বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালিত গণহত্যাকালে মার্কিন সিনেটে তাঁর এক বক্তব্যে সিনেটর উইলিয়াম প্রক্সমায়ার বলেছিলেন, ‘নািস জার্মানিকৃত বর্বরতা এবং এশীয় উপমহাদেশে সংঘটিত নৃশংসতার মধ্যে রয়েছে ত্রিশ বছরের ফারাক। যাঁরা ভেবেছিলেন গণহত্যা নিছক অতীতের ঘটনা, তাঁদের নিদ্রাভঙ্গ ঘটিয়েছে এই বাস্তবতা।’ আমরা জানি, এডওয়ার্ড কেনেডি, উইলিয়াম স্যাক্সবিসহ অনেক মার্কিন সিনেটর একাত্তরে সংগ্রামরত বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

উইলিয়াম প্রক্সমায়ারও ছিলেন তাঁদের একজন, কেনেডি-স্যাক্সবির মতো নেতৃভূমিকা যদিও তাঁর নয়, তা সত্ত্বেও প্রক্সমায়ারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে এই রচনার সূচনা ঘটানো হলো অন্য কারণে। প্রক্সমায়ারকে বিশেষভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে হয়। কেননা, ১৯৬৭ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জাতিসংঘ প্রণীত জেনোসাইড কনভেনশন যুক্তরাষ্ট্র যেন স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে, সেই দাবি সিনেটে তুলে ধরবেন। যুক্তরাষ্ট্র জেনোসাইড কনভেনশন স্বাক্ষর না করা পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হবেন না, এই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা। এর পর থেকে সিনেটের প্রতিটি অধিবেশনে প্রক্সমায়ার স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কনভেনশন অনুমোদনের পক্ষে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে গেছেন।

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অধিবেশনের গোড়াতে, তখনো হয়তো সব সদস্য এসে পৌঁছাননি, কিন্তু প্রক্সমায়ার রীতিমাফিক তাঁর ভাষণ দিয়েছেন এবং তা রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। ১৯ বছর তিনি ছিলেন সিনেটের সদস্য এবং যতবার তিনি সিনেট অধিবেশনে হাজির হয়েছেন, গোড়াতেই প্রদান করেছেন তাঁর জেনোসাইড ভাষণ। হিসাবে দেখা যায়, তিনি তিন হাজার ২১১ বার এই বক্তব্য দিয়েছেন এবং শেষাবধি ১৯৮৬ সালে রিগ্যান প্রশাসন জেনোসাইড কনভেনশনে অনুমোদন প্রকাশ করে।

উইলিয়াম প্রক্সমায়ারের উদাহরণ টানা হলো গণহত্যা মোকাবিলার লক্ষ্য অর্জনে তাঁর নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও অপরিমেয় প্রাণশক্তির পরিচয় মেলে ধরতে। গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের শিকার হওয়াটা যেকোনো জাতির জন্য চরম নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা এবং এর বিপরীতে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম পরিচালনাও কোনো সহজ কাজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন প্রক্সমায়ারের মতোই নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও অপরিমেয় প্রাণশক্তি।

বাংলাদেশের কোটি মানুষ হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের নির্মমতার শিকার। ন্যায়ের পথে আইনি প্রক্রিয়ায় এর সমাধানে ব্রতী হয়েছিল যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে মানবজাতির সংগ্রামে যুক্ত করেছিল অনন্য উদাহরণ। ৪০ বছরের বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে পেরেছে, এই পর্বান্তরেরও রয়েছে ঐতিহাসিক তাত্পর্য। এর বিভিন্ন মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য যথাযথভাবে অধ্যয়ন ও অনুধাবন তাই বিশেষ জরুরি, কেননা এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার বিষয়ে জাতির গর্বের দিকগুলো যেমন আমরা শনাক্ত করতে পারব, তেমনি সক্ষম হব নাগরিক সমাজের সদস্য হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র নির্মাণ করতে।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সংসদে গৃহীত হয় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন’ এবং সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে এই আইনকে বিশেষ সুরক্ষা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত, সমস্যাপীড়িত রাষ্ট্র, মার্কিন-সোভিয়েত বৃহত্ শক্তির দ্বন্দ্বে বিশ্ব বিভাজিত এবং জাতিসংঘের সদস্যদেশের মধ্যে গণহত্যার বিচার করার মতো ঐক্যভিত্তি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে তখনো একঘরে করে রাখা হয়েছে, জাতিসংঘে প্রবেশাধিকার মেলেনি, চীন দেয়নি স্বীকৃতি, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি গোঁড়া দেশও নিয়েছে একই অবস্থান। সেই পটভূমিকায় এমন এক আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নে রাষ্ট্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগীরা বিশেষ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের আইনবিদেরা সেই তমসাপীড়িত সময়েও আন্তর্জাতিক অপরাধ মোকাবিলায় আইনি বিধান গড়ে তুলতে বিশ্বজনীন যেসব প্রয়াস ছিল, তার সঙ্গে সেতুবন্ধ গড়ে তুলেছিলেন। সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনৈক্য দ্বারা বিশ্বসমাজ তখন আক্রান্ত, গণহত্যা মোকাবিলায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের পথ বেয়ে ১৯৪৮ সালে গৃহীত হয়েছিল জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন, কিন্তু সে পর্যন্তই। পরবর্তী দশকগুলোতে গণহত্যা মোকাবিলায় আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

এহেন পরিস্থিতিতে ন্যুরেমবার্গ আদালতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্ব এবং গণহত্যার অভিজ্ঞতা পেছনে ঠেলে নতুন পৃথিবী নির্মাণের স্বপ্নদ্রষ্টা স্বল্পসংখ্যক মানুষ তাঁদের আশা হারাননি, প্রয়াসে ক্ষান্ত হননি। ষাটের দশকে তাঁরা বিশেষভাবে উদ্যোগী ছিলেন ওয়াশিংটনের ‘ওয়ার্ল্ড পিস সেন্টার’-এর মাধ্যমে। ১৯৭০ সালে তাঁদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ফাউন্ডেশন ফর দি এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্ট’ এবং ১৯৭১ সালে আমেরিকার ইলিনয়ে অনুষ্ঠিত হয় ফাউন্ডেশনের প্রথম কংগ্রেস।

ফাউন্ডেশনের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনবিষয়ক যাবতীয় দলিলপত্র সংগ্রহ করেন বেনজামিন ফেরেঞ্জ এবং বিশালাকারে চার খণ্ডে তা প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন ন্যুরেমবার্গ বিচারশালার প্রসিকিউশন দলের সদস্য এবং অনেককাল পরে, নব্বইয়ের দশকের শেষাশেষি, সেন্টু রায় নির্মিত তথ্যচিত্র টিয়ার্স অব ফায়ার-এ বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য তীক্ষ দাবি তিনি উত্থাপন করেছিলেন।

ফাউন্ডেশনের সঙ্গ্রেযুক্ত আরও দুই ব্যক্তির সঙ্গ্রেবাংলাদেশের ন্যায়শাস্ত্রীদের বিশেষ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তাঁরা হলেন জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট ফর ফরেন অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল-এর প্রফেসর হান্স হাইনরিশ জেশেক এবং সালজবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অটো ট্রিফটেরার। বিশ্বসমাজের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই যে বাংলাদেশের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইন’ প্রণীত হয়েছিল, তার অংশী ও সাক্ষী ছিলেন এই মানুষেরা। তাঁদের মধ্যে অটো ট্রিফটেরার এখনো জীবিত ও সক্রিয় কর্মে নিবেদিত রয়েছেন, বয়স নিশ্চয় তাঁর ৯০ পেরিয়ে গেছে। গত নভেম্বর ২০১২-তে প্রকাশিত মর্টেন ব্রেগ্সেমা ও চিয়া উই লিং সম্পাদিত ওল্ড এভিডেন্স অ্যান্ড কোর ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম্স গ্রন্থে অটো ট্রিফটেরার এক দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন, যার অনুবাদ বাংলায় হতে পারে ‘আন্তর্জাতিক আইন-মান অনুসারে যুদ্ধ-পরবর্তী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রয়াস’।

আইন প্রণয়নে ক্ষীণ কিন্তু তাত্পর্যময় তত্কালীন আন্তর্জাতিক প্রয়াসের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্তির পরিচয় মেলে তাঁর নিবন্ধে। তিনি জানিয়েছেন যে ১৯৭২ সালে ইতালির বেলাজ্জিওতে যখন ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখন একটি বিশেষ অধিবেশন পরিচালিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ-সংক্রান্ত সমস্যা’ আলোচনার জন্য। রিপোর্টে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে দুজন প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল। এ ছাড়া তৃতীয় আরেকজনের কথা জানা যায়, তিনি হলেন ঢাকাস্থ ওয়ার ক্রাইম্স ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি। ট্রিফটেরার আরও জানিয়েছেন যে খসড়া সংবিধি রচনার দ্বিতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি এবং অভিযুক্তের আপিলের সুযোগদানের প্রস্তাব সংখ্যাধিক্য ভোটে বাতিল হয়ে যায়। ন্যুরেমবার্গ বিচারে এমন বিধান ছিল না, এটাই ছিল বিরোধীদের প্রধান যুক্তি। স্মরণ করা যায়, বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনেও আপিলের সুযোগ ছিল না এবং বর্তমান সরকার আইনের সংশোধনকালে আপিলের সুযোগ যুক্ত করেছে, যা প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্তের অধিকার প্রসারিত করেছে। সামগ্রিকভাবে ট্রিফটেরার মনে করেন, বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে আন্তর্জাতিক মহলের অর্জিত উপলব্ধি ও বিতর্ক-বিবেচনার প্রতিফলন ঘটেছে।

এটা লক্ষণীয় যে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ফাউন্ডেশনের তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়, বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ আগ্রহ ও সমর্থনে। সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রণীত ১৯৭৩ সালের আইন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলের অনুমোদন লাভ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বাংলাদেশের আরেক তাত্পর্যময় সংযোজন এখনো বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি, সেটা হলো সংঘাতকালে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীর বিচার পাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে ‘ধর্ষণ’ চিহ্নিত হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে, যা ইতিপূর্বেকার ন্যুরেমবার্গ বা টোকিও ট্রাইব্যুনাল অথবা জেনোসাইড কনভেনশন কোথাও স্বীকৃত বা প্রতিফলিত হয়নি। নব্বইয়ের দশকে যখন জাতিসংঘের উদ্যোগে পূর্বতন যুগোস্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হয়, তখন ধর্ষণের বিষয়টি বিশেষ মনোযোগ ও স্বীকৃতি লাভ করে। পরে ২০০২ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির সংবিধিতে ধর্ষণ ও আনুষঙ্গিক অপরাধের সবিস্তার উল্লেখপূর্বক ধারা-উপধারা সন্নিবেশিত হয় এবং বিশেষভাবে এই নারীদের জন্য সাক্ষী সুরক্ষার বিস্তারিত ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে ধর্ষণ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল দুই লক্ষাধিক নারীর চরম দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার প্রদর্শিত সংবেদনশীলতা। সংঘাতকালে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের বঙ্গবন্ধু বরণ করেছিলেন ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে, তবে সমাজ ও রাষ্ট্র পরবর্তীকালে এই অভিধার মহিমা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি। একই সঙ্গে তত্কালীন সরকার নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ সংস্থা গঠন করে বিভিন্ন জেলায় শাখা কেন্দ্র স্থাপন করে। গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করে গর্ভপাতকে সাময়িককালের জন্য একধরনের বৈধতা প্রদান করা হয়। এই কাজে বাংলাদেশকে সহায়তা জোগাতে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন ডা. জিওফ্রে ডেভিস, অস্ট্রেলিয়ান যে বিশেষজ্ঞ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছেন, কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তাঁর রিপোর্টে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা চার লক্ষাধিক বলে অনুমান করেছেন। পাশাপাশি যুদ্ধশিশুদের বিদেশে দত্তক গ্রহণের জন্য বিশেষ বিধান ও ব্যবস্থা সরকার নিয়েছিল। সংঘাত-পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের উদ্যোগে নারীদের প্রতি সংবেদনশীল এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশ ছিল পথিকৃত্। এসব উদ্যোগই প্রতিফলিত হয়েছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের তালিকায় ধর্ষণের মতো নিষ্ঠুরতাকে অন্তর্ভুক্ত করায়।

সব মিলিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন গণহত্যার শিকার অযুতজনের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠা করেছিল, আর তাই ৪০ বছর অতিক্রান্ত হলেও অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের আইন ও গঠিত ট্রাইব্যুনাল কেবল জাতীয়ভাবে তাত্পর্যমণ্ডিত নয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ইতিহাসেও তার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা এবং সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে এই বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ আজ ব্রতী হয়েছে।

এই সুপরিসর প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে আমরা বুঝব, সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে দেখার কোনো অবকাশ নেই। এই বিচার ৩০ লাখ শহীদের অধিকার ও প্রত্যেক শহীদের প্রাপ্য, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে হিন্দু-অধ্যুষিত বসতির ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের পথ-প্রদর্শক (সর্বার্থে) দলের হামলায় গোষ্ঠীগতভাবে মৃত্যুবরণকারী নারী-পুরুষ-শিশু সব শহীদের আইনগত অধিকারের বিচার পাওয়া, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে বিধ্বস্ত জীবনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া প্রতিটি নারীর প্রাপ্য এই বিচার, ঘরবাড়ি ফেলে দেশ ছেড়ে আকুল হয়ে পালিয়ে যাওয়া এক কোটি শরণার্থী ও শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুবরণকারী প্রতিটি প্রাণের অধিকার রয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সুরাহা অর্জনের, দেশের অভ্যন্তরে আরও যে প্রায় চার কোটি মানুষ নিজ আবাস ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, অন্যান্য অমানবিক কাজের মতো তাদের জীবন তছনছ করে দেওয়ার মানবতাবিরোধী এই অপরাধের বিচারে তাদের সবার ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে।

ভয়ংকর, সুবিস্তৃত ও সুসংগঠিত নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিল জাতি এবং আইনের পথে এর মীমাংসার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সদস্যদেরসহ হত্যা এবং কারাগারের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতার হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে শুরু হয় বিচারের অস্বীকৃতির আরেক পর্ব। ইতিহাসের সুদীর্ঘ এই কৃষ্ণ অধ্যায় জুড়ে বাংলাদেশে গণহত্যার বিচারানুষ্ঠানের সব সুযোগ ও সম্ভাবনা বিলুপ্ত করার আয়োজন হয়ে ওঠে মহাশক্তিধর। সেই চরম দুঃসময়েও মানুষ তো বিচারের দাবি কখনো বাজেয়াপ্ত হতে দেয়নি। স্মৃতি জাগরূক রাখার মাধ্যমে ন্যায়ের সেই অগ্নিশিখা কখনো নিভে যেতে দেওয়া হয়নি, বরং নতুন প্রজন্ম, তরুণ মানসে এর অনুরণন তৈরি করে নতুন শক্তি, অভিজ্ঞতা বয়ে চলে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে, গানে-কবিতায়-নাটকে-চলচ্চিত্রে-গল্পে-উপন্যাসে—স্মৃতিকথায় কতভাবে না বহমান থাকে অভিজ্ঞতা। এরই আলোকিত উদ্ভাসন লক্ষ করা যায় মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার অযুত পরিবারের এক মাতা শহীদজননী জাহানারা ইমামের স্মৃতিগ্রন্থে, যা আকুল করে তোলে তরুণ-মানস এবং তাঁর দ্বারা সূচিত যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্দোলন রূপ নেয় বিপুল সামাজিক আন্দোলনে। সমাজের অভ্যন্তরে সর্বদা চলছিল এই লড়াই, বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে ন্যায়ের দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন্রহয়ে ওঠে অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন যে যুদ্ধাপরাধের বিচারানুষ্ঠানের দায়িত্ব পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর বর্তায়। জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণেও তিনি এর উল্লেখ করে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টির স্বীকৃতি প্রকাশ করেন।

সমাজের দাবি ও সরকারি স্বীকৃতির সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্তি ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিচারের পক্ষে-বিপক্ষে রায় প্রদানের অবস্থান তৈরি করে এবং বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মের সদস্যরা, প্রথমবারের মতো ভোটদাতারা, যাঁরা কোনো দলের সদস্য নন, দলীয় রাজনীতির বাইরে যাঁদের অবস্থান, তাঁরা বিপুলভাবে রায় প্রদান করেন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের পক্ষে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইনের আলোকে, যথাযথ সংশোধনীসহ, শুরু হয়েছে বিচার-প্রক্রিয়া, যা দলীয় এজেন্ডা ছাপিয়ে নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জাতীয় এজেন্ডা হিসেবে। এটা লক্ষণীয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি জুগিয়েছিল সত্তরের নির্বাচন ও জাতীয় অধিকারের প্রতি ঘোষিত অভূতপূর্ব সমর্থন। ৪০ বছর পর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া সূচিত হওয়ার পেছনেও রয়েছে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ঘোষিত গণরায়। ফলে এক অসাধারণ ন্যায়যাত্রা বাংলাদেশ সূচিত করেছে এবং এর সফলতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক অপরাধের মোকাবিলা করে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা ও উদ্যোগের সঙ্গে নিবিড় সম্পৃক্তি-সাধনও বিশেষ জরুরি।

প্রায় ৪০ বছর আগে এক অন্ধকার সময়ে বাংলাদেশ যখন আইনের মশাল প্রজ্বালন করেছিল, তখন ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। আজ বাংলাদেশ দেশি আদালত বা ডোমেস্টিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই ট্রাইব্যুনালের আন্তর্জাতিক বিচারশালা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি ২০০২ সালে সংবিধি গৃহীত হওয়ার পূর্বেকার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ আমলে নিতে পারগ নয়। সেই সঙ্গে এটাও তো আমরা স্মরণ করি, কোনো দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হলে বিচারের দায় প্রথমত ও মূলত সেই দেশ বা জাতির ওপর বর্তায়। আইসিসির মুখবন্ধে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে যে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ-জাগানিয়া অতীব গুরুতর অপরাধসমূহ শাস্তির বাইরে থাকতে পারে না এবং এর কার্যকর অভিযুক্তি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দ্বারা তা প্রসারিত করার মাধ্যমে।’

আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারানুষ্ঠান জাতির দায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইসিসি এবং জাতি তা পালনে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গৃহীত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় কর্তব্য পালনের অনন্য ও পথিকৃত্ উদাহরণ তৈরি করছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়বদ্ধতা রয়েছে এবং নানাভাবে বিধিসম্মতভাবে এই সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। বিচারকদের আইনি পরামর্শদানের জন্য নিয়োগ করা যেতে পারে অ্যামিকাস কিউরি। তাঁদের কাছে আবার দেশ-বিদেশের আইন বিশেষজ্ঞরা অভিমত পেশ করতে পারেন। ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে একটি গবেষণা দল এবং কম্পোডিয়ার আদালতের মতো একটি ভিকটিম সাপোর্ট ইউনিট রাখা যেতে পারে, যুক্ত হতে পারে তাদের মতো আউটরিচ প্রোগ্রাম, যেখানে নাগরিক সমাজ পালন করতে পারে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা।

বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-বাংলাদেশ নানা কারণে আন্তর্জাতিক সহায়তার ক্ষেত্র বিশেষ সম্প্রসারিত করতে পারেনি। এই সহায়তা গ্রহণের অর্থ এই নয় যে ডোমেস্টিক ট্রাইব্যুনালে বিদেশি আইনজীবী সওয়াল-জবাব করবেন, বরং এই সহায়তার অর্থ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও সংস্থার অভিজ্ঞতা গ্রহণ। সে জন্য বিচারকদের সঙ্গে অন্যান্য আন্তর্জাতিক আদালতের যোগাযোগ ও সম্পৃক্তি সাধন গুরুত্বপূর্ণ।

একই গুরুত্ব বহন করে কৌঁসুলি ও তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্যান্য আদালত ও সমপর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন। আন্তর্জাতিক অপরাধের ধরন ও ব্যাপকতার বিবেচনা থেকে ভিকটিমস রাইট বা ক্ষতিগ্রস্তের অধিকারের ধারণা বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে এবং তার রূপায়ণ বাস্তব কর্মপন্থার রূপ অর্জন করেছে। আমাদের বিচার-প্রক্রিয়ায় ভিকটিমস রাইটস-সংক্রান্ত দুর্বলতা মোচনেও অনেক ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পৃক্তি বিশেষ সহায়ক হতে পারে। আদালতের অভিজ্ঞতা তো আমাদের দেখিয়ে দেয় অভিযোগের সঙ্গে যুক্ত মুষ্টিমেয়-সংখ্যক ভিকটিম বক্তব্য প্রদানের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন এবং তাঁদের বক্তব্য নথিভুক্ত হবে। কিন্তু এর বাইরে যে রয়ে যাবেন হাজার হাজার, লাখ লাখ ভিকটিম, তাঁদের বক্তব্য তো হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তথা ট্রানজিশনাল জাস্টিসের ধারণা এবং ট্রুথ কমিশনের ইতিহাস ও কার্যকারিতা আমাদের নিবিড় অধ্যয়ন দাবি করে।

ইতিমধ্য্রেবাংলাদেশে সূচিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের প্রতি সহায়তামূলক আন্তর্জাতিক শক্তি বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে, তেমনই এর বিপরীতে রয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অথবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সোচ্চার সমালোচনামূলক সংস্থা, তবে তাদের তো আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্পর্কে কোনো বিশেষ দক্ষতা নেই, মূলত মানবাধিকার সুরক্ষার তাগিদ থেকে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকারের প্রতি, ভিকটিমের অধিকার নিয়ে তারা একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি, যে অধিকার মূলত আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়। সে জন্যই আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ মহলের বিশেষ সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে বাংলাদেশের বিচার-প্রক্রিয়ার প্রতি।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিচার-প্রক্রিয়ার কোনো দিক নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্যে গুটিয়ে যাওয়া অথবা মারমুখী হওয়ার প্রয়োজন নেই। মনে পড়ে, আন্তর্জাতিক এক বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছিলেন, কোনো দেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারে আইনি দক্ষতায় আপনা-আপনিভাবে সিদ্ধ হয়ে ওঠে না, কেননা কোনো জাতিকে এমন বিচারের আয়োজন একবারই করতে হয় এবং যাদের করতে হয় তারা দুর্ভাগা জাতি। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার জাতীয়ভাবে সম্পন্ন করার দায় গ্রহণ করে বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে আন্তর্জাতিক সহায়তায় পরিপুষ্টি অর্জনে তার রয়েছে ন্যায্য অধিকার।

এ ক্ষেত্রে আরও স্মরণ রাখা দরকার, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত কোনো ট্রাইব্যুনালই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নেই। নানা বাধা-বিপত্তি ও বাস্তব অসুবিধার মধ্যে তাদের বিচারকাজ এগিয়ে নিতে হয়। আন্তর্জাতিক আদালতের যে উচ্চমানের কথা বলা হয়, তার বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতর।

যেমন কম্বোডিয়ার গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হাইব্রিড বা সংকর ট্রাইব্যুনাল, কম্বোডীয় ও আন্তর্জাতিক বিচারক নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে যা গঠিত, এই আদালতে চার অভিযুক্তের বিচার চলছে এবং অন্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত বর্তমানে শেষ পর্যায়ে, এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী হান সেন ঘোষণা করেছেন পঞ্চম আর কাউকে অভিযুক্ত করা যাবে না।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রতিফলিত করেছে এবং এর মোকাবিলায় কম্বোডিয়ার বিচারক ও আন্তর্জাতিক বিচারকেরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন, কানাডীয় বিচারক পদত্যাগপত্র পেশ করেছেন। বিচার চলাকালে উদ্ভূত এসব সমস্যা নানা দিক দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত হলেও এটা বিচারের প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, কেননা বিচারের শক্ত আইনগত ভিত্তি সর্বজনীন স্বীকৃত।

সত্য্রও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আইনি প্রক্রিয়া দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশ, বিচার-প্রক্রিয়ার পেছনে শামিল থাকবে গোটা জাতি, বিশেষভাবে উদ্যোগী থাকবে নতুন প্রজন্ম—এই আশাবাদ আমাদের রয়েছে। বাংলাদেশ একাত্তরে বিশ্বসভায় মহিমান্বিতভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, আজ আবার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হয়ে ঐতিহাসিক দায়মোচনের পথে অবতীর্ণ হয়েছে। এই অগ্নিপরীক্ষায় এ দেশের মানুষ কোনোভাবে পরাভব মানবে না, বিজয়ের জন্য লড়বে জাতীয়ভাবে, আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে এবং প্রতিষ্ঠা ঘটাবে সত্য ও ন্যায়ের—এই তো আমাদের দায়, সভ্যতার দায়।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত