বিজ্ঞাপন
default-image

ইসলামাবাদ, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, ১৩২১ জেড

বিষয়: যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা।

১. সারমর্ম: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জানিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক পরিস্থিতির হতাশাব্যঞ্জক অবনতি ঘটেছে। তিনি সেখানকার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিষয়ে গভর্নর মালেকের ১৩ ডিসেম্বরের প্রতিবেদনটি আমাকে দিলেন। যেহেতু সামরিক পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা নেই এবং মানবিক পরিস্থিতিও নাজুক, সেহেতু তিনি জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব আনার ক্ষেত্রে ভুট্টোকে যথাসম্ভব স্বাধীনতা দিয়েছেন। সারমর্মের সমাপ্তি।

২. ১৪ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় ১১:৩০ মিনিটে আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বাসভবনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ করি। আমাদের কথোপকথন চলে এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। এর অধিকাংশ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান খান উপস্থিত ছিলেন।

৩. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আমি জানালাম যে, ঢাকা থেকে আমি আমার কনসাল জেনারেল হার্বার্ট এ স্পিভাক-এর টেলিগ্রাম পেয়েছি। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, তাঁকে আজ সকালে গভর্নর আবদুল মোতালেব মালেক টেলিফোন করেছিলেন। তখন তিনি বলেছেন যে, তিনি এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁর কাছে (স্পিভাক) যুদ্ধবিরতির জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের খসড়া পেশ করতে যাচ্ছেন। তিনি (মালেক) জানিয়েছেন যে, যেহেতু পরিস্থিতি নিতান্তই খারাপ হয়ে পড়েছে, সেহেতু একটা যুদ্ধবিরতি খুবই প্রয়োজন। মালেক কনসাল জেনারেলকে আশ্বস্ত করেছেন যে, প্রস্তাবগুলোয় তাদের স্বাক্ষর যুক্ত করা থাকবে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সম্মতিও সংবলিত হবে। এর কিছু পরেই কনসাল জেনারেল স্পিভাকের কাছ থেকে আমি আরেকটি বার্তা পাই। তাতে গভর্নর মালেকের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘জেনারেল নিয়াজি জানিয়েছেন, যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধবিরতি বিষয়ে আলোচনা চলছে, সেহেতু আমার (মালেক) তরফ থেকে প্রস্তাবগুলো আর পাঠানোর দরকার নেই।’

৪. তারপর আমি ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞাসা করি, ডিসেম্বরের ১২ তারিখে আমাদের শেষ কথাবার্তায় তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে ‘সেই পরিস্থিতিতে যৌক্তিক সব কিছু’ করতে তিনি প্রস্তুত। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম আগের সেই সংলাপের পরে এবং তার বাইরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো চিন্তা পাকিস্তান সরকারের থেকে থাকলে তার প্রস্তুতি তাদের আছে কি না।

৫. ইয়াহিয়া বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। এবং যা ভাবা হয়েছিল অবনতির গতি তার থেকেও বেশি। পাশাপাশি, যে মাত্রায় রক্তপাত ঘটছে, মানবিক কারণেও তা থামানো দরকার। এবং তিনি আমাকে অবগত করতে চাইলেন যে, সামরিক ও বেসামরিক জনগণের হানাহানিতে এত মানুষ নিহত হচ্ছে যে, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘হলোকাস্ট’-এর মাত্রায় পৌঁছতে যাচ্ছে।

৬. আমাদের আগের আলোচনাগুলোতে ইয়াহিয়া স্পষ্ট করেছিলেন যে, সুনির্দিষ্ট কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই যুদ্ধবিরতির বিষয়টি কেবল সাধারণভাবে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি দাবি করে যে, পাকিস্তান সরকারের সুনির্দিষ্ট চাহিদাগুলো সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অবগত থাকুক। এরই ধারাবাহিকতায় ইয়াহিয়া বলেন, আমি যাতে আজ সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানাই, আমার ফোন পাওয়ার সময় তিনি সেই প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত ছিলেন।

৭. তিনি এও জানালেন যে, এই সকালেই তিনি গভর্নর মালেককে ডেকে পাঠানোর চেষ্টা নিয়েছিলেন। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই অকার্যকর থাকায় তার সঙ্গে সন্তোষজনক আলোচনা সম্পন্ন হতে পারেনি। এর সঙ্গে তিনি যোগ করলেন যে, গভর্নরের তরফ থেকে আগের দিন তাঁর কাছে যে বার্তা আসে, তা-ই তাঁকে নতুন করে ভাবিয়েছে এবং পুনর্বিবেচনায় চালিত করেছে। তিনি সেটা পড়লেন এবং আমার অনুরোধে একটি কপি আমাকে দিলেন। তিনি চাইলেন আমি যেন এটি আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠিয়ে দিই। ইসলামাবাদ থেকে আমি সেটি রেফটেলে পাঠিয়ে দিয়েছি।

৮. সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক পরিস্থিতির নৈরাজ্য ও অপূরণীয় অবনতি এবং সীমাহীন মানবিক পরিস্থিতির বিবেচনায় তিনি এখন যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ অবস্থায় এটা কার্যকর করার জন্য উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদবীধারী ভুট্টোকে জাতিসংঘের কাছে প্রস্তাব তোলার জন্য সম্ভাব্য ব্যাপক স্বাধীনতাও দিয়েছেন। তিনি আরও বললেন, তাঁর পররাষ্ট্র দপ্তর ভুট্টোর দায়িত্ব বিষয়ে এ অনুযায়ী তাঁকে বিশদভাবে জানানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। ইয়াহিয়া আরও বললেন, ভুট্টো জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বুশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন এবং তাঁকে এ বিষয়ক প্রতিবেদনের সারমর্ম জানাবেন। এ পর্যায়ে আমি তাঁর কাছে ভুট্টোর মিশন সম্পর্কে বিশদভাবে জানার আগ্রহ প্রকাশ করলে ইয়াহিয়া বললেন, ভুট্টোর কাছে পাঠানো বার্তা পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিভাষায় প্রণীত হয়েছে। তবে তাতে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম হচ্ছে, ‘এ পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম যা করা সম্ভব তা-ই করবেন।’

৯. ইয়াহিয়া এই বলে আমাদের সংলাপের ইতি টানলেন যে, এই বৈঠকের পরামর্শ এবং ভুট্টোকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি গভর্নর মালেককে অবহিত করবেন। তিনি এও বললেন যে, জেনারেল নিয়াজিকেও তিনি সামরিক নির্দেশনা দেবেন যাতে বর্তমান কূটনৈতিক যোগাযোগের সময় কেবল আত্মরক্ষামূলক তত্পরতা চালিয়ে যাওয়া হয়। তবে সকল প্রচেষ্টাতেই যেন জীবনহানি কমিয়ে রাখার দিকে নজর রাখা হয়।

ফারল্যান্ড

জোসেফ এফ ফারল্যান্ড, পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত (সেপ্টেম্বর ১৯৬৯-এপ্রিল ১৯৭২)

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত