বিজ্ঞাপন
default-image

উইং কমান্ডার এম কে বাশার (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও এয়ার ভাইস মার্শাল) উল্লেখ করেছিলেন যে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পরপরই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যদের মনের মধ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বীজ বপন হয়ে যায়। আর ২৮ সেপ্টেম্বর সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়। এদিনে জন্ম নেয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ইউনিট—কিলো ফ্লাইট।

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনারা স্থলযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীরোচিত আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছিল। কিন্তু আকাশ থেকে কোনো প্রতিরোধের ভয় তাদের ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বিমানবাহিনীর সদস্যরা চাইলেন যে আকাশও পাকিস্তানিদের জন্য বিপজ্জনক ও প্রতিরোধময় হোক। এর জন্য তাঁরা মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব বিমানবাহিনীর স্বপ্ন দেখেন।

default-image

মে মাসের মাঝামাঝি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারসহ (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও এয়ার ভাইস মার্শাল) বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ বৈমানিক মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। এসব বৈমানিক মুক্তিবাহিনীর বিমান শাখা গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতির সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে এ বিষয়ে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। যদিও সে সময়ে মুক্তিবাহিনীর এ রকম কোনো পরিকল্পনা নেওয়া বা কার্যকর করার সামর্থ্য ছিল না, উপরন্তু ভারত সরকারের মনোভাবও স্পষ্ট জানা যাচ্ছিল না।

সম্ভবত জুলাই মাসে সেক্টর অধিনায়কদের সভার পর মুক্তিবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য বিমান, মিসাইলসহ বিভিন্ন ভারী অস্ত্র সংগ্রহ বা ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশন, বাংলাদেশিদের বেসরকারি সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনকারী বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা বিভিন্ন অস্ত্র সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ সরকারকে তথ্য সরবরাহ করে। বাংলাদেশ বাহিনী এসব তথ্যের ভিত্তিতে বিমান ও ভারী অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তুলনামূলক বিবরণ তৈরি করে। সেখানে বিমানবাহিনীর জন্য এ-৪ স্কাইহক বিমানটি ক্রয়ের সুপারিশ করা হয়। লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনে নিয়োজিত আবুল ফতেহকে স্কাইহকসহ অন্য অস্ত্র ক্রয়ের জন্য খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আবুল ফতেহ ৯ অক্টোবর কলকাতা হাইকমিশনের প্রধান হোসেন আলীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে জানান যে স্কাইহক ক্রয়ের চেষ্টা অব্যাহত আছে, যদিও এ সময়ের মধ্যে বিমানবাহিনী গঠনের জন্য ভারত বাংলাদেশকে তিনটি বিমান প্রদান করে।

default-image

গণমাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের প্রথম সংবাদ প্রকাশ পায় ২৫ জুলাই। সেখানে উল্লেখ ছিল, ২৪ জুলাই বাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান কোনো সূত্র উল্লেখ না করেই বলেন যে বাংলাদেশ শিগগিরই বিমানবাহিনী গঠন করবে। তবে সামরিক গোপনীয়তার কারণে তিনি বিস্তারিত কিছু বলা থেকে বিরত থাকেন।

৫ আগস্ট বাংলাদেশ সংগ্রাম কমিটির বরাতে লন্ডন থেকে যুগান্তর পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি বিশ্বনাথ মুখার্জি জানান, বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব বিমানবাহিনী গঠনের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিমানবাহিনী গঠনের জন্য মুক্তিবাহিনীতে কমপক্ষে ৩০০ প্রশিক্ষিত বৈমানিক, গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিশিয়ান মজুত আছে।

সম্ভবত আগস্ট মাসের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারসহ ভারত সরকারের সচিব কে বি লাল, এয়ার মার্শাল দেওয়ান ও ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা আশোক রায়ের সঙ্গে বিমানবাহিনী গঠন বিষয়ে সভা করেন। সভায় ভারতীয়দের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়, বাঙালি বৈমানিকেরা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে পারেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে কয়েকটি বিমান, কিছু সরঞ্জাম আর প্রশিক্ষণ ও অভিযানের জন্য একটি বিমানঘাঁটি প্রদানের জন্য ভারতীয়দের অনুরোধ করেন।

default-image

আগস্ট মাসের শেষের দিকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল বিমানবাহিনী গঠনের বিষয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের সঙ্গে কলকাতায় আলোচনা করেন। দিল্লি ফিরে গিয়ে এয়ার চিফ মার্শাল লাল ভারত সরকারের কাছে দুটি প্রস্তাব রাখেন:

ক. বাঙালি বৈমানিকেরা ভারতীয় বিমানবাহিনীর নিয়মনীতির আওতায় থেকে ভারতীয়দের সঙ্গে অভিযানে অংশ নেবেন, অথবা

খ. ভারতীয় বিমানবাহিনী দুটি ভ্যামপায়ার বিমান বাংলাদেশ বাহিনীকে দেবে। যার সাহায্যে বাঙালি বৈমানিক ও গ্রাউন্ড ক্রুরা নিজেদের বিমান ইউনিট প্রতিষ্ঠা করবেন।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার কিছু সংশোধনীসহ দ্বিতীয় প্রস্তাবটির পক্ষে মত পোষণ করেন, তিনি ভ্যামপায়ার বিমানের বদলে হান্টার বিমানের সুপারিশ করেন।

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে কর্নেল ওসমানী, গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার এবং ভারতীয় প্রতিনিধিদল মিলিত হয়ে বিমানবাহিনী গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সভায় ভারত বাংলাদেশকে তিনটি বিমান প্রদানে সম্মত হয়। বিমানবাহিনীর বেস হিসেবে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরকে নির্বাচন করা হয়।

ডিমাপুরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তৈরি একটি পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি ছিল। সেখানে ৫ হাজার ফুটের রানওয়ে ও এটিসি ভবন ছিল। ভারতীয় সিভিল এভিয়েশন এটির রক্ষণাবেক্ষণ করত। এখানে সপ্তাহে একটি এফ-২৭ বিমান ওঠানামা করত। সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিমাপুরে বিমানবাহিনীর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৩০ মাইল দূরে অবস্থিত আসামের জোড়হাট বিমানঘাঁটি থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে অপারেশন, প্রশাসন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হতো। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ৯ জন বৈমানিক আর ৪৭ জন বিমানসেনা বিমানবাহিনীর নতুন ইউনিটে যোগ দেন। এঁদের সঙ্গে প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন ভারতীয় বিমানবাহিনীর চারজন কর্মকর্তা।

২৫ সেপ্টেম্বর রাতে মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে উল্লেখ করেন, মুক্তিবাহিনীকে বিমানবহর দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে।

২৮ সেপ্টেম্বর ডিমাপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারসহ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বৈমানিক ও গ্রাউন্ড ক্রুরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এয়ার চিফ মার্শাল লাল, এয়ার মার্শাল দেওয়ানসহ ভারতীয় বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অনুষ্ঠানে এয়ার চিফ মার্শাল লাল ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনটি বিমান নিয়ে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম বিমানবহর জন্মলাভ করে।

২ অক্টোবর স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ নতুন ইউনিটের অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরিচয় গোপন রাখা ও সামরিক বাহিনীর ঐতিহ্য অনুযায়ী ৪ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীতে কর্মরত জ্যেষ্ঠ বৈমানিক গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের নামের ইংরেজি অদ্যাক্ষর ‘কে’-এর সঙ্গে মিল রেখে ইউনিটের নামকরণ করা হয় ‘কিলো ফ্লাইট’।

প্রারম্ভিক প্রশিক্ষণ শেষে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিমানগুলোকে যুদ্ধোপযোগী করার জন্য বিভিন্ন ওয়ার্কশপে নেওয়া হয়। ১১ অক্টোবর থেকে এগুলো যুদ্ধবিমানের রূপ নিয়ে ডিমাপুরে ফেরত আসতে শুরু করে। এরপর শুরু হয় যুদ্ধের জন্য দিনে ও রাতে কঠোর প্রশিক্ষণ।

৩১ অক্টোবরের পত্রিকা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব বিমানবাহিনী গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংগৃহীত বিমান ও হেলিকপ্টারের জন্য মুক্তাঞ্চলে কয়েকটি বিমানঘাঁটি রয়েছে। শত্রু ঘাঁটি খুঁজে বের করা, গেরিলাদের পথ দেখানো এবং গেরিলা ইউনিটগুলোর সরবরাহ রক্ষার কাজে এই বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সংখ্যায় সীমিত হলেও যে উদ্দেশ্যে বিমান সংগৃহীত হয়েছে, তা পূরণের ক্ষমতা বিমানগুলোর আছে।

কিলো ফ্লাইটের অভিযান শুরুর কথা ছিল ২৮ নভেম্বর। এর জন্য কিলো ফ্লাইটের দুটি বিমানই ডিমাপুর থেকে সীমান্তসংলগ্ন বিমানঘাঁটিগুলোতে চলে আসে। জোরহাটে নিয়ে বৈমানিকদের প্রয়োজনীয় ব্রিফিং ও অন্য তথ্যাদি জানিয়ে দেওয়া হয়। বৈমানিকেরা আক্রমণের জন্য উড়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে অভিযান স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া ডাকোটা বিমানটির মধ্যে ত্রুটি লক্ষ করা গেলে ২ নভেম্বর এটিকে যুদ্ধের জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয়। তবে বাংলাদেশ বাহিনীর পরিবহনের কাজে ব্যবহারের জন্য এটি কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে অটার ও অ্যালুয়েট ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিযানের মাধ্যমে কিলো ফ্লাইট তাদের যুদ্ধযাত্রার শুভসূচনা করে। যুদ্ধের পরবর্তী ১৩ দিনে অ্যালুয়েট ২০টি আর অটার ১৬টি অভিযান পরিচালনা করে।

সূত্র: ইগলস ওভার বাংলাদেশ। পিভিএস জাগান মোহান ও সামির চোপড়া। হার্পার কলিন্স পাবলিশার্স, ইন্ডিয়া। ২০১৩। একাত্তরের যুদ্ধে বিমানবাহিনী

শ জামান। মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ। ২০১১। ১৯৭১: ভেতরে বাহিরে। এ কে খন্দকার। প্রথমা প্রকাশন। ২০১৪। যুগান্তর আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা (ভারত)।