বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রের দায়িত্ব

default-image

কোনো রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর অংশগ্রহণ ছাড়া যুদ্ধ ও ব্যাপক পরিসরে নির্যাতন করার ঘটনা প্রায় বিরল। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি (তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তান) সামরিক বাহিনী ও রাষ্ট্রের ভূমিকার তদন্ত ছাড়া সেই সময় সংঘটিত অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এখন আর সম্ভব নয়।

পাকিস্তান কখনোই ব্যাপক পরিসরে তাদের পরিচালিত নৃশংস নির্যাতনের দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি। যদিও সে দেশের বিচার বিভাগীয় কমিশন বলেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণ-নৃশংসতা চালিয়ে থাকতে পারে এবং এতে জড়িত সেনাদের কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা উচিত। পাকিস্তানের দায় অস্বীকার করার এই ঘটনা দুঃখজনক। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, দায় অস্বীকার করার ঘটনা নতুন নয়। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে অগুনতি মানুষকে হত্যা করা হয়, আমূল রাজনৈতিক পটপরির্তন ঘটে এবং সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক ধস নেমে আসে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনোই এর দায় স্বীকার করেনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে নিরপেক্ষ লাওস ও কম্বোডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কার্পেট বোমা হামলা চালায়। কিন্তু দেশটি এর দায় কখনো স্বীকার করেনি। খেমাররুজদের সমর্থন দেওয়া চীনও দায় স্বীকার করেনি।

রাষ্ট্রের নয়, বরং ব্যক্তিবিশেষের অপরাধের দায়দায়িত্ব নিরূপণ করা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের উদ্দেশ্য। ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) শুনানি চলাকালে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে হয়তো হাজির করা যাবে না। কিন্তু বিচার চলাকালে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি তুলে ধরার সুযোগ তো পাওয়া যাবে।

সমালোচনার মোকাবিলা করা

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের এই ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি করার আগে অনেক ঐতিহাসিক প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হবে।

এই বিচারের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের আরও নৈর্ব্যক্তিক রেকর্ড ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যাবে। জাতীয় বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও আইনের শাসন আরও শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা বাড়বে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, দেরিতে হলেও একাত্তরে যাঁরা গণনৃশংসতার শিকার হয়েছেন, তাঁরা সাক্ষ্য দিতে পারবেন। তাঁরা বিচারের রায় শুনে যেতে পারবেন।

সে যাই হোক, ইতিবাচক সব বিষয়ের ওপর ছায়া পড়তে পারে, এমনকি বিচারপ্রক্রিয়া অসমাপ্ত থেকে যেতে পারে, যদি সমালোচনার মুখে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইসিটির সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। সমালোচনাকারীদের কথা থেকে এটা স্পষ্ট যে, তাঁদের অনেকেই কল্পনার স্রোতে গা ভাসিয়ে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছেন। অনেকে রাজনৈতিক কারণে বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং এই ট্রাইব্যুনালকে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশে সমালোচনা করছেন। এ ধরনের সমালোচনা অগ্রাহ্য করতে হবে কিংবা পাশ কাটিয়ে যেতে হবে।

আশার কথা, একদল পর্যবেক্ষক গঠনমূলক মন্তব্য করছেন এবং বিচারপ্রক্রিয়ার মান উন্নয়নে তাঁরা সুপারিশমালা দিয়েছেন। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এসব সুপারিশ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। এসব সুপারিশের কিছু কিছু তারা গ্রহণ করেছে।

সারা বিশ্বের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, কোনো অপরাধ ট্রাইব্যুনালই বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর দিকে আশীর্বাদ পায়নি। যুগোস্লাভ ট্রাইব্যুনালের অসংগতি দূর করতে গত ১৮ বছরে অন্তত ৪৫ বার আইনের পর্যালোচনা করতে হয়। অন্য আদালতের মতোই আইসিটিকেও ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারপ্রক্রিয়া হালনাগাদ করতে হতে পারে। ট্রাইব্যুনালকে এই সুযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কিছু বিষয় বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথম, আইসিটি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মধ্যে সম্পদের ব্যাপক তারতম্য আছে। আইসিটির জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ লাখ ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত আদালতের সঙ্গে তুলনা করলে এই বরাদ্দ বিপুল মনে হতে পারে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে একটি গরিব দেশ। সত্য যে, এই বাজেট জাতিসংঘের সহায়তাপুষ্ট আদালতগুলোর বাজেটের তুলনায় খুবই কম। হেগে স্থাপিত স্থায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বার্ষিক বাজেট প্রায় ১৩ কোটি ডলার। আপনারা হয়তো জেনে অবাক হবেন, ৮০ কোটি ডলার ব্যয় করে গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মাত্র একজন আসামির বিচারকাজ সম্পন্ন্ন করেছে। গত মার্চে প্রথম রায় ঘোষণা করেছে। যে কেউ আশা করতেই পারেন এত অর্থ ব্যয়ে জাতিসংঘের আদালতের শুনানি হবে কার্যকর ও প্রশ্নাতীত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ব্যাপার মোটেও সে রকম নয়। ওই সব আদালতে অবাধ ও নিরপেক্ষ বিচার সম্পর্কে যেসব আশঙ্কা করা হয়েছিল—এর কয়েকটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।

অন্য উদাহরণটি বিচারপ্রক্রিয়ার গতি-সম্পর্কিত। ন্যায়বিচারের স্বার্থে, অহেতুক বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত না করার অধিকার প্রত্যেক আসামির রয়েছে। আমরা অন্য আদালতগুলোর দিকে তাকালে দেখব, এই অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কাউকে যদি দীর্ঘদিন ধরে আপত্কালীন আটক রাখা হয়, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালে, অন্তত ১৫ জন আসামির বিরুদ্ধে রায় বেরোনোর আগে তাঁদের ১০ বছরেরও বেশি বন্দী রাখা হয়। তাঁদের অন্তত দুজনকে বিচারের আগেই আটক থাকতে হয় ১৬ বছর। এমনকি স্থায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রথম আসামিকে রায় শোনার আগে প্রায় সাত বছর কারাগারে কাটাতে হয়। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তুলনামূলকভাবে লঘু।

আইসিটির বিরুদ্ধে আরেকটি সমালোচনা হলো, এই ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন কিছু কিছু অপরাধের যথাযথ সংজ্ঞার ঘাটতি রয়েছে। এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু অপরাধ ও দায়বদ্ধতার সংজ্ঞার ঘাটতি থাকাও বিচিত্র কিছু নয়। অন্য সব ট্রাইব্যুনালেও বিশেষ করে প্রথম রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত এ ধরনের ঘাটতি ছিল। যুগোস্লাভ ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা দায়বদ্ধতার নতুন তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। ওই তত্ত্বকে বলা হয় যৌথ অপরাধ এন্টারপ্রাইজ। এর আওতায় এনে বেশ কয়েকজন আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

সিয়েরালিওনের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ আদালতে অপরাধসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার চলে। জোর করে বিয়েতে বাধ্য করা, শিশুদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আসামিদের ওই আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আগে এ বিষয়ে কোনো সংজ্ঞা ছিল না।

যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার মতো ব্যাপক পরিসরের নির্যাতনমূলক অপরাধের বিচারকাজ পরিচালনা করা অনেক কঠিন ব্যাপার। এ ধরনের অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ায় সব সময় অভিযোজন ও উন্নয়নের প্রয়োজন হয়। এমনকি ভালো তহবিল থাকা সত্ত্বেও এমন কোনো যুদ্ধাপরাধ আদালত নেই, যেটি নিখুঁতভাবে পরিচালিত হয়েছে কিংবা যা সব পক্ষের—জনগণ, মানবাধিকার সংগঠন, এমনকি শুধু ভুক্তভোগীদের—প্রত্যাশা শতভাগ পূরণে সমর্থ হয়েছে। বস্তুত সব আদালতে নিরপেক্ষ বিচার নিয়ে আশঙ্কা ও হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। যদিও এসব আদালতের বিচারক ও আইনজীবীরা নিষ্ঠার সঙ্গে মহত্ত্ব এবং ব্যাপক পরিসরে নৃশংস নির্যাতনবিষয়ক মামলার জটিলতা মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন।

সব ধরনের ঝুঁকি, ত্রুটিবিচ্যুতি ও হতাশা সত্ত্বেও জবাবদিহির এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁরা যে শুধু কুখ্যাত ও দুর্ধর্ষ অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করছেন তাই নয়, বরং তাঁরা সমাজকে ইতিহাসের পাতা উল্টে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা দিচ্ছেন। বিচারপ্রক্রিয়ার বিষয়ে আলোচনার সময় এটা সব সময় মনে রাখতে হবে যে, বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা অভিযুক্ত ব্যক্তি ও ভুক্তভোগী উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। নিরপেক্ষ বিচার শুধু আদালতকে যথাযথ রায় প্রদানই নিশ্চিত করে না, বরং আদালতের সুনাম ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে সমালোচনায় লিপ্ত ব্যক্তিদের সমুচিত জবাব দেয়।

উপসংহার

আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার চলাকালে প্রাপ্ত তথ্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ঐতিহাসিক কোনো মুহূর্তকে তুলে ধরার এক অনন্য সুযোগ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নাবলির নৈর্ব্যক্তিক সমাধানে পৌঁছার জন্য এমন সহায়ক পরিবেশ অন্য কোনো কিছু তৈরি করতে পারে না। যদি বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে এর সুফল আগামী প্রজন্মগুলো অনুভব করতে পারবে। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় যাঁরা যুক্ত, ঝুঁকির মুখে তাঁদের বিধ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই কিংবা সমালোচনার মুখে হতাশ হওয়ারও প্রয়োজন নেই। তাঁদের অবশ্যই বিচার সম্পন্ন করার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

অনুবাদ: মিজান মল্লিক

রিচার্ড কে রজার্স: আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত