বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র। দুনিয়ায় যেখানেই মুক্তিসংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে, তার পেছনে ছিল বেতার। যা মানুষকে সর্বদা সজাগ রাখত শত্রুর বিরুদ্ধে। জনগোষ্ঠীর মনোবল চাঙা রাখার কাজ করেছে বেতার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতারও তার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল।
অপরিহার্য এই প্রচারমাধ্যম একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলার মানুষকে জাগ্রত করে আতঙ্কিত অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানবশক্তিকে বলবান করা এবং রণাঙ্গনে কিংবা বাংকারে বাংকারে যুদ্ধরত মুক্তিসেনাদের উদ্দীপ্ত করে বিজয় অভিযান ও শত্রুহননকে নিরন্তর জাগরিত রাখতে সাহায্য করে। মানুষের মনোবল সুরক্ষায় এবং মুক্তিকামী মানুষকে দৃঢ়প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত রাখার উদ্দেশ্যই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করার পর বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের যুদ্ধজয়ের অবশ্যম্ভাবী হাতিয়ার হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে। পরে কালুরঘাট বেতার প্রক্ষেপণ কেন্দ্রে বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। পাকিস্তানি হামলার আগ পর্যন্ত এই বেতার কালুরঘাটেই ছিল। সে কাজের যে অভিজ্ঞতা ও বাস্তব পরিবেশ, আজ তা চিন্তা করা দুষ্কর।
পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধে ভারত সরকার ৫০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন মধ্যম তরঙ্গের একটি ট্রান্সমিটারের ব্যবস্থা করেছিল। তাই নিয়ে ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হলো। এই প্রথম সরকার পরিচালিত প্রচারকেন্দ্র চালু হলো।
কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে প্রতিষ্ঠিত হলেও ট্রান্সমিটারটি ছিল সীমান্তের কাছাকাছি নিরাপদ কোনো একটি স্থানে। সেটি নিরাপত্তার কারণে আমাদের কাছেও গোপন রাখা হয়েছিল। এই শক্তিশালী বেতারযন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কারণ এর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধ কেন, শত্রুনিধনে আমাদের সফলতা ও শত্রুর ব্যর্থতা প্রচার, মুক্তিযোদ্ধাদের তত্পরতা ও তাঁদের অনুপ্রাণিত করা, দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ বাংলার মানুষের মনোবল অটুট রাখা ও তাঁদের সাহস দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশে সকল সহায়ক রাষ্ট্র-জনগোষ্ঠীকে জানাবার জন্য বেতারই ছিল অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এ ছাড়া অবাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘পাকিস্তান’ ভাঙা হচ্ছে বলে ভ্রান্ত ধারণা ছিল। তার বিরুদ্ধে সত্যটাকে তুলে ধরার দায়িত্বও এই বেতারের মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হতো।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র সম্পূর্ণভাবে নিজ শক্তি ও মেধায় পরিচালিত হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেটের বেতারকর্মী ও শিল্পী-কলাকুশলীরা এটি পরিচালনা করতেন। পাশাপাশি দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক-বুদ্ধিজীবীরা সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গান ও কথিকা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, চরমপত্র, জল্লাদের দরবার, অগ্নিশিখা, পিন্ডির প্রলাপ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতেসহ নানা বিষয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হতো। এতে অভিজ্ঞ সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, তোয়াব খান, মোহাম্মদউল্লাহ চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুল, রণজিত্ পাল চৌধুরী প্রমুখ প্রধানত বিশ্লেষণাত্মক প্রচারধর্মী কথিকা লিখতেন এবং সেগুলো প্রচারিত হতো। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শওকত ওসমান, এ আর মল্লিক, সৈয়দ আলী আহসান, আনিসুজ্জামান, গাজীউল হক, জহির রায়হান ছিলেন। রাজনৈতিক নেতা ও সংসদ সদস্যরাও ছিলেন।
সংবাদ বিভাগ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই মুক্তিসেনাদের সফলতা, শত্রুর পরাজয় জনগণকে সাহস দেয়া আর মুক্তিসেনাদের মনোবল দৃঢ় রাখার নানা উপাদান প্রকাশিত হতো। সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম আমি। সহকর্মী শব্দসৈনিক হিসেবে ছিলেন জালালউদ্দিন আহমদ, মৃণালকৃষ্ণ সেন, রণজিত্ পাল চৌধুরী, সুব্রত বড়ুয়া, এ মাসুম, আলমগীর কবীর, আলী যাকের, পারভিন হোসেন, নাসরিন আহমদ, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী রেজা চৌধুরী, নূরুল ইসলাম সরকার, বাবুল আখতার। তারা নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি বুলেটিন তৈরি ও পাঠ করতেন। এমনকি কথিকাতেও অংশ নিতেন। আমরা পরের দিকে ময়মনসিংহের জাহিদ সিদ্দিকীকে পেলাম, তখন থেকে উর্দু সার্ভিস চালু করলাম। জাহিদ উর্দুভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন।
রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ হলে স্পুল টেপগুলো একটি পোর্টফোলিও ব্যাগে রাখা হতো। বিএসএফের নির্দিষ্ট ব্যক্তি এসে এগুলো নিয়ে যেতেন। তারপর নির্ধারিত সকাল, দুপুর ও রাতের অধিবেশন শুরু হতো। প্রথমে আমাদের একটি রেকর্ডিং স্টুডিও থাকলেও পরে আরও একটি হয়েছিল।
প্রথমদিকে আমাদের হারমোনিয়াম তবলা কিছুই ছিল না। এসব ক্রমশ সংগ্রহ করা হয়। প্রয়োজনের খাতিরে অনেকেই গান লেখা শুরু করলেন। কলকাতার বীমা কোম্পানির আমাদের এক বন্ধু গোবিন্দ হালদার অনেকগুলো গান লিখে দিয়েছিলেন। যার মধ্যে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তাঁদের ভুলব না’— এই গানগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে আমার সবচেয়ে বড় স্মৃতি হলো, বিজয়ের মুহূর্তে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করছে, তখনই প্রচারিত হলো বিশেষ সংবাদ বুলেটিন, যে বুলেটিনে সবাই জানতে পারলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়লাভ করেছে। আজ আমরা মুক্ত, স্বাধীন। সংবাদটি আমার লেখা ও আমিই পাঠ করেছিলাম। এ আমার গর্ব। সেই সঙ্গে আরেকটি অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেল, তা হলো, বিজয় মুহূর্তে গীতিকার সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম তাত্ক্ষণিকভাবে লিখতে শুরু করলেন একটি গান। বিজয় নিশান উড়ছে ঐ....আর সুরকার সুজেয় শ্যাম সুর বসাতে থাকলেন। এমনি করে গানটি রেকর্ড করেই ওই সংবাদ প্রচারের পরপরই বেজে ওঠে। গানটির দুই লাইন করে লেখা হচ্ছে আর সুরকার সুর সংযোজন করছেন এবং শব্দসৈনিক গণশিল্পী অজিত রায়ের নেতৃত্বে কোরাসে গানটি পরিবেশন করা হয়েছিল। ঘটনাটি দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাধারণ এক অধ্যায়।
কামাল লোহানী (জন্ম ১৯৩৪—মৃত্যু ২০২০): সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
লেখকের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার ছিল মুক্তিযুদ্ধের অপরিহার্য’ (ইত্তেফাক, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫) রচনা থেকে সংক্ষেপিত