বিজ্ঞাপন
default-image

আমার দাদির কাছ থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের কাহিনি শুনেছি। তিনি ছিলেন যশোর জেলার কেশবপুরের বাসিন্দা। দাদিকে আমি বললাম, আমরা এ যুগের ছেলেমেয়ে স্বাধীনতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানি না। তাই তুমি স্বাধীনতার সময় যা দেখছ, তা বলো। দাদি জানান, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি একদিন সকালে রান্না করতে যাবেন, এমন সময় চুকনগর বাজারের দিক থেকে ১০ থেকে ১২টি গুলির শব্দ শোনা গেল এবং চিত্কার শোনা গেল—বাঁচও বাঁচাও। আমাদের বাড়ি থেকে চুকনগর বাজার এক-দেড় মাইল দূরে। আধা ঘণ্টা পর এবার একাধারে গুলির শব্দ শোনা গেল। আমার দাদি সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং চুকনগর বাজারে যেতে পালপাড়া পড়ে। পালপাড়া থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেন যে বাজারের মধ্যে নদী পড়ে এবং সেখানে একটি বড় তেঁতুলগাছ ছিল। সেখানে কাঁচামালের হাট বসত। সেখানে শুধু লাশ আর লাশ। নদীর পানি রক্তে লাল আর লাল।

আমাদের দাদা শুনলেন, পাকিস্তানিরা সব খুলনার দিকে চলে গেছে। তখন আমার দাদা তাঁর কিছু পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে একসঙ্গে সাহস করে বাজারে তেঁতুলতলায় গেলেন এবং দেখলেন, তেঁতুলতলায় লাশ আর লাশ। তেঁতুলগাছের শেকড়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল এবং এক বৃদ্ধ লোক ওই শেকড়ের মধ্যে পালিয়ে ছিলেন। একজন হিন্দু মহিলা তাঁর দুই মাসের ছোট বাচ্চা নিয়ে লুকিয়েছিলেন। হানাদাররা ওই অবস্থায় গুলি করেছিল এবং তাঁরা মারা গিয়েছিলেন। আমার দাদা শুনেছিলেন, তাঁরা খুলনার বটিয়াঘাটার হিন্দু। নৌকায় করে চুকনগর এসেছিলেন, সেখান থেকে সাতক্ষীরা হয়ে ভারতে যাবেন এ আশায়। সব বাজারে, নদীতে, তেঁতুলগাছের গোড়ায়, গোলবন্ধের মধ্যে, নদীর পাড়ে মন্দিরের মধ্যে, হাইস্কুলের সামনে এবং বাজারের পাশে, সেখানে এখন কলেজ হয়েছে, শুধু লাশ আর লাশ, রক্তে লাল হয়েছিল। চুকনগর বাজারের পাশে গ্রামের লোকজন নিহতদের নৌকা, টাকা, গয়না—মালামাল-জিনিসপত্র যে যার বাড়ি নিয়ে এসেছিল। আমার বড় চাচা ৫০ পয়সা দিয়ে একটা ফেটি সুতার জাল কিনে এনেছিলেন। আমাদের বাড়ি ছিল চুকনগর বাজার থেকে কিছুটা দূরে। এখন যে নদী কেশবপুরের দিকে গেছে, সেই নদীর পাশে আমাদের বাড়ি।

আমার দাদি আমাকে আরও জানান, নদীর ঘাটের পাশে আমাদের গ্রামের লোক সাজ্জাতের বাড়ি। বটিয়াঘাটার কিছু লোক আমাদের ঘাটে নৌকা বেঁধে তাঁদের দুঃখের কথা সবকিছু খুলে বলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা ভারতে যাচ্ছি, তাই আপনাদের কাছে কিছু মালামাল রেখে যাচ্ছি। আমরা ফিরে এসে মালামাল নিয়ে যাব।’ এ কথা বলে তাঁরা ভারতে চলে গেলেন। দেশ স্বাধীন হলো এবং তাঁরা ফিরে এসেছেন—এ কথা শুনে সাজ্জাত গলায় দড়ি দিলেন এবং সাজ্জাতের মা বিষ খেয়ে ছেলের পাশে গিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। ঠিক সেদিন ভারত থেকে ওই লোকগুলো ফিরে এসেছিলেন এবং তাদের কাছে মালামাল চাইলেন। সাজ্জাতের বউ বললেন, ‘যার কাছে মাল রেখেছ, তারা উঠানে শুয়ে আছে। তাদের কাছ থেকে নাও।’ ওই লোকটি চিত্কার করে কাঁদতে লাগলেন এবং অভিশাপ দিতে লাগলেন। সে সোনা গলিয়ে একটি সোনার থালা এবং ৫০ ভরি সোনার গয়না এবং অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে তুমি সুখী হতে পারবে না। এভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। পরে দেখা গেল, দিনমজুর সাজ্জাতের ছেলে এখন আমাদের গ্রামের সবচেয়ে ধনী লোক

 কানিজ ফাতিমা নিশা

চুকনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়

শ্রেণী: অষ্টম, রোল: ৬৩