ছোটবেলায় শুনেছি, আমার বাবা–মাকে আত্মীয়স্বজনেরা ‘মিলির বাপ’ ‘মিলির মা’ বলে ডাকতেন। মিলি আমার বড় বোন। আড়াই বছর বয়সে মারা যায়। তার ছবি, ব্যবহার্য কাপড়চোপড়, জুতা ইত্যাদি বহুদিন পর্যন্ত আমাদের ঘরে নিত্য আসবাবপত্রের মতো ছিল। বড় হয়ে বুঝেছি, মিলির মৃত্যুর ছায়ার মধ্যেই আমি ভীষণভাবে বড় হয়ে উঠেছিলাম। মিলি আমার মা–বাবার খুব প্রিয় সন্তান ছিল। তাকে হারানোর ফলে যে বৈরাগ্য তৈরি হলো তাঁদের মনে, আমার শৈশব দিয়ে তার অভাব পূরণ হলো না। মিলি মারা যায় হামজ্বরে, ১৯৭১ সালে। দাদির ভাষায়, সংগ্রামের বছরে। আমার তখন এক বছর বয়স। এক বছরের স্মৃতি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্মৃতিধরেরও মনে থাকার কথা না। কিন্তু আমার চোখে সবকিছু যেন ছবির মতো ভাসে! মুক্তিসংগ্রামের বছর। আমার বোনের মরে যাওয়া। অর্জিত অভিজ্ঞতা নয়, অর্পিত স্মৃতি।
এই স্মৃতির অর্পণ কতভাবে ঘটে! যুদ্ধ যখন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে যেতে থাকল, তখন অন্য অনেক পরিবারের মতোই আমাদের পরিবারের শক্তসমর্থ তরুণ-যুবারা জীবনদানের যুদ্ধে গেল। বৃদ্ধ, অশক্ত, নারী ও শিশুরা জীবনরক্ষার যুদ্ধ বেছে নিল। এই বৃহত্তর দলের দায়িত্বে ছিলেন আমার বাবা। ছোট ভাইয়েরা তাদের পরিবারকে তাদের বড় ভাই অর্থাৎ আমার বাবার জিম্মায় রেখে আখাউড়ায় প্রশিক্ষণে চলে গেল। আর বাবা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। তিনি নুহের নৌকার আদলে বিশাল একটা বজরা বানালেন (বা সেটা কোনো বড়সড় মহাজনি নৌকাই হবে, তিনি কাস্টমাইজ করে নিলেন)। সেই বজরায় কয়েকটা শোবার ঘর, রান্নাঘর, গোসলখানা, টয়লেট ইত্যাদির ব্যবস্থা ছিল। যখন পাকিস্তানি বাহিনী লালপুর-বাইশ মৌজার দিকে আসতে শুরু করল, তিনি পরিবারের সব নারী-শিশু-বয়স্কদের দিয়ে ভাটিবাংলার বিস্তীর্ণ হাওরে ভেসে গেলেন। তত দিনে বর্ষাও এসে গেছে বাংলায়। জলে-অপটু পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে ভরা বর্ষার বিশাল হাওরে ধাওয়া করে আমাদের মেরে ফেলা নিশ্চয়ই খুব সহজ কাজ ছিল না।
যুদ্ধের শেষ দিকে আমার বড় বোন মিলি হামজ্বরে মারা যায়। ওর বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। জলে-ভাসা জীবনে ওর কাজ ছিল আমাকে চোখে চোখে রাখা। এক বছর বয়স, কখন হামাগুড়ি দিয়ে টুপ করে হাওরের জলে তলিয়ে যাই! আমার সেই বোনটি আমাকে পাহারা দিত। ভয়ে তার ঘুমই হতো না। ওর অতন্দ্র পাহারার কারণেই আমার পক্ষে আজও মরে যাওয়া সম্ভব হলো না। অথচ সে-ই মরে গেল, মাত্র তিন দিনের হামজ্বরে। মুক্তিসংগ্রামের বছরে।
মিলি মারা যাওয়ার পরদিন আমাদের বজরা গ্রামের ঘাটে এসে লাগে। নৌকা থেকে মিলির নিথর দেহ কোলে করে নেমে আসছেন বড় কাকা। বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে অন্যরা। একটা শান্ত দিন। কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। শুধু ব্রহ্মাজুড়ে একটা বিশাল চিৎকার যেন ফ্রিজ হয়ে আছে। কেউ টোকা দিলেই ভেঙে হাজার টুকরো হয়ে নীহারিকাময় ছড়িয়ে পড়বে!
এই যে দৃশ্যটির কথা বললাম, এটিই আমার মুক্তিযুদ্ধের ব্যক্তিগত স্মৃতি। কিন্তু আমি তো এই দৃশ্য দেখিনি! মানে, মিলির মৃতদেহের বাড়ি ফেরার দৃশ্যটি—এটির কথা আমাকে কেউ বলেনি। বহুদিন পর, কিশোর বয়সে একদিন গ্রামের বাড়িতে এসে, নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি আনমনে এই দৃশ্যটি বানিয়েছিলাম। তারপর থেকে এ দৃশ্যটি আমার অভিজ্ঞতার অংশ। এটি যে অর্জিত অভিজ্ঞতা নয়, অর্পিত স্মৃতি। এর মধ্যে কোনো জোরাজুরি নেই, থাকলে ‘আরোপিত’ স্মৃতিও বলা যেত। অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব স্মৃতি ব্যক্তির নিভৃতির অংশ হয়ে বেঁচে থাকে। এ লেখাটি না লিখলে হয়তো আমি বুঝতেই পারতাম না।
বজরার ঘটনাটিও এমনই। এ গল্পটি দাদি করতেন। সংগ্রামের সময়ে তিনিও আমাদের সঙ্গে বজরায় বসত করতেন। ছোটবেলায়, তাঁর মুখ থেকে এই গল্প শুনতে শুনতে একদিন আমার মনে হলো, আমি জানি বিষয়টা! আমার স্মৃতি থেকে একটা ঝাপসা ছবি একদিন ঝাপট দিল। ছবিটি এমন: আমি শুয়ে আছি পাটাতনে, আর ছইয়ের ওপরে কোথাও একটা হারিকেন আটকানো। নৌকার দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে ওটা ডানে-বাঁয়ে দুলছে। অদ্ভুত বিষয় হলো, হারিকেনের গল্পটা আমাকে কেউ বলেননি। আমি পরে মাকে জিজ্ঞাসা করেছি। যুদ্ধের সময়ের গল্প আমার মা-বাবা কেউই বলতেন না। মিলির মৃত্যুশোকই এর কারণ, অনুমান করি।
পরবর্তী সময়ে নানাজনকে জিজ্ঞেস করেছি। হারিকেনের ব্যাপারটা তাঁদের কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারলেন না। আর দাদির গল্পের মধ্যে ছইয়ে আটকানো হারিকেনের ডানে-বাঁয়ে দোলার মতো কাব্যিক ব্যাপার থাকার কোনো কারণই নেই। তিনি খুব সংক্ষেপে নিখাদ আতঙ্ক আর ভোগান্তির গল্প বলতেন। ফলে, অনুমান হয়, এটিও আমি হয়তো বানিয়ে নিয়েছি। অন্য কোনো সময়ে অর্জিত অন্য কোনো অভিজ্ঞতা থেকে কেটে এনে এই দৃশ্যটিকে একাত্তরের কোনো গ্রামের ঘাটে বসিয়ে দিয়েছি! হতে পারে। কিন্তু সেটা জানা জরুরি না।
এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধের যে মহা-আখ্যান, তার সুপারস্টোরের কোনো অচলিত র্যাকে আমি আমার সামান্য গল্পগুলোকে জমা রাখি। আখ্যানকে বিব্রত করার জন্য নয়। বরং নিজের অর্পিত অভিজ্ঞতাকে এর অংশ হিসেবে একা একা পাঠ করার জন্য। আমার এসব অর্পিত স্মৃতির মায়ায় মহা-আখ্যানকেও অনেক মায়াময় মনে হয়। একান্ত নিজের অর্জনের মতোই লাগে।
সুমন রহমান কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত