১৯৭১ সালে মানবতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের অপরাধের বিচার করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমাদের স্মৃতিবিলোপ ঘটছে। স্মৃতিতে ফিকে হচ্ছে একাত্তর। দায়মুক্তির কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিজেদের দেশে বারবার ‘জাতির ত্রাতা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। একই কারণে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীরা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিস্তার করেছে রাজনৈতিক প্রভাব। তাদের বিচারের ব্যর্থতা আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে; নিজেদের বিশ্বাস, পরিচয় ও লৈঙ্গিক কারণে যাঁরা একাত্তরে সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে নতুন করে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এই অবিচারের প্রভাব নারীদের ক্ষেত্রে আরও গভীর আকার ধারণ করেছে। প্রথমত, সহিংসতার স্মৃতি এবং পরবর্তী সময়ে সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সঙ্গে একই গ্রামে বসবাসের ফলে জীবনধারণের জন্য নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পরিবার রক্ষা অথবা সম্ভ্রম বাঁচানোর ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য নামমাত্র স্বীকৃতি এবং তৃতীয়ত একাত্তরের বৈপ্লবিক পরিস্থিতি সামাজিক ও লৈঙ্গিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে অর্থবহ পরিবর্তন হিসেবে অনূদিত হয়নি।
স্বাধীনতার জন্য কথা বলেছিলেন, সংকেত দিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, এমনকি যাঁরা অস্ত্র ধরেছেন, তাঁদের আমরা কীভাবে শ্রদ্ধা জানাব? মনের পর্দায় অসংখ্য নাম ভেসে উঠছে। কেবল তারামন বিবি বা শিরিন বানু মিথিই নয়, এঁদের মতো অসংখ্য নারী সেদিন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। সেলিনা পারভীনকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল। কারণ তাঁর লেখনী ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। যদিও সেলিনা পারভীনই সে সময় একমাত্র লেখক ছিলেন না। ’৭১ সালের ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত কারফিউ জারি ছিল। এ অবস্থায় চোখের সামনে রক্ত ঝরতে ঝরতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বাসন্তী গুহঠাকুরতার স্বামী। কারণ কারফিউয়ের কারণে তিনি স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি। পরবর্তী নয় মাস মেয়ে ও নিজেকে রক্ষা করতে যিনি এক আশ্রয় থেকে আরেক আশ্রয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন, নিজের নিরাপত্তা অনিশ্চিত জেনেও যিনি ধর্ষণের শিকারদের চিকিত্সাসেবা দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি সামাজিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেই বাসন্তী গুহঠাকুরতার অদম্য সাহসের স্বীকৃতি কি আমরা দিয়েছি?
আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ১৪ ডিসেম্বর পান্না কায়সার, লিলি চৌধুরী, শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী ও নূরজাহান সিরাজীর স্বামীদের বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। চোখ বন্ধ করলে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের সেই মুখগুলো আজও তাঁদের সামনে ভেসে ওঠে।
বিখ্যাত ড্রিফ্টউড শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, যিনি কেবল খুলনায় নিজের অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করেননি, বরং অন্যদের মধ্যেও সচেতনতার সৃষ্টি করেছেন, তাকেই বা সমাজ কীভাবে সম্মান জানিয়েছে? কুষ্টিয়ার মাসুদা খাতুন, এলিজান্নেসা, দুলজান্নেসা ও মোমেনা খাতুনরা ১৯৯১ সালে ঢাকায় গণ-আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, কীভাবে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধর্ষণ করেছিল, পরবর্তী সময়ে হানাদার বাহিনীর স্থানীয় দোসররা তাদের হুমকি দিয়েছিল ও হয়রানি করেছিল। তাঁদেরই বা সমাজ কীভাবে সম্মানিত করেছে?
স্বাধীনতা দিবসের পুরস্কারের কোনো তালিকায় এ নামগুলোর ঠাঁই হয়নি। একাত্তর ও এর পরবর্তী সময়ে নারীদের কথায় ফুটে ওঠে কীভাবে তাঁরা টিকে থেকেছেন। কেউ বা নিজেকে প্রথাগত চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করেছেন, কেউ বা সেদিনের আতঙ্কের স্মৃতির কারণে অন্তর্দহে ভুগছেন, অন্যরা নিজেদের জীবনে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির প্রভাবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। ক্রমাগত তাঁরা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন, কেন তাঁদের অভিজ্ঞতা জাতীয় আখ্যান থেকে বাদ দেওয়া হলো! ধর্ষণের ব্যাপারে প্রথম নৈশব্দ ভাঙেন নীলিমা ইব্রাহিম। সেটা ১৯৭৪ সালে, তাঁর আমি বীরাঙ্গনা বলছি বইয়ে। বেঁচে থাকা ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য স্থাপিত সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নীলিমা ইব্রাহিম যাঁদের সহায়তা করেছিলেন, সেই নারীদের কথা তিনি এ বইয়ে তুলে আনেন। নিজেদের পরিবার ও ঘর বাঁচাতে অসামান্য ভূমিকা পালনকারী নারীদের জাতীয় আখ্যান থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে সাম্প্রতিক নারীবাদী লেখাগুলোতেও। এই নারীদের অনেকেই গোবরায় একটি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। অন্যরা জানিয়েছেন, সংহতি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কীভাবে তাঁরা নিঃসঙ্গতাকে জয় করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতে কেন তাঁদের তুলে ধরা হয়নি—গ্রামের নারীদের এই প্রতিক্রিয়ার জবাবে নির্মাণ করা হয়েছিল প্রামাণ্য চলচ্চিত্র মুক্তির কথা (মুক্তির গান-এর উত্তরভাগ)।
নারীরা আরও একবার অবিচারের শিকার হয়েছেন। কারণ যুদ্ধ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিলেও পরিবার ও সমপ্রদায়ের পুরুষতান্ত্রিক বন্ধন থেকে নারীদের স্বাধীন করতে পারেনি। যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার, বৈধব্য বরণকারী কিংবা বাস্তুচ্যুত অনেক নারীর জন্য যুদ্ধকালীন নয় মাসের দুঃসহ অভিজ্ঞতা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। এ জন্য দায়ী অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও তাদের প্রতি সামজিক নিগ্রহ। বেঁচে থাকা নারীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার চাহিদা কি পূরণ হয়েছে? নারীদের কি রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে? সর্বোপরি ১৯৭১ কি সমাজকে প্রগতিশীল করতে পেরেছে? পারিবারিক সমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন নারীদের প্রতি রাষ্ট্রের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, চাকরিতে কোটাসুবিধার মাধ্যমে তাঁদের জন্য আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা। তবে এসব প্রচেষ্টা কি নারীদের আত্মনির্ভরতা ও স্বাধীনতাকে উত্সাহিত করতে পেরেছে, নাকি এগুলো তাঁদের জন্য কেবলই বেঁচে থাকার অবলম্বন?
ধর্ষণের শিকার নারীদের ললাটে জুটেছিল কলঙ্কের চিহ্ন। আর তাই তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি ছিল আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। রাষ্ট্রের সুযোগ ছিল পুনর্বাসন কেন্দ্রে ধর্ষণের শিকার নারীদের ভর্তি করে নেওয়া। যেখানে তাঁদের গর্ভপাত ঘটানো যেত কিংবা তাঁদের নবজাতক শিশুদের দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত।
ওইসব নারীর জীবন এভাবেই নামহীনতার বাতাবরণে ছেয়ে গেছে। অসংখ্য নারী পরিবারে আশ্রিত হয়ে নিরাপত্তা পেতে চেয়েছেন এবং নীরব থেকে ক্রমাগত আড়ালে থেকে গেছেন। সংসদে নারী-সদস্যদের চাপের মুখে বেঁচে থাকা নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়। তবে গৌরববোধক ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটিকে বোধহয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সমতুল্য হিসেবে দেখা হয় না। বীরাঙ্গনা বিয়ে করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানটি ছিল সমস্যার প্রথাগত সমাধান মাত্র।
স্বাধীনতা নামক সিনেমায় ইয়াসমিন কবির এমন একজন নারীর চিত্র ফুটিয়ে তোলেন, যার চোখের সামনে তার স্বামী ও সন্তানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিচারের জন্য একজন নারীর আত্মগত অনুসন্ধানের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে তার বিচ্ছিন্নতার এক বলিষ্ঠ দলিল এই চলচ্চিত্রটি। ষাটের দশকের অনেক আগে থেকে নারীরা সক্রিয়ভাবে জনপ্রিয় বিভিন্ন আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, তাঁরা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ ঠেকিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে জামায়াতে ইসলামী যে সমন্বিত বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক ইশতেহারের দাবি তোলে, তাতে পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানায়। কিন্তু নারীদের আন্দোলনের মুখে তত্কালীন পূর্ব-বাংলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো এর সঙ্গে একমত হয়নি। তখন থেকেই সম-অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের সমপ্রসারণ, সম্পদের অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য নারীরা নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তবে লৈঙ্গিক সমতা এখনো দূরের স্বপ্নই থেকে গেছে এবং নারীরা ক্রমাগতভাবে বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
স্বাধীনতার ৩৭ বছর চলছে। হানাদারদের দোসররা আজ যুদ্ধাপরাধে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করার সাহস পাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তারা তা-ই অস্বীকার করছে। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ তাদের জাতীয় নীতি ফোরামে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। আর নিজেদের মতবাদের ব্যাপক প্রচারের জন্য তারা নির্বাচনী জোটের সুবিধা গ্রহণ করে, যা বৈষম্যের সৃষ্টি করে এবং নারীসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উসকে দেয়।
আজ তারা বলছে, ইতিহাসের আগের অধ্যায় নতুন করে আর খোলার প্রয়োজন নেই...। তবে অতীত নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। আজ আমাদের এমন লোকদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যারা নারীদের মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। এসব লোকের চেহারায় ভেসে ওঠে ১৯৭১ সালের সহিংসতার জন্য দায়ীদের মুখাবয়ব, আর যাদের ফতোয়ার শিকার হচ্ছে নারীরা। একাত্তরের ইতিহাসের স্মরণ প্রগতিশীল নাগরিকদের মধ্যে সংহতির সৃষ্টি করতে পারে। যদি তা সত্যিকার অর্থেই মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস, সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাকে জোরদার করে থাকে। যখন নারীরা যুদ্ধাপরাধের প্রায়শ্চিত্ত দাবি করে, তখন তা মানুষের মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি সমাজের জন্যই। নারীদের জন্য ন্যায়বিচার কেবল দণ্ড ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয় না, সেই আইনি বিচারেই সমাপ্ত হয় না, এর সঙ্গে নিবিড় যোগ আছে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ, সামাজিক ও লৈঙ্গিক অবিচারের ইতি টানার আকাঙ্ক্ষার।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৮ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত