বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল যুদ্ধের ময়দানেই হয়নি, বহুদূরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে হয়েছিল। সেই লড়াইয়ে হার হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হতো তা নয়, তবে বিলম্বিত হতো, তা নিশ্চিত।

বাংলাদেশে গণহত্যা ঠেকাতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের দাবি প্রথম তোলে ভারত, কিন্তু পাকিস্তান বিষয়টি তার অভ্যন্তরীণ, এই যুক্তিতে সব আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে। কিন্তু জুন-জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধের চাপ সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা টের পেয়ে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয় পাকিস্তান নিজেই। কিন্তু তত দিনে ভারতের অবস্থান বদলে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হবে না, এই যুক্তিতে যেকোনো রকম শান্তিরক্ষী বাহিনী বা পর্যবেক্ষকের বিরোধিতা করে।

বাংলাদেশ প্রশ্নে পরাশক্তিসমূহের অবস্থান গোড়া থেকেই স্পষ্ট ছিল। পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ভারত তথা বাংলাদেশের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই দুই পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জাতিসংঘ। বস্ত্তত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ এই প্রশ্নে একবারের জন্যও মিলিত হতে পারেনি। সেই সময়ের জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট এ জন্য সব দোষ চাপিয়েছেন পরাশক্তিসমূহের ওপর। যুদ্ধের হুমকি দেখা দিলে তা ঠেকানোর দায়িত্ব জাতিসংঘের। আর সেই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হলো বিবদমান দেশসমূহের মধ্যে আশু যুদ্ধবিরতি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যুদ্ধবিরতি বা সীমান্ত সংঘর্ষ ঠেকাতে যদি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়, তার ফায়দা নেবে একমাত্র পাকিস্তান। অতএব যেকোনো মূল্যে সেই চেষ্টা ঠেকানো ভারতীয় কূটনীতির প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

৩ ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের শুরু। এরপর নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষে হাত গুটিয়ে থাকা আর সম্ভব ছিল না। ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম বৈঠক বসে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র পরিষদের এই দুই স্থায়ী সদস্য ও পরিষদের অস্থায়ী সদস্যরা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলেন। শুধু যুদ্ধবিরতি নয়, যার যার সীমান্তের পেছনে সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিও ওঠে। বিপক্ষে একমাত্র কণ্ঠস্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েত জোটভুক্ত অস্থায়ী সদস্য পোল্যান্ড। তারা পাল্টা প্রস্তাব তোলে, সবার আগে দরকার পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধান। সেই প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে একদিকে যেমন সংকটের রাজনৈতিক সমাধান হবে, তেমনি যুদ্ধেরও অবসান হবে। কিন্তু সেই প্রস্তাবের বিপক্ষে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। ডিসেম্বরের ৪ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে মোট ১৩টি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ১২-২১ ডিসেম্বরে আরও ১৩টি। প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিসমূহের বিরোধিতার কারণে ২১ ডিসেম্বরের আগে তার কোনোটিই গৃহীত হয়নি।

নিরাপত্তা পরিষদ অকার্যকর, এ কথা প্রমাণিত হওয়ার পর সোমালিয়া প্রস্তাব তোলে, বিষয়টি সাধারণ পরিষদে পাঠানো হোক। প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার মতো কোনো কার্যকর ক্ষমতা সাধারণ পরিষদের নেই, কিন্তু তার গৃহীত প্রস্তাবের রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। ৭ ডিসেম্বর একটানা ১০ ঘণ্টা বিতর্কের পর যে প্রস্তাব গৃহীত হলো, তাতে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সব সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হলো। রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানিয়ে একটি পাল্টা প্রস্তাব সোভিয়েতরা উত্থাপনের চেষ্টা করে, কিন্তু পর্যাপ্ত সমর্থনের অভাবে সেই প্রস্তাব ভোটাভুটিতে তোলা হয়নি।

এদিকে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি জানায়। এর ফলে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্ক গুণগতভাবে বদলে যায়, স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিযুক্তি কেবল সময়ের ব্যাপার। যুদ্ধের মাঠেও পাকিস্তান তখন চূড়ান্তভাবে কোণঠাসা। এ অবস্থায় আমেরিকার জন্য প্রধান দুশ্চিন্তা ছিল, পশ্চিম পাকিস্তান যাতে ভারতের দখলে চলে না যায় বা তার ভৌগোলিক সংহতি বিপন্ন না হয়, তা নিশ্চিত করা। একদিকে সে চীনের ওপর চাপ দিতে থাকে পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে, অন্যদিকে মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গোপনে জর্দান ও ইরানের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। পাশাপাশি সোভিয়েতদের ওপরেও চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। নিক্সন লিওনিদ ব্রেজনেভের কাছে এক বার্তায় জানালেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ না হলে তার দায়ভার মস্কোর ওপর পড়বে। তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বললেন, ভারতকে নিরস্ত্র না করতে পারলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মস্কো ভ্রমণ বাতিল করা হবে। তাতেও কাজ না হলে শেষ বেপরোয়া চেষ্টা হিসেবে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে আণবিক অস্ত্রবাহী সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নির্দেশ পাঠালেন নিক্সন।

আমেরিকার সামরিক হুমকি সহ্যের ক্ষমতা মস্কোর ছিল। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তারা ভলাদিভস্তক থেকে একটি রণতরী পাঠানোর ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তত দিনে অবশ্য জাতিসংঘে ভারত-বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েতরা ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিরতির পক্ষে বারবার প্রস্তাব উঠছে, প্রতিবারই সেই প্রস্তাবের বিপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বস্ত্তত, এ সময় সোভিয়েত রাষ্ট্র মোট সাতবার তাদের না-জ্ঞাপক ভেটো প্রদান করে।

ব্যাপারটা তাদের জন্য ক্রমশই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো রকম যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হওয়াও তার জন্য অসম্ভব ছিল। বস্ত্তত, এই সময় সোভিয়েত কূটনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল যথাসম্ভব কালক্ষেপণ। মস্কো থেকে এক বার্তায় খোদ ব্রেজনেভ জানালেন, ভারত তাঁকে আশ্বাস দিয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তান দখলের কোনো পরিকল্পনা তার নেই। সে উদ্দেশ্যে ভারতের ওপর চাপ তাঁরা বজায় রাখবেন, সে আশ্বাসও দিলেন তিনি।

চূড়ান্ত নাটকের অবশ্য তখনো বাকি। ১৩ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত যুদ্ধ প্রশ্নে ফের আলোচনা শুরু হলে পোল্যান্ড খসড়া আকারে একটি প্রস্তাব রাখে। তাতে বলা হয়, রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ৭২ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। এই সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে এবং সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। যেহেতু প্রস্তাবক পোল্যান্ড, ফলে ভাবা যেতে পারে, এর পেছনে সোভিয়েত সমর্থন ছিল। দেশের অখণ্ডতা চাইলে পাকিস্তানের এই প্রস্তাব লুফে নেওয়ার কথা। বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে, সে সময় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই তা হবে আত্মঘাতীস্বরূপ।

সলাপরামর্শের জন্য আরও সময়ের দরকার, এই যুক্তিতে ১৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে কার্যত কোনো বৈঠক হয়নি। ১৫ তারিখে যখন ঢাকায় পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণের প্রস্ত্ততি শুরু হয়ে গেছে—পরিষদের সভা বসল। এই সভায় যদি পোল্যান্ডের প্রস্তাবটি গৃহীত হতো, তাহলে যুদ্ধের কূটনীতি কোন দিকে গড়ায়, তা বলা কঠিন। পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন সে দেশের সদ্য নিযুক্ত উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। পরিষদে এক নাটকীয় ভাষণে ভুট্টো সেই খসড়া প্রস্তাব অথবা সে রকম কোনো একটা কাগজ—টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেলেন।

১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিষ্পন্ন হয়, কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ তখনো কোনো মতৈক্যে আসতে পারেনি। ভারত জানিয়ে দেয়, সে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করছে। একদিন পর ইয়াহিয়া খান জানালেন, তিনিও যুদ্ধবিরতিতে সম্মত। এর চার দিন পর, ২১ ডিসেম্বর, নিরাপত্তা পরিষদ অবশেষে কোনো ঝামেলা ছাড়া এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই প্রস্তাবে বলা হলো, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হতে হবে এবং ভারত ও পাকিস্তানকে নিজেদের সেনা যার যার সীমান্তের পেছনে ফিরিয়ে নিতে হবে।

তত দিনে অবশ্য ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে।

২২ মার্চ, ২০১১, নিউইয়ক ‌র্

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত