বিজ্ঞাপন
default-image

এ এক মনোরম ভোরবেলা। খানিক আগে ফজরের আজান হয়েছে। ডাবের পানির মতো আলো ফুটছে চারদিক। প্রতিদিন এ সময়ই ঘুম ভাঙে ছেলেটির। বাবা মসজিদের ইমাম। পাঁচ ওয়াক্তের আজান তিনিই দেন। কণ্ঠস্বর এত আকর্ষণীয়, আরবি উচ্চারণ এত ভালো, তাঁর আজানে পাড়ার মানুষের তো বটেই, যেন-বা প্রকৃতিরও ঘুম ভাঙে। ঘুমিয়ে থাকা গাছের পাতারা জেগে ওঠে। পায়ের তলার ঘাস আড়মোড়া ভাঙে। ফুলেরা ফুটে ওঠে। হাওয়ায় ভাসতে থাকে সৌরভ। গাছে গাছে ডাকতে থাকে পাখিরা। পুকুরের জলে পড়েছে আকাশের ছায়া। স্বচ্ছ আকাশ নীল-সাদা রঙে ভরে আছে। দূরের মাঠ, প্রান্তর, নদী, খাল, জলাভূমি আলোকিত হচ্ছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের মাটিতে দাঁড়ান ছেলেটা। মাটির পরশে শরীরের প্রতিটি শিরায় আশ্চর্য এক কাঁপন লাগে। মন ভরে যায় গভীর আবেশে। যেন-বা মাটি তার সবটুকু মমতা, সবটুকু মায়া আর ভালোবাসা রক্তে মিশিয়ে দিচ্ছে, ছেলের মনের অতলে দোলা দিয়ে মাটি তাঁকে বলছে, আয় বাছা আয়, আমার বুকে আয়।

মাটি তাঁকে এভাবে ডাকে। প্রতিদিন তিনি শোনেন মাটির ডাক। মা যেমন করে ডাকেন, মাটিও ডাকে তেমন করে। একা থাকলেই, নিভৃতে আড়ালে চলে গেলেই মা এবং মাটি যেন তাঁকে সমস্বরে ডাকে। রউফ ও রউফ, কই গেলিরে বাজান?

ছেলেটির নাম রউফ। পুরো নাম মুন্সী আবদুর রউফ। বাবা রেখেছেন এই নাম। মুন্সী তাঁদের পদবি। বাবার নাম মুন্সী মেহেদি হাসান। মমতাময়ী মায়ের নাম মকিদুন্নেসা। ছোট দুটো বোন আছে। জোহরা বেগম, হাজেরা বেগম। জোহরা আর হাজেরা।

রউফদের গ্রামের নাম সালামতপুর। জেলা ফরিদপুর। সালামতপুর কি রোয়ালমারী থানায়? কোথাও দেখি থানা বোয়ালমারী, কোথাও লেখা হয় উপজেলা মধুখালী। বাংলাদেশের থানাগুলো উপজেলা হয়েছে বহু পরে।

সালামতপুর এখন ‘রউফনগর’। সেই ছেলের নামে গ্রামের নাম।

দেশভাগের চার বছর আগের কথা। ১৯৪৩ সাল। এই উপমহাদেশ শাসন করছে ব্রিটিশরা। ভারতবর্ষ মানে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া। তাদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে জাগছে মানুষ। ইংরেজ তাড়াও। ক্ষুদিরাম বসু, বিনয়, বাদল, দীনেশ—কত স্বদেশি! স্বদেশি আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ইংরেজ হটাও। ফিরিঙ্গিদের নির্মূল করো। এ দেশ আমাদের। এখানে অন্য কারও জায়গা নেই। ভারত ছাড়ো।

সেই উত্তাল দিনে, মেহেদি হাসান-মকিদুন্নেসা দম্পতির ঘর আলো করে এলেন রউফ। মে মাসের ৮ তারিখ। তখন ইমামতির পাশাপাশি মক্তবে শিক্ষকতা করেন মুন্সী মেহেদি হাসান।

শৈশবে আড়পাড়া মাদ্রাসায় রউফকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পূর্ববঙ্গ নামের ভূখণ্ডটি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন রউফ। পায়ের তলার মাটি তো তাঁকে ছুঁয়েই আছে! বহতা হাওয়া বুলিয়ে দিচ্ছে মায়াবী পরশ। মাঠ-প্রান্তরের ওপাশ থেকে উঠে এসেছে সূর্য। আলোর নাচন পাতায় পাতায়। সোনালি ফসলে ভরে আছে মাঠের পর মাঠ।

নদী-খাল বয়ে যাচ্ছে নিজস্ব নিয়মে। মানুষ ব্যস্ত হয়েছে বিষয়কর্মে। দেশটিকে রউফ খুব ভালোবাসেন। খুব। দেশের মাটি যেমন তাঁকে ডাকে, তিনিও ডাকেন মাটিকে। গাছপালা, ফুলপাখি তাঁকে ডাকে, তিনিও তাদের ডাকেন। মাঠ, নদী, খাল, বিল, মাথার ওপরকার আকাশখানি, রউফের মনে হয় এসবই তাঁর। তাঁর নিজস্ব সম্পদ। কাউকে কোনো দিনও এই সম্পদ তিনি ছিনিয়ে নিতে দেবেন না। কিছুতেই তাঁর কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না তাঁর নিজস্ব মাটি, নদী, খাল, বিল, শস্যের মাঠ আর মাথার ওপরকার আকাশটুক। রোদ্র-ছায়ায়, জ্যোৎস্নায়-অন্ধকারে, তুমুল বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া, শীতের কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে থাকা দেশ, এ আমারই।

রউফ এমন করে তাঁর দেশটিকে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার কথা কাউকে বলেন না। না মাকে, না বাবাকে। না ছোট বোন দুটোকে, না কোনো আত্মীয়জন, বন্ধুকে। তিনি কথা বলেন মনে মনে। মাটির সঙ্গে বলেন, মাটিকে যে আমি বড় ভালোবাসি...। ফুল, পাখি, প্রজাপতিকে বলেন; মাঠ, নদী, আকাশকে বলেন; গাছের পাতা আর আর হাওয়াকে বলেন। তাঁর মনে মনে বলা কথা শুধু তারাই শোনে।

দশ বছর বয়সে বাবা মারা গেলেন।

তত দিনে ইংরেজ বিদেয় হয়েছে। দেশভাগ হয়ে গেছে। ভারত তো ভারতই, পাকিস্তান নামে বিচিত্র একটা দেশ তৈরি হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান। ভারতের পুবে-পশ্চিমে। এক অংশ থেকে আরেক অংশের দূরত্ব বারো শ মাইল। শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি ...গুলো নানা প্রকার নিপীড়ন শুরু করল বাঙালিদের ওপর। দেশভাগের পরের বছর থেকেই শুরু হলো ...গুলোর বাঙালি উৎপীড়নের নানা কর্মকাণ্ড।

মুন্সী আবদুর রউফ জন্ম: ৮ মে ১৯৪৩, মৃত্যু: ৮ এপ্রিল ১৯৭১, জন্মস্থান: সালামতপুর, ফরিদপুর, যোদ্ধা: ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যুদ্ধ: রাঙামাটি-মহালছড়ি নৌপথের বাকছড়ির বাঙ্কারে, পদবি: ল্যান্স নায়েক, সমাধি: রাঙামাটির নানিয়ারচরে

রউফ স্কুলে পড়ছেন। অষ্টম শ্রেণির পর পড়া আর এগোল না। সংসারে অভাব। মা আর ছোট দুই বোন। তাদের মুখে দুবেলার অন্ন তুলে দেওয়া! কাজে নামতে হবে রউফকে। মা-বোনদের বাঁচাতে হবে।

রউফের এক চাচা মুন্সী মোতালেব হোসেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে, ইপিআরে চাকরি করতেন। রউফের বয়স বিশ বছর হয়েছে। চাচার সহযোগিতায় রউফ ইপিআরে যোগ দিলেন। তারিখ ৮ মে ১৯৬৩।

শুরু হলো প্রশিক্ষণ। কঠোর পরিশ্রম সেই প্রশিক্ষণে। রউফের দৈহিক ও মানসিক শক্তি প্রবল। অতিসফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করলেন। দায়িত্ব পেলেন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষার।

৮ তারিখটি যেন জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল রউফের। জন্ম ৮ তারিখ, পড়াশোনা ৮ম শ্রেণি, ইপিআরে যোগদান ৮ তারিখ। পরবর্তীকালে আরও দুটো ৮ জড়াবে তাঁর জীবনে। আমরা তাঁর সেই জীবনের দিকে যাচ্ছি।

ছেলেবেলা থেকেই রউফ নির্ভীক আর দায়িত্বশীল। যেকোনো বিপদের মুখে তিনি গিয়ে দাঁড়াতেন সামনে। অন্যদের আড়াল করে নিজে চেষ্টা করতেন বিপদ ঠেকাতে।

একবার এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল: বন্ধুদের নিয়ে চৈত্র-বৈশাখ মাসের গরমের কালে মাঠে খেলতে গিয়েছেন রউফ। ফেরার সময় দল বেঁধে ফিরছেন। জঙ্গুলে পথ। বিকেল শেষ হয়ে আসা আলোয় এক ভয়ংকর গোখরো ফণা তুলে দাঁড়াল। পথ রোধ করল। বন্ধুরা ভয়ে অস্থির। সেই ভয়ংকর গোখরোর মোকাবিলা করার জন্য রউফ গিয়ে দাঁড়ালেন সামনে। বন্ধুদের বললেন, তোরা ধীরে ধীরে পেছন দিকে চলে যা। আমি গোখরো তাড়ানোর ব্যবস্থা করছি।

default-image

হাতের কাছে ঝোপজঙ্গল। শক্ত এক ডাল ভাঙলেন রউফ। সাপ তাঁকে কী আক্রমণ করবে, তিনিই আক্রমণ করলেন গোখরোকে...

এই তো রুখে দাঁড়ানো। এই তো বীরত্ব। এই তো নিজের জীবন তুচ্ছ করে অন্যকে বাঁচানো।

এভাবেই বড় হয়ে উঠছিলেন রউফ। মুন্সী আবদুর রউফ।

তারপর এল ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের কাল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের স্বাধীনতার অগ্নিঝরা দিন। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর সেই অবিস্মরণীয় ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালি জাতিকে যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে বললেন আমাদের মহান নেতা, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’

বাঙালি জাতি তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার আদেশ শিরোধার্য করে নিল। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

রউফের বয়স তখন ২৮ বছর।

মার্চ মাসে মুন্সী আবদুর রউফ ছিলেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের ১১ নম্বর উইংয়ে কর্মরত। মেশিনগান চালানোয় অতিশয় পারদর্শী তিনি। মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের এক নম্বর মেশিনগানচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এল ২৫ মার্চের সেই কালরাত।

পাকিস্তানি সৈন্যরা, পৃথিবীর ইতিহাস কলংকিত করা, মানুষের মতো দেখতে জন্তুগুলো ব্যাপক গণহত্যা চালাল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে। সেই রাতে ঢাকা শহরে যাঁরা ছিলেন তাঁরা দেখেছেন কী ভয়ংকর তাণ্ডব, কী নৃশংস হত্যাকাণ্ড এক রাতে ঘটিয়েছিল জন্তুরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, সদরঘাট টার্মিনাল প্রতিটি জায়গায় শুধু লাশ আর লাশ। রক্তের নদী বয়ে গেছে ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে। নবাবপুর রোডের ওই দিকে মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়েছে এক পাকিস্তানি, আরেকজন সেই শিশুর দিকে তুলে ধরেছে বেয়োনেট। শিশু সেই বেয়োনেটে...

ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা আগে থেকেই আঁচ করতে পারছিলেন এমন কিছু ঘটতে পারে। ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটা নিলেন তাঁরা। শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পদক্ষেপ নিলেন। সেই রাতেই তাঁরা বিদ্রোহ করলেন। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিলেন। শুরু করলেন মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ।

৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মেজর জিয়া। আর ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ওই ইউনিটের একজন কর্মকর্তা। এই গোটা ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ইপিআরের ১৫০ জন সৈনিক। তাঁদের দায়িত্ব হলো রাঙামাটি-মহালছড়ি নৌপথে নিরাপত্তাব্যূহ তৈরি করা। যাতে শত্রু সৈন্যরা এদিকে এলেই তাদের ধ্বংস করা যায়।

মুন্সী আবদুর রউফ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়ারচর এলাকার বাকছড়ির এক বাঙ্কারে।

এখানটায় দুই রকমের তথ্য পাচ্ছি।

১৮ এপ্রিল ভোরে চেঙ্গিখাল দিয়ে শত্রুরা এগিয়ে আসছিল। দুটো লঞ্চ আর একটা স্পিডবোট নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছিল। সেখানে পাহারায় ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর নাম মাহফুজ। শত্রুরা তাঁর ওপর তিন ইঞ্চি মর্টারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। তবে তখনো পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

দুপুরের পর, সুবেদার মোতালেব পাহারারত আছেন চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে। এ সময় ছয় ট্রাকভর্তি পাকিস্তানি সৈন্য সেই পথে যাচ্ছিল। সুবেদার মোতালেব তাঁর অ্যামবুশ থেকে আক্রমণ চালান। শত্রু সেনাদের তিনটি ট্রাক ধ্বংস করে দেন। তাতে ৩০-৪০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

পরদিন, ১৯ এপ্রিল শত্রুরা দুপথেই এগোতে থাকে। নৌপথ ও স্থলপথে চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। খুবই জোরালো আক্রমণ। এখানে পাহারারত ছিলেন মুন্সী আবদুর রউফ। তারপরের ঘটনা সর্বত্র একই রকম পাওয়া গেছে। শুধু তারিখের হেরফের দেখা যাচ্ছে। ১৮, ১৯ বা ২০ নয়, ঘটনার দিন পাওয়া যাচ্ছে ৮ এপ্রিল।

আমরা এখন ৮ এপ্রিলের ঘটনা ধরেই এগোব।

৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২ নম্বর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের দুই কোম্পানি সৈনিক দুটো লঞ্চ ও সাতটি স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি-মহালছড়ি নৌপথের চারপাশে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান আঁচ করে তাঁদের ওপর মর্টারশেল নিক্ষেপ শুরু করে। তাদের অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এই সুযোগে কিছু পাকিস্তানি সৈন্য তীরে নামে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ঘিরে ফেলে।

ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কী করবেন? তিনি পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেন। অবস্থান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু নিরাপদে অবস্থান ত্যাগ করাও কঠিন। প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন কাভারিং ফায়ার। তা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে।

কে দেবেন কাভারিং ফায়ার?

রউফের মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। মাঠ থেকে ফেরার সময় ফণা তুলে দাঁড়িয়েছিল ভয়ংকর গোখরো। বন্ধুদের নিরাপদে সরিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সাপের মুখোমুখি।

আজও তা-ই করলেন রউফ। কাভারিং ফায়ারের দায়িত্ব নিলেন একা। এলএমজির কাভারিং ফায়ার শুরু করলেন। খালেকুজ্জামান তাঁর সৈন্যদের নিয়ে ধীরে ধীরে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে লাগলেন।

এদিকে রউফের অব্যর্থ গুলিতে পাকিস্তানিদের স্পিডবোটগুলো ডুবতে লাগল, সৈন্যরা হতাহত হলো। যারা প্রাণে বাঁচল, তারা লঞ্চ দুটো নিয়ে পালাতে লাগল।

একসময় পাকিস্তানিরা চলে গেল রউফের এলএমজির রেঞ্জের বাইরে। লঞ্চ থেকে রউফের বাঙ্কারের দিকে মর্টারশেল ছুড়তে লাগল। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী আবদুর রউফ তাঁর অসীম সাহসিকতা নিয়ে তখনো এলএমজি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একসময়...

একসময় শত্রুর গোলা এসে পড়ে রউফের বাঙ্কারে। মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মুন্সী আবদুর রউফের দেহ। বাংলার মাটি কেঁপে ওঠে। নিঃশব্দে কাঁদে রউফের দেশের মাটি। কাঁদে গাছপালা, আকাশ নদী। কাঁদে ফুল, পাখি, প্রজাপতি। কাঁদেন মা, কাঁদেন বোনেরা। কাঁদে দেশের লাখো কোটি মানুষ।

মুন্সী আবদুর রউফের নিষ্প্রাণ দেহ উদ্ধার করেছিলেন তাঁর সহযোদ্ধারা। নিয়ে গিয়েছিলেন নানিয়ারচর এলাকার চিংড়িখালের লাগোয়া এক টিলায়। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেখানে সমাহিত করা হয় বাঙালি বীর মুন্সী আবদুর রউফকে, যিনি নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন ১৫০ জন বাঙালি যোদ্ধাকে।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও আত্মদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মুন্সী আবদুর রউফকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস সিপাহি থেকে তাঁকে অনারারি ল্যান্স নায়েক পদে মরণোত্তর পদোন্নতি দিয়ে সম্মানিত করে।

শহীদ হওয়ার ২৫ বছর পর, ১৯৯৬ সালে বুড়িঘাট নিবাসী জ্যোতিষচন্দ্র চাকমা ও দয়ালকৃষ্ণ চাকমার সহযোগিতায় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের কবরের জায়গা শনাক্ত করা হয়। ১৯৯৭ সালে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ২০০৮ সালের ২৮ মে তাঁর নিজগ্রাম সালামতপুরের নাম ‘রউফনগর’ রাখা হয়। সেদিনই রউফনগরে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার’ উদ্বোধন করা হয়। তত্ত্বাবধানে, ফরিদপুর জেলা পরিষদ। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কামারখালী কলেজ। ১৯৮৭ সালে এই কলেজের নামকরণ করা হয় ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ ডিগ্রি কলেজ’। মধুখালী উপজেলার ‘গন্ধখালী বীরশ্রেষ্ঠ উচ্চবিদ্যালয়’, সাভার সেনানিবাসে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ গেট’, ঢাকায় ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ রাইফেলস স্কুল অ্যান্ড কলেজ’—এ রকম কত প্রতিষ্ঠান এই বীরের নামে।

বাংলার এক নিভৃত প্রান্তরে একাকী শুয়ে আছেন মুন্সী আবদুর রউফ। শীত যায়, গ্রীষ্ম যায়, শরৎ যায়, হেমন্ত যায়, বর্ষা যায়, বসন্ত যায়—বাংলার মাটি গভীর মমতায় বুকে ধরে রাখে তার বীর সন্তানকে। বাংলার নদী, খাল, জলাভূমি, ফসলের মাঠ আর গাছপালা, পাতা আর পাখিরা, প্রজাপতি আর হাওয়া, আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারা, রোদ-বৃষ্টি আর ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়, শিশিরের নরম কোমল স্পর্শ, চলে গিয়েও চিরকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের এই বীরসন্তান। বাংলার প্রকৃতি পরম যত্নে তাঁকে আগলে রাখবে। পরম করুণাময় তাঁকে সুখে রাখুন।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত