১৯৭১ সালে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে কর্মরত থাকা অবস্থায় ছুটিতে ছিলাম। আমার বড় ভাই এ টি এম হায়দারও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। আমাদের দুজনেরই পোস্টিং ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। মার্চ মাসে আমি আমার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে ছিলাম।
জুন মাসের শেষ দিকে আমি ভারতে যাই। আমার ভাই এ টি এম হায়দারই আমাকে এবং আমার মা-বাবাকে ভারতে নিয়ে যান।
ভারতের আগরতলা পৌঁছেই আমরা গেলাম মেলাঘর। সেখানে ছিল ২ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স। ওই সময় আমার বড় ভাই ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার ২ নম্বর সেক্টরের ‘টুআইসি’ মানে সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। ওখানে থাকাকালে ভাইয়া একদিন আমাকে বললেন, ‘এখানে একটা হাসপাতাল চালু হয়েছে, তুই ওখানে কাজ করবি নাকি? ডা. জাফরউল্লাহ ও ডা. মবিন ওই হাসপাতালের সঙ্গে আছেন।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি তো বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছি। আমি এখানে কিছু একটা করতে চাই। ওই হাসপাতালের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয় আগস্টে।’
আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ডা. জাফরউল্লাহ সাহেব আমাকে বললেন, ‘আপনি হাসপাতাল দেখাশোনা করেন। আর আমি হাসপাতালের জন্য সরঞ্জাম এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে বিদেশ যাই।’ ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী ওখানে সব সময় থাকতে পারেননি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি চলে যান ইংল্যান্ডে পেশেন্টদের খাবারের পয়সা, ওষুধপত্র ও কাপড়চোপড় জোগাড় করতে।
ওখানে ডা. মবিন ও ডা. নাজিম অনেক অপারেশন করেছেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিফথ ইয়ারের কিছু ছাত্র। জুবায়ের, ফারুক মাহমুদ, লুত্ফর, কিরণ শংকর দেবনাথ, ডা. কাশেম এরাও ছিল। তারা ইনজেকশন দেওয়া, স্যালাইন দেওয়া, ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করা, ড্রেসিং চেঞ্জ করা—এসব কাজ করেছে।
হাসপাতালে মেয়ে-কর্মী ছিল ১৫-১৬ জন। গীতা, বড় গীতা, কল্পনা, পদ্মা, লুলু, টুলু, খুকু, আসমা, রেশমা, মিনু বিল্লাহ এদের নাম আমার মনে আছে। হাসপাতালে আমার রোল ছিল বলতে গেলে সামগ্রিক। আমাকে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হতো, ওষুধও জোগাড় করতে হতো। হাসপাতালের নিয়মকানুন ঠিক আছে কি না, সেটাও খেয়াল করতে হতো।
হাসপাতালটা ছিল বাঁশ দিয়ে তৈরি, চারদিকে বাঁশের বেড়া। ভিত ছিল মাটির। বাঁশের চারটা খুঁটির ওপর মাচা বেঁধে বিছানা করা হতো। একটা রুমের মধ্যে এদিকে ৫০ জন, ওদিকে ৫০ জন। এক হাত দূরে দূরে, যাতে একটা লোক যেতে-আসতে পারে, ওইভাবে বিছানাগুলো করা ছিল। ম্যাট্রেস তো আমাদের ছিলই না। থাকার প্রশ্নও আসে না। আমরা চটের ভেতর খড় ও মরা ঘাস ঢুকিয়ে সেলাই করে যেসব পেশেন্টদের বেশি দিন থাকতে হতো, তাদের বিছানায় ওগুলো ব্যবহার করতাম। ঘরের ছাউনি ছিল ছন দিয়ে করা। ওখানে বেশির ভাগ অপারেশনই করা হতো দিনের বেলা। আমরা তা-ই চাইতাম। যেসব পেশেন্ট আসতো, তাদের দিনের বেলায়ই অপারেশন সারতাম। সন্ধ্যা হলে আবার বাতির অসুবিধা ছিল। হারিকেন দিয়ে, টর্চলাইট দিয়ে, আবার পাঁচ ব্যাটারির টর্চলাইট ধরেও অপারেশন করা হয়েছে। তারপর যখন জেনারেটর পাওয়া গেল, তখন সেটা চালিয়ে আমরা রাতের বেলায়ও ইমারজেন্সি সার্জারি করেছি। অপারেশন রুমটা ছিল পুরো প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা। ওপর-নিচ চারদিকেই প্লাস্টিক। ছোট্ট ছোট্ট জানালা করা হয়েছিল ভেন্টিলেশনের জন্য।
আমরা বেশির ভাগ শেল এবং অন্যান্য গোলার স্প্লিন্টারের আঘাতজনিত ইনজুরি, মাইন ইনজুরি, তারপর রাইফেলের গুলি খাওয়া রোগী পেয়েছি এবং ট্রিটমেন্ট করেছি। কারও হাতে গুলি, কারও পায়ে, কারও কোমরে, কারও গলায় গুলি লেগেছে বা শেলের স্প্লিন্টার লেগেছে, এ রকম পেশেন্টই বেশি পেয়েছি আমরা।
সিরিয়াস পেশেন্টও আমরা অনেক পেয়েছি। যাদের আমরা কিছু করতে পারব না, তাদের স্যালাইন দিয়ে বা ব্লাড ট্রান্সমিশন করিয়ে আগরতলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত