বিজ্ঞাপন
default-image

লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান বই থেকে নির্বাচিত অংশের সংক্ষেপিত অনুবাদ এখানে ছাপা হলো।

...১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর আমি সেনাবাহিনীর প্রধানের (সিওএস) কাছ থেকে একটি বার্তা পাই। আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, ভারত যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে, তাই আমাকে বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে সেনা মোতায়েন করতে হবে...। একই দিন আরেকটি বার্তায় আমাকে জানানো হলো, ভারত কাশ্মীর ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে।

...ভারত পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে—এমন মিথ্যা খবর জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স কেন আমাদের পাঠিয়েছিল, তা আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। আসলে, আমরাই পশ্চিম অংশে লড়াই শুরু করেছিলাম। জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স কি কয়েক দিন আগে একজন বার্তাবাহকের মারফত পশ্চিম অংশে তাদের আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাকে জানাতে পারত না?

...৬ ডিসেম্বর জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে আমার কৌশলগত ধারণা সম্পর্কে আমি একটি বার্তা পাঠাই।

এক. ৩ ডিসেম্বর থেকে শত্রু সর্বাত্মক লড়াই শুরু করেছে, পূর্বাংশের সব ফ্রন্টে তাদের আক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চারটি পূর্ণাঙ্গ ট্যাংক রেজিমেন্টের সমর্থনে শত্রুপক্ষের আট ডিভিশন সেনা এ হামলায় অংশ নিচ্ছে, তাদের সঙ্গে রয়েছে ৩৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ এবং ৬০-৭০ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিদ্রোহী। শত্রু আক্রমণ চালাচ্ছে বিমানবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায়। ভারতীয় বিমানবাহিনী আমাদের যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষতিসাধন করেছে...। স্থানীয় জনগণও আমাদের বিপক্ষে। আমাদের শক্তিবৃদ্ধি, ঘাটতি পূরণ বা অবস্থানের পুনর্বিন্যাস কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। তা হলে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। ভারতীয় নৌবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। তারা সব নদী অবরোধ করার চেষ্টা করছে। রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর ও যশোরের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে...। দুই. আমাদের সেনারা নয় মাস ধরেই সক্রিয় লড়াইয়ে জড়িত রয়েছে এবং তারা আরও তীব্র লড়াইয়ের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের কোনো স্বস্তি বা বিশ্রাম নেই। ..প্রচণ্ড লড়াইয়ে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। নিজেদের ট্যাংক, কামান ও বিমানের ছত্রচ্ছায়া না থাকায় পরিস্থিতির ঘটেছে অবনতি। অস্ত্রসহ রাজাকারদের পক্ষ ত্যাগের ঘটনাও বেড়ে চলেছে...।

তিন. এই কমান্ডের আওতায় ফরমেশনগুলোর বর্তমান তৎপরতা পূর্বপরিকল্পিত প্রতিরক্ষা লাইনে পৌঁছেছে। সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ: শত্রুপক্ষ অনৈতিক উপায়সহ সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করবে। আমরা শেষ রক্তবিন্দু ও শেষ বুলেট থাকা পর্যন্ত লড়াই করব।

সিজিএস ৭ ডিসেম্বর সংকেতের মাধ্যমে সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলোতে সেনা প্রত্যাহারে আমার কৌশলগত ধারণা অনুমোদন করেন।

...৮ ডিসেম্বর আমি সিজিএসের কাছ থেকে জি-০৯১২ নম্বর আরেকটি সংকেত পাই। এতে বলা হয়, ‘তৎপরতা শুরু হয়েছে। ৭ ডিসেম্বর পাঠানো জি-০৯০৭ সংকেত অনুযায়ী আপনি লড়াই অব্যাহত রাখুন।’ ‘তৎপরতা’ বলতে মূলত চীনাদের তৎপরতার কথাই বোঝানো হয়। জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স আমাকে ধোঁকা দিচ্ছিল; আসলে তখনো পর্যন্ত চীনারা কোনো যোগাযোগ, কোনো সংকেতও পাঠায়নি। ৬ ডিসেম্বর পাঠানো বার্তায় আমি সংকল্প ব্যক্ত করেছিলাম—শেষ রক্তবিন্দু ও শেষ বুলেট পর্যন্ত লড়াই করে যাব। আমার কৌশলগত পরিকল্পনা চিফ অব জেনারেল স্টাফ অনুমোদন করেছিলেন। এসব সত্ত্বেও কেন আমার সঙ্গে এমন প্রতারণা করা হলো?

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত