বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে স্বল্পসময়ের প্রশিক্ষণেই আমরা সবাই রপ্ত করে ফেলি রাতের আঁধারে আধুনিক দিগদর্শন যন্ত্র ছাড়া এবং শত্রুর রাডার ফাঁকি দিয়ে অত্যন্ত নিচু দিয়ে মাত্র ২০০ ফুটের মতো উচ্চতায় (গাছের প্রায় মাথাসমান উঁচুতে) উড়ে বিমান চালনার কৌশল। এ ছাড়া আমরা সবাই প্রশিক্ষিত হই কেমন করে শত্রুবিমানের মোকাবিলা করতে হয়, কত দূর থেকে রকেট ছুড়তে হয়, কখন এবং কীভাবে নিশানা লক্ষ্য করে বোমা ফেলতে হয়, কত কোণে ঝাঁপ (ডাইভ) দিতে হয়, কখন এবং কীভাবে নিশানা স্থির করে মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়তে হয় ইত্যাদি বিষয়ে। প্রশিক্ষণের সময় রাতের আঁধারে দেখার সুবিধার্থে আমরা গাছের সঙ্গে বা পাহাড়ের গায়ে সাদা প্যারাস্যুট রেখে শ্যুটিং বা লক্ষ্যভেদের অনুশীলন করতাম। আধুনিক কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা যন্ত্র ছাড়াই রাতের আঁধারে শুধু কম্পাসের সাহায্যে বিমান চালনায় পারদর্শিতা অর্জন করা ছিল বৈমানিকদের জন্য বিরাট এক সাফল্য। প্রশিক্ষণ স্বল্পমেয়াদি হলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার অভিপ্রায়ে সবাই ছিলেন উদ্গ্রীব। তাই প্রশিক্ষণে সব বিষয়ে পারদর্শী হতে তাঁদের এই সময়স্বল্পতা কোনো বাধাই হতে পারেনি। বরং এই স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণেই সবাই হয়ে ওঠেন একেকজন দুর্ধর্ষ বায়ুসেনা।

default-image

প্রশিক্ষণ শেষে আমরা সবাই অভিযানে যাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকি। ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ৩ ডিসেম্বর) মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের বীর বৈমানিক মুক্তিযোদ্ধারা বিমানের সাহায্যে পাকিস্তানিদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আক্রমণ করেন। ভারতের তেলিয়ামুরা থেকে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার আক্রমণ চালায় নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে। হেলিকপ্টার দলে সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম ও আমি ছিলাম। প্রথম অপারেশনে আমি ছিলাম না। আমাকে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে রাখা হয়। সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পৌঁছে তেলের ট্যাংকারের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন।

এর পরের অপারেশনে আমি অংশ নিই। ৬ ডিসেম্বর স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদের সঙ্গে সিলেট, মৌলভীবাজার ও কুশিয়ারা নদী হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অভিযান পরিচালনা করি। এদিন পাকিস্তানি বাংকার লক্ষ্য করে ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করি এবং মেশিনগানও ব্যবহার করি। কুশিয়ারা নদীতে পাকিস্তানি দুটি বার্জের ওপর দুটি রকেট ও ২০০টি গুলি চালিয়ে ডুবিয়ে দিই। ৭ ডিসেম্বর এলাকা পর্যবেক্ষণে গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিংকে (ভারতীয়) নিয়ে ফ্লাই করি। শত্রুদের বিরুদ্ধে কয়েকবার আক্রমণ করি ৮ ডিসেম্বরেও। সিলেটে শত্রুর সদর দপ্তরে আক্রমণ করি সরাসরি। ট্যাংক ধ্বংস করি সিলেটের কাছে। তবে সিলেট থেকে ভৈরব বাজারগামী পাকিস্তানি কনভয়ের ওপর পরিচালিত সার্থক হামলা এগুলোর অন্যতম। পরদিন মৌলভীবাজারে হামলার সময় হেলিকপ্টারটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিরাপদে কৈলাস শহর বন্দরে অবতরণ করতে সক্ষম হই। ১০ ডিসেম্বর দাউদকান্দির কাছে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারতীয় বিমান থেকে প্রাণ রক্ষার্থে প্যারাস্যুটে লাফিয়ে পড়া পাইলটকে সফলভাবে উদ্ধার করি।

default-image

১১ ডিসেম্বর নরসিংদীতে পরিচালিত আমাদের আক্রমণটি বেশ উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করার সময় ভৈরব ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়। ফলে মিত্রবাহিনীর ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার স্থলপথ বন্ধ হয়ে যায়। মিত্রবাহিনী নরসিংদীতে হেলিকপ্টার দিয়ে সেনাদের অবতরণ করাচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর সেনাদের অ্যামবুশ বা ঘিরে ফেলার আশঙ্কা দেখা দিলে ভারতীয় সেনারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। এ সময় ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ রেডিওযোগে আমাদের কাছে সহায়তা চেয়ে বার্তা পাঠায়। এ মিশনে বদরুল আলম ও আমি ছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল একজন গানার। আমরা অস্ত্র, গোলাবারুদে সজ্জিত একটি হেলিকপ্টার নিয়ে বেশ নিচুতে নেমে আক্রমণ চালাই। বেশি নিচে নামার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীও আমাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। আমরা সব বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর সফল অভিযান চালাতে সক্ষম হই। আমাদের আক্রমণে ওই দিন ২০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ২০-২৫ জন সেনা আহত হয়। বাকিরা নরসিংদী ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমরা নিরাপদে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে আসি। এই সফল অভিযানের ফলে মিত্রবাহিনীর সেনাদের অবতরণের সব বাধা দূর হয়ে যায়। এ ছাড়া ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্যারাট্রুপ অগ্রাভিযানে প্রতিকূল বাতাসের মধ্যেও তাদের বিমান-সহায়তা প্রদান করি।

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর মুক্তিবাহিনীর অটার ও অ্যালুয়েট বৈমানিকেরা বিজয়ীর বেশে হেলিকপ্টারে করে আগরতলা থেকে তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করি।

সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে (সম্পাদনা মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা) বইয়ে প্রকাশিত লেখকের রচনা থেকে সংক্ষিপ্ত