বিজ্ঞাপন
default-image

প্রশ্ন: আপনি কখন অনুভব করলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালির প্রতি অবিচার করছে?

উত্তর: আমি একজন পুলিশ অফিসারের সন্তান। স্বভাবত পরিবারে রাজনীতির কোনো চর্চাই ছিল না। স্কুলজীবন শেষ করেই বিমানবাহিনীতে যোগ দিই। পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্টিং ছিল। আরাম–আয়েশের সঙ্গেই চাকরিজীবন কাটাতে থাকি। এ সময় বাংলাদেশে কী হচ্ছে, তা খুব কমই জানতে পারতাম। ১৯৭০ সালে আমি জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া সিনেমাটি দেখি। এই সিনেমার মধ্য দিয়েই আমার মধ্যে প্রথম অনুভূতি আসে যে পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতি অবিচার করছে। এরপর আরও কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিদের শোষণ সম্পর্কে আমি আরও নিশ্চিত হই।

প্রশ্ন: মার্চ মাসে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন দমনের জন্য পাকিস্তানিদের প্রস্তুতি সম্পর্কে আপনি কী জানেন?

উত্তর: আমি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সি ১৩০ পরিবহন বিমানের বৈমানিক ছিলাম। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শ্রীলঙ্কা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসতে হতো। এতে সময় লাগত প্রায় তিন গুণ। মার্চ মাসে আমাদের বলা হয়, পিআইএর পাশাপাশি সি ১৩০ দিয়েও যাত্রী পরিবহন করতে হবে। প্রথম ফ্লাইটেই আমরা লক্ষ করলাম বেসামরিক পোশাকে অস্ত্রসহ সৈনিকদের ঢাকায় আনা হচ্ছে। এতে আমরা বুঝতে পারি, যেকোনো দিন ক্র্যাকডাউন হবে। সংবাদটা বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি।

প্রশ্ন: আপনি কীভাবে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন?

উত্তর: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি অফিসারদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কেউ সফল হন, কেউ বিফল হন। আমি চারদিকে খোঁজখবর রাখতে থাকি। সিদ্ধান্ত নিই, যেকোনোভাবে ঢাকা যাব এবং পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেব। মে মাসের শেষে সাত দিনের ছুটি নিই। ৩ জুন ছুটির শেষ দিনে আমি রাওয়ালপিন্ডি ফেরত না গিয়ে গোপনে পিআইএর ঢাকাগামী বিমানে উঠে ঢাকা চলে আসি। ঢাকা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে আটক করে। প্রায় দুই মাস আমার ওপর চলে অবর্ণনীয় অত্যাচার। আগস্ট মাসে ছাড়া পেয়ে আমি আগরতলা পালিয়ে যাই।

প্রশ্ন: কিলো ফ্লাইটের জন্য আপনাদের কীভাবে রিক্রুট করা হয়?

উত্তর: সেপ্টেম্বরে যখন কিলো ফ্লাইট সংগঠিত হচ্ছে, তখন বিমানবাহিনীর প্রায় সব বৈমানিক বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধরত। পাকিস্তানিরা যাতে বুঝতে না পারে তার জন্য যুদ্ধের ময়দান থেকে তাদের তুলে আনা হলো না। যাঁরা যুদ্ধের ময়দানে যাননি শুধু তাদের কিলো ফ্লাইটের জন্য একত্র করা হয়। আমি তখন অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে আমাকে অটার যুদ্ধবিমানের জন্য রিক্রুট করে কিলো ফ্লাইটে পোস্টিং করা হয়।

প্রশ্ন: আপনার প্রথম অভিযানের লক্ষ্যবস্তু কীভাবে নির্ধারণ করা হলো এবং আপনি তা কীভাবে কার্যকর করলেন?

উত্তর: নভেম্বরের মাঝামাঝি প্রশিক্ষণ শেষ হলে আমাদের জোরহাট বিমানঘাঁটিতে নেওয়া হয়। সেখানে ব্রিফিংয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং আমাকে বলেন, আমার লক্ষ্যবস্তু হবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর–সংলগ্ন চট্টগ্রাম তেল শোধনাগার। সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ না করে তিনি জানান, লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণের সময় হবে মধ্যরাতের পাঁচ মিনিট পর। ব্রিফিং শেষে তিনি আমার মতামত জানতে চাইলে আমি জানাই যে তেল শোধনাগারটি বাংলাদেশের একমাত্র তেল শোধনাগার। স্বাধীন হলে এটি আমাদের প্রয়োজন হবে। আমি এর বদলে তেলাধারগুলো ধ্বংস করার প্রস্তাব দিই। এগুলো ধ্বংস করলে পাকিস্তানের যুদ্ধক্ষমতা অনেক কমে যাবে। চন্দন সিং আমার প্রস্তাবে একমত পোষণ করলেও লক্ষ্যবস্তুটি যেহেতু ভারতীয় বিমানবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্ধারণ করা হয়েছিল; তাই তিনি কিছু সময় চাইলেন। তিন দিন পর আমাকে জানানো হলো, আমার সুপারিশ গৃহীত হয়েছে। আরও জানানো হলো, আমার অভিযান শুরু হবে কৈলাশহর থেকে। আর অভিযান শেষে ফিরে আসব কুম্ভিগ্রামে। আমাদের অভিযানের তারিখ নির্দিষ্ট হলো ২৮ নভেম্বর। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বীর উত্তম, একজন গানার, একজন বোম্বার্ডিয়ার এবং দুজন গ্রাউন্ড ক্রু ২৬ নভেম্বর কৈলাশহরে আসি।

default-image

২৮ নভেম্বর সকাল থেকে অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। বিকেল সাড়ে চারটায় ভারতীয় একজন অফিসার এসে জানালেন, আমাদের অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। এরপর ৩ ডিসেম্বরের বিকেলে আবার ভারতীয় একজন অফিসার এসে জানালেন, সে রাতেই আমাদের অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তখন আমাদের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। বিমানের আচ্ছাদন খুলে ফেলে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নেওয়া হলো। রাত পৌনে আটটায় ইঞ্জিন চালু করে আটটায় যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমে এক হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়তে শুরু করি। পাকিস্তানি রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে উচ্চতা কমিয়ে এক শ ফিটে নিয়ে আসি। পানিতে চাঁদের আলোর প্রতিফলন দেখে বুঝতে পারলাম যে আমরা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে গেছি। এরপর আমরা বাঁয়ে মোড় নিয়ে তেল শোধনাগারের দিকে রওনা হলাম। আমরা যখন সীতাকুণ্ড পার হচ্ছি, তখন হঠাৎ করে দুটি বড় সার্চলাইট জ্বলে ওঠে। তারা সম্ভবত বিমানের আওয়াজ শুনতে পায়। আমরা সার্চলাইট এড়ানোর জন্য আরও নিচ দিয়ে উড়তে শুরু করি। কিছু দূর ওড়ার পর চাঁদের আলোয় বিমানবন্দরের রানওয়ে দেখতে পেলাম। আরও দেখতে পেলাম আমাদের লক্ষ্যবস্তু—সারি সারি তেলাধারগুলো।

আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে গেলাম। প্রথম আক্রমণে দুটি রকেট লক্ষ্যবস্তুতে ফায়ার করলাম। পরিষ্কার দেখলাম দুটিই লক্ষ্যবস্তুতে হিট করেছে, কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ ঘটল না। দ্বিতীয় আক্রমণেও দুটি রকেট ফায়ার করলাম, সেগুলোও বিস্ফোরিত হলো না। তৃতীয় আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতেই বিমানবন্দরের দুদিক থেকে ছয়টি বিমানবিধ্বংসী কামান গর্জে উঠল। আমাদের ডানার পাশ দিয়ে গুলি উড়ে যেতে লাগল। তৃতীয় আক্রমণের জন্য মাঝামাঝি একটা তেলাধার বেছে নিলাম। এবার রকেট ব্যর্থ হলো না, তেলাধারে আগুন লেগে গেল। এরপর আমি চতুর্থ ও পঞ্চম আক্রমণ করলাম। এক আধার থেকে আরেক আধারে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকল।

এরপর আমাদের ফেরত যাত্রা শুরু হয়। লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানো কঠিন ছিল, কিন্তু লক্ষ্যবস্তু থেকে গন্তব্যে ফেরত আসা ছিল আরও কঠিন। আমরা এক শ ফুট ওপর দিয়ে উড়তে শুরু করে আস্তে আস্তে উচ্চতা বাড়াতে থাকি। অন্ধকারের মধ্যে আমরা সাধারণ দিক নির্ধারণ করে, গতি আর সময়কে বিবেচনায় রেখে এগিয়ে যেতে থাকি। কুম্ভীগ্রাম পৌঁছানোর আধা ঘণ্টা আগে বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পর খুব দুর্বল আওয়াজে উত্তর পেলাম। যা হোক বিমানবন্দরে নামলাম। নেমেই দেখি গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘বিবিসি আধা ঘণ্টা ধরে প্রচার করছে যে একটা অজ্ঞাতনামা বিমানের আক্রমণে চট্টগ্রাম তেল শোধনাগার ধ্বংস হয়েছে।’

আমাদের অভিযানে সময় লেগেছিল সাড়ে আট ঘণ্টা, যা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিমান আক্রমণ।