যে আমরা যেন ব্রডকাস্টিং হাউস থেকে প্রচার না করি। বরং কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন থেকে প্রচার করাটাই নিরাপদ হবে। কেননা যেকোনো সময়ে আগ্রাবাদ এলাকা পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে যেতে পারে।
আওয়ামী লীগের এক সক্রিয় কর্মী চিকিত্সক আনোয়ার আলির গাড়িতে করে আমরা রওনা হয়ে যাই কালুরঘাট ট্রান্সমিটার স্টেশনের দিকে। তিনি বেলাল ভাইয়ের হাতে তুলে দেন সাইক্লোস্টাইল করা একটি প্রচারপত্র, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাসংবলিত। গাড়িতে বেলাল ভাই, সন্দ্বীপ, আমি, চট্টগ্রাম বেতারের ঘোষিকা হোসনে আরা ও আনোয়ার আলি। পথে গাড়িতে উঠেছিলেন স্থানীয় প্রবীণ কবি আবদুস সালাম। হাতে নিজের লেখা একটি ভাষণ। আমরা পৌঁছে গেলাম ট্রান্সমিটার ভবনে। বড় রকমের কোনো প্রস্তুতির সুযোগ ছিল না। আবুল কাসেম সন্দ্বীপ একটা বুলেটিন তৈরি করে ফেলল দ্রুত। ততক্ষণে সেখানে এসে গেছেন চট্টগ্রাম বেতারের দুই অনুষ্ঠান ঘোষক ফজল হোসেন আর সুলতানুল আলম। ফজল হোসেনের কণ্ঠ চট্টগ্রামে অত্যন্ত সুপরিচিত। তিনি ঘোষণা করলে তাঁর পরিবারের জন্য বিপদ হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ একই নাম-ঘোষণা সুলতানুল আলমের কণ্ঠেও প্রচারিত হয়। ডাক্তার আনোয়ার আলির কাছ থেকে পাওয়া ঘোষণাপত্রটিও প্রচারিত হয়েছিল একাধিক কণ্ঠে। কবি আবদুস সালাম পড়েছিলেন তাঁর ভাষণ। এভাবেই শুরু। কারও নির্দেশে নয়, কারও প্ররোচনায় নয়, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমরা শুরু করলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সুসংগঠিত, পূর্ণাঙ্গ কোনো ব্যাপার নয়, বরং তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ততার প্রকাশ।
অধিবেশন চলে আধা ঘণ্টার মতো। সম্প্রচারের কাজে স্বেচ্ছায় যুক্ত হন চট্টগ্রাম বেতারের মেকানিক আবদুস শুকুর। কালুরঘাটে অনুষ্ঠান প্রচারের পর্বে শেষ দিন ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি আমাদের সঙ্গী ছিলেন। এ অধিবেশনে এম এ হান্নান আবার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করেন। যেহেতু এ বেতার গোপন একটি কেন্দ্র, তাই তাঁর নাম আর প্রচার করা হয়নি। অধিবেশন শেষে আমরা যখন বাইরে এলাম, তখন আর কেউ নেই। শুধু হান্নান সাহেবের জিপ স্টার্ট নিচ্ছে। আমরাও শহরে যাব। গাড়িতে জায়গা নেই, এ কথা বলে আমাদের তিনজনকে সঙ্গে নেওয়ার অনুরোধ রাখলেন না তিনি। ধুলো উড়িয়ে চলে গেল জিপ। আমরা হতভম্ব। কী আর করা! পথে যথারীতি আলো নেই। তিন-চার মাইল পথ হেঁটে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমরা ঢুকলাম মুশতারী লজে। উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম। কারও কারও চোখ তখন সজল। মুশতারী লজেই গভীর রাত পর্যন্ত চলল পরের দিনের প্রস্তুতি। বিদেশি বেতার শুনে খবর নোট করা। সে কাজে সক্রিয় সাহায্য জুগিয়েছিলেন বেগম মুশতারী শফীর ছোট ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারী। পরবর্তী সময়ে দখলিত চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনারা ডাক্তার শফী ও তাঁর শ্যালককে ধরে নিয়ে যায়। তাঁরা আর ফেরেননি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দুই শহীদ।
২৭ থেকে ২৯ মার্চের মধ্যে আমাদের তিনজনের সঙ্গে যুক্ত হলেন আরও সাতজন। কাজি হাবিবুদ্দীন ছিলেন তরুণ ব্যবসায়ী। ছিউড়া কাজিবাড়ির ছেলে। আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই স্বেচ্ছায় তাঁর সংশ্লিষ্টতা। বেতারের প্রকৌশল বিভাগের শরফুজ্জামান আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ঢাকার মুসলিম হাইস্কুলে আমরা ছিলাম সহপাঠী। আমিনুর রহমান, রাশেদুল হাসান, রেজাউল করিম চৌধুরীও প্রকৌশল বিভাগের কর্মী। পোশাকি পদ টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। সৈয়দ আবদুস শাকের ছিলেন বেতার প্রকৌশলী। মোস্তফা আনোয়ার অনুষ্ঠান প্রযোজক। ১০ জন হওয়ায় আমাদের কাজের শক্তি বেড়ে গিয়েছিল। যার যার পদ অবশ্য আমরা আগ্রাবাদেই ফেলে এসেছিলাম।
২৭ মার্চের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কালুরঘাটে তত্কালীন মেজর জিয়াউর রহমানের উপস্থিতি। তাঁকে পটিয়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন বেলাল মোহাম্মদ নিজে। তাঁর কমান্ডে থাকা কিছু সেনাকে ট্রান্সমিটার ভবন সুরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বেলাল ভাইয়ের অনুরোধে স্বধীনতার পক্ষে বিবৃতি দিতে তিনি রাজি হন। নিজেই ইংরেজিতে লেখেন তাঁর বয়ান। এবং সে বয়ানে ‘অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ কথাটার সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল। এর বাংলা অনুবাদে বেলাল মোহাম্মদকে সাহায্য করেন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। এ ঘোষণার বক্তব্য সংবাদ বুলেটিন হিসেবে প্রচার করেছিলেন আবুল কাসেম সন্দ্বীপ। অনুবাদ প্রথমে পঠিত হয় আমার কণ্ঠে। পরে একাধিক কণ্ঠে। ট্রান্সমিশনের দায়িত্বে ছিলেন আমিনুর রহমান ও আবদুস শুকুর। অনুষ্ঠান ঘোষণার দায়িত্বও আমার ওপর বর্তায়।
২৮-২৯ মার্চ থেকে আমরা ট্রান্সমিটার ভবনেই থাকতে শুরু করলাম। খাবার আসত আশপাশের গ্রাম থেকে। স্থানীয় মোহরা গ্রামের দুই ভাই সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী সেকান্দার হায়াত খান ও হারুনর রশিদ খান এই কালুরঘাট প্রচারপর্বে আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তাঁদের কাছে আমাদের অশেষ ঋণ, কখনো শোধবার নয়। ২৮ ও ২৯ মার্চ জিয়াউর রহমান সাহেব ইংরোজিতে আরও দুটি ঘোষণা পাঠ করেন। একটিতে নিজেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রবাসী রাজনৈতিক নেতাদের এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখেছি। পরে অবশ্য তিনি এই দাবির পুনরুল্লেখ করেননি। তাঁর লিখিত ইংরেজি বিবৃতি পাঠ করেন তখনকার তরুণ লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী। ২৬ ও ২৭ মার্চের অধিবেশনেই শুধু বেতারের ‘বিপ্লবী’ নামটি চালু ছিল। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ‘বিপ্লবী’ কথাটা বাদ দেওয়া হয়। ২৮ মার্চ থেকে শুধু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামেই প্রচারকাজ চলেছে একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত। খুব সম্ভবত ২৯ মার্চ থেকে অনুষ্ঠানে সূচক সুর ও সমাপ্তি সুর হিসেবে যুক্ত হয়ে গেল গাজি মজহারুল আনোয়ার রচিত এবং আনোয়ার পারভেজ সুরারোপিত সেই চিরায়ত গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। আমাদের সহযোদ্ধা শরফুজ্জামান সংগ্রহ করে এনেছিল এই গানের রেকর্ডটি।
৪ এপ্রিল থেকে ৮ এপ্রিল বাগাফা ক্যাম্পেই আমরা থেকেছি, জওয়ানদের মেসে খেয়েছি এবং অনুষ্ঠান প্রচার করেছি। প্রতিদিন দুটি অধিবেশন। শেষ দিন সকালের অনুষ্ঠানের পরই সেখান থেকে আমাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ আসে। বাগাফা থেকে আমাদের নেওয়া হয় আগরতলার অদূরে শালবাগানে। সেখানেই বিএসএফের একটি অংশের সদর দপ্তর। ৪০০ ওয়াট শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার থেকে অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর আবার স্থানান্তরিত হই আমরা। কয়েক দিন কাটে ছিন্নমূল অবস্থায়। রাত্রিবাস সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ট্রাকে। বিএসএফের ইউনিটগুলো স্থান বদল করছিল মাঝেমধ্যেই। মলিন বাস আমাদের, নির্ঘুম আমরা। সেখানেই একদিন দেখা হয় কর্নেল (পরে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক) ওসমানী এবং এম আর সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে করমর্দন করার সময় তাঁর সহজাত দৃঢ়তার পরিচয় পেলাম। সৈনিকের হাতই বটে। আমাদের হতদরিদ্র অবস্থা দেখে এম আর সিদ্দিকী কিছু ভারতীয় টাকা তুলে দেন বেলাল ভাইয়ের হাতে। মেজর খালেদ মোশাররফকেও কিছুক্ষণের জন্য পাই আমরা। আমাদের পরিচয় জেনে খুব উত্সাহ দেন।
১১ এপ্রিল এই সাময়িক ছিন্নমূল অবস্থা থেকে যিনি আমাদের উদ্ধার করেন, তিনি বিএসএফের একজন বাঙালি কর্মকর্তা কর্নেল শঙ্করপ্রসাদ ব্যানার্জি। তিনি আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন আগরতলা শহরের একটি বাড়িতে। ৯১২ কর্নেল চৌমুহনী। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাংবাদিক, ’৭০-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে হারিয়ে লায়ন-কিলার নাম অর্জন করা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সেখানে। আরও ছিলেন মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ। ঠিক হলো, এখানেই থাকব আমরা পাঁচজন। রেকর্ড করা হবে অনুষ্ঠান। আমরা নিশ্চিন্ত, থাকতে পারব পরিচিতদের মাঝখানে। বাড়ির গ্যারেজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। মেঝের ওপর বিছানা পাতা। সেটাকেও রাজকীয় মনে হচ্ছিল। এখানেই অনুষ্ঠান তৈরি করা। এখানেই শরফুজ্জামান রেকর্ড করার ভালো ব্যবস্থা গড়ে তুলল। ৮ এপ্রিলের প্রভাতি অধিবেশনের পর তিন দিন আমরা অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারিনি।
কর্নেল চৌমুহনীতে আওয়ামী লীগের সাময়িক প্রশাসনিক দপ্তর। সেখানে সীমান্ত পেরিয়ে আসা বহু মানুষের আনাগোনা। তথ্য সংগ্রহের সুবিধা ছিল। যথারীতি ইংরেজি সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব আমার। অনুষ্ঠান ঘোষণাও করতে হতো। বেলাল ভাই, মোস্তফা আনোয়ার কথিকা লিখছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ইংরেজিতে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে কথিকা রেকর্ড করেছেন। কথিকা পড়ছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। একদিন শরফুজ্জামান রেকর্ড করল বদরুল হাসানের কণ্ঠে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। অধ্যাপনা করতেন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে। ক্যাসেটে রেকর্ডিং। সেই ক্যাসেট প্রচারের জন্য নিয়ে যেতেন বিএসএফের ক্যাপ্টেন দেশমুখ। ১১ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত এখান থেকেই সরবরাহ করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান।
একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমার পরনে একটি শার্ট ও প্যান্ট। এতদিনে তা হয়ে পড়েছে জীর্ণ ও মলিন। একদিন এসে পৌঁছালেন ঢাকা থেকে টেলিব্যক্তিত্ব মুস্তাফা মনোয়ার। আমার অবস্থা দেখে তাঁর একটি ফুলপ্যান্ট আমাকে পরতে দিলেন। কিন্তু ফিট করল না একেবারেই। আমার যে কী দুঃখ সে দিন! ১৭ এপ্রিল আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বাংলা একাডেমির সুব্রত বড়ুয়া। আমাদের লেখালেখির শক্তি আরও বেড়ে গেল। ২০ এপ্রিল ১৯৭১। আগরতলা জেল রোডে সিপিআইএম এমএলএ অঘোর দেববর্মনের বাড়িতে ওঠানো হলো আমাদের। এবার আমরা ছয়জন। থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। এক বাঙালি বৃদ্ধার ওপর দায়িত্ব রান্নার। আমাদের মাসিমা। খুব আদর করে খাওয়াতেন। তবে আমাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল। বলা হয়েছিল আমরা বিএসএফের কর্মী। ভিন্ন ভিন্ন নাম নেওয়া হয়েছিল। বেলাল ভাই নাম নিলেন লালমোহন, মোস্তফা ভাই তাঁর প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে হলেন শক্তি। মাসিমার উপস্থিতিতে সাবধানে কথা বলতে হতো, যাতে বুঝতে না পারেন যে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। একদিন কে যেন চিত্কার করে উঠল: মাসিমা, নাশতা। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে বললাম, নাশতা না, জলখাবার। এই সময়টা আমাদের খুবই নিরুদ্বিগ্ন কেটেছে।
মোস্তফা আনোয়ারের কথা খুব মনে পড়ছে। ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে তিনি পড়েছিলেন নিজের লেখা একটি কবিতা ‘বৈশাখের রুদ্র জামা’। এখনো আমার শরীরের লোমগুলো জেগে ওঠে এই কবিতাটির কথা মনে হলে। ‘ওরা মানুষ হত্যা করেছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি,’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই বহুল প্রচারিত স্লোগানটিও তাঁর। এই স্লোগান অবলম্বন করেই ইয়াহিয়া খানের স্কেচ করেন কামরুল হাসান।
২৪ মে পর্যন্ত জেল রোডের বাড়ি থেকেই অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হয়েছে। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের একটি ভাষণ এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের দেওয়া রেকর্ড করা ভাষণ প্রচারিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। ২৪ মে বন্ধ করে দেওয়া হয় এই পর্বের ট্রান্সমিশন। তত দিনে আমরা ১০ জন আবার একত্র। সুব্রতদাকে নিয়ে আমরা হলাম এগারো। আগরতলার পাট চুকিয়ে ২৬ মে বিমানে সুব্রতদা, সন্দ্বীপ আর আমি পৌঁছে গেলাম কলকাতায়। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। আগরতলার সঙ্গে আমাদের অনেক স্মৃতি। একটু মন খারাপ করেছিল বৈকি।
এই বাড়িতে তখনো রয়েছেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও কয়েকজন মন্ত্রী। বেতারকর্মীদের জায়গা দিতে তাঁরা কিছুদিনের মধ্যেই অন্যত্র চলে যান। প্রাথমিকভাবে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল সেখানেই। কিন্তু বহু মানুষ তখন আসছেন সীমান্ত পেরিয়ে। তাঁদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি আমরা খাবার। পরে বাইরে খাওয়ার জন্য টাকা দেওয়া হতো আমাদের। চট্টগ্রাম, ঢাকা আর রাজশাহী থেকে আসা বেতারকর্মীদের উপস্থিতিতে চঞ্চল হয়ে উঠল ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দ্বিতল বাড়িটি। কামাল লোহানীর নেতৃত্বে বার্তা বিভাগের কাজ চলছে জোরেশোরে। সাদেকিন, রণজিত্ পাল চৌধুরী (রণপা), সুব্রত বড়ুয়া এবং অন্যরা খবর তৈরিতে ব্যস্ত। এলেন আলমগীর কবির। আজকের নামী নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের সহযোগিতায় গড়ে তুললেন ইংরেজি অনুষ্ঠান। কল্যাণ মিত্র রচনা করলেন নাটক জল্লাদের দরবার। মুখ্য অভিনেতা রাজু আহমদ। ছিলেন রণেন কুশারী, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, সুমিতা দেবী। চট্টগ্রাম থেকে এসেছিলেন কল্যাণী ঘোষ, প্রবাল চৌধুরী, রঙ্গলাল দেব চৌধুরী। ঢাকা থেকে এসেছেন অজিত রায়, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, মান্না হক আরও কত শিল্পী। কথিকা পড়তে আসছেন সৈয়দ আলী আহসান, জহির রায়হান, মজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কবিতা পড়ছেন আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা। কর্মীদের মধ্যে কনিষ্ঠতম নাসিম চৌধুরী। লিখে ফেলল একদিন তার কবিতা ‘কমান্ডার’। এভাবেই চলছিল। উপস্থাপক হিসেবে আমার নাম ছিল ইফতেখার আহমদ। নানা অনুষ্ঠানেই অংশ নিতাম।
কিন্তু একধরনের অনিশ্চয়তা বিক্ষিপ্ত করে তুলছিল মন। অক্টোবর মাসে প্রবাসী সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পরিচালক এম আর আখতার মুকুল জানালেন, কয়েকজন ওয়ার করেসপনডেন্ট পাঠানো হবে সেক্টরে। যাবে নাকি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। সামনে থেকে যুদ্ধ দেখতে চাই। সহকর্মীদের না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম। তাঁরা পছন্দ করেননি। তবুও বিদায় দিলেন। চাঁদা তুলে চীনা খাবার খাওয়ালেন।
এর পর আমার অন্য যাত্রা। আমরা চললাম ৬ নম্বর রংপুর-দিনাজপুর সেক্টরে।