আমি চট্টগ্রাম বেতারে চাকরি করতাম। ১৯৬৮ সালে আমি ঢাকায় চলে আসি। শাহবাগে অফিস। বাসা ছিল ফার্মগেটে। ১৯৭১ সালে প্রতিদিনই এই শহরে মিছিল, মিটিং, আন্দোলন চলছে। অস্থির ঢাকা। ৭ মার্চ আমরা সবাই ছিলাম রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেওয়ার পর সবার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার হলো। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার উদ্দীপনা যেন পেল সবাই। ১৪ কি ১৫ মার্চ আমি সিলেটে আমাদের বাড়িতে চলে গেলাম। আমার মা–বাবা সেখানে থাকতেন। এপ্রিলের শেষের দিকে আমাদের সিলেটের বাসাটা ছেড়ে দিতে হয়।
কিছুদিন পর মা–বাবাকে হাইলাকান্দি রেখে একদিন আমি একাই শিলং থেকে গুয়াহাটি হয়ে কলকাতা যাই। পার্ক সার্কাসে আমার কাকার বাড়ি গিয়ে উঠি। বালু আখড়ায় আওয়ামী লীগের অফিস ছিল, সেখানে এমএনএ আবদুল মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এখান থেকেই জয় বাংলা পত্রিকা বের হতো। মান্নান ভাই থাকতেন একটি হোটেলে। তাঁর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে একদিন আমি পার্ক সার্কাস থেকে ট্রামে উঠি। একটু পরেই দেখি সেই ট্রামে চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত। তিনি আমাকে দেখে বললেন, আরে শ্যাম। কোথায় যাও। বললাম তাঁকে সবকিছু। তিনি শুনে বললেন, সেখানে কেন? তুমি যাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। আমি সেখানে যাচ্ছি। চলো আমার সঙ্গে।
আমি সুভাষদার সঙ্গে গেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ২৫ মে নতুনভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। আমি সেখানে যাই ৬ বা ৭ জুন। সেখানে গিয়ে তো আমি অবাক। বিখ্যাত সব মানুষ সেখানে। সমর দাস, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, রথীন্দ্রনাথ রায়, কাদেরী কিবরিয়া, অনুপ ভট্টাচার্য, আপেল মাহমুদ, কল্যাণী ঘোষ, তিমির নন্দী, মালা খুররম, রূপা খুররম, রফিকুল আলম, বুলবুল মহলানবীশসহ আরও অনেকে। আমাকে দেখে তাহের সুলতান ভাই (অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান) আমাকে দেখে বললেন, শ্যাম, ভালোই হলো, তুমি আসছ। একটা গান বানিয়ে ফেলো দ্রুত।
এরপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত আমার প্রথম সুর করা গান ‘আয় রে চাষা মজুর কুলি মেথর কুমার কামার’ গানটি। লিখেছিলেন কবি দিলওয়ার। তিনি সিলেটের। সমবেত কণ্ঠে গাওয়া এই গান নিয়মিত প্রচারিত হতে থাকে। এর কিছু দিন পর দ্বিতীয় যে গানটি করি, সেটি ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ গানটি। লিখেছিলেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ।
এরপর আমি বেশকিছু গান করি। এর মধ্যে বিশ্বপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের লেখা চারটি গান ছিল। প্রথমে তাঁর লেখা ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি পুণ্য শশীলে’ গানটি করি। গানটি প্রবাল চৌধুরী ও কল্যাণী ঘোষ দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার সুর করা সব গানই সমবেত। একমাত্র দ্বৈত গান এটিই। ভদ্রলোকের আরও তিনটা গান করি। ‘আজ রণ সাজে সাজিয়ে বিষাদ এসেছে বৈশাখ’। তারপর ‘ওরে শোন রে তোরা শোন’ এবং ‘সইব না আর সইব না’।
আমি থাকতাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেই। মাঝেমধ্যে কাকার বাসায় চলে যেতাম। একবার আমাকে ঈদের অনুষ্ঠান দেওয়া হলো। একটি গীতিনকশা। পুরোটাই লেখা শহীদুল ইসলামের। ঈদের তিন–চার দিন আগে এই কাজটি করার সময়ই এলেন অজিত রায়। গীতিনকশায় গান গাইলেন মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, রথীন্দ্রনাথ রায়, কাদেরী কিবরিয়া, অনুপ ভট্টাচার্য, আপেল মাহমুদ, কল্যাণী ঘোষ, তিমির নন্দী, রফিকুল আলমসহ আরও অনেকে। গীতিনকশায় একটি গান ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও’। গানটি গাইলেন রূপা খুররম।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি আসতেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি আমাদের নানানভাবে উৎসাহ জোগাতেন। এক মাস পর থেকেই প্রতি মাসে বেতন পেতাম। আমি সাড়ে চার শ টাকা পেতাম। কিছু টাকা হাইলাকান্দিতে মা–বাবার কাছে পাঠাতাম।
আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মোট ৯টি গান করি। সর্বশেষ গানটিও আমার করা। এরপর আর কোনো গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে হয়নি। শেষ গানটি করি ১৬ ডিসেম্বর সকালে। আমাকে রেডিওর অনুষ্ঠানপ্রধান আশফাকুর রহমান ডেকে বললেন, একটা বিজয়ের গান করতে হবে। তুমি দ্রুত ব্যবস্থা করো। আমরা তখনো কিছুই জানতাম না। কিন্তু গান কোথায় পাব। আশফাক ভাই বললেন, শহীদুল ইসলামকে দিয়ে লিখিয়ে নেন। আমি শহীদুল ইসলামকে বললাম। তিনি মুহূর্তেই ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানটির চার লাইন লিখে দিলেন। কিন্তু হারমোনিয়াম কোথায় পাই। একটাই হারমোনিয়াম রেডিও অফিসে। সমর দাস ওই হারমোনিয়াম দিয়ে গান সুর করছেন প্রবাল আর উমার জন্য। কোথায় বসব গানটি নিয়ে, জায়গাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চলে গেলাম গ্যারেজে। সেখানে গিয়ে মুখে মুখেই সুর করলাম। প্রথমে স্থায়ী অংশটায় সুর করি। এরপর শহীদুল ইসলাম অন্তরা করে দিলেন। মুখে মুখেই অন্তরাও সুর করলাম। এরপর কাকে দিয়ে গানটা করাব। অজিতদাকে পেলাম, বললাম। দাদা, আমার গানটা আপনি লিড দেবেন। আমি সমরদার কাছ থেকে ঘণ্টা দুয়েক পর হারমোনিয়াম আনালাম। হারমোনিয়াম আনার পর ২০ মিনিটের মধ্যে গানটি সবাইকে তুলে দিলাম। এরপর আরও ১০ মিনিটের মধ্যে গানটি রেকর্ড করাও হলো। গাইলেন রথীন্দ্রনাথ রায়, কাদেরী কিবরিয়া, মলয় গাঙ্গুলি, অনুপ ভট্টাচার্য, কল্যাণী ঘোষ, তিমির নন্দী, মালা খুররম, রূপা খুররম, রফিকুল আলমসহ আরও অনেকে। আমি এখনো বিস্মিত, কীভাবে ৩০ মিনিটের মধ্যে গানটি রেকর্ড করলাম।
বিকেলে জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এলেন। তিনি রেডিওতে ভাষণ দিলেন, আজ থেকে আমরা স্বাধীন। এরপরই বাজানো হলো ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই বাংলার ঘরে ঘরে’।
সুজেয় শ্যাম: সুরকার ও সংগীত পরিচালক